রেশম লতার কবিতা সম্পর্কে গদ্য

বাংলা কবিতার বাঁকবদলে একবিংশের নতুন ধারা



বাংলা সাহিত্যে অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগীয় প্রভাবের সমাপ্তি ঘটে। তাঁর কাব্য ধারার বৈশিষ্ট্যে ছিল আরবি, ফারসি ও হিন্দুস্তানি ভাষার মিশ্রণে আশ্চর্য নতুন এক বাগভঙ্গি ও প্রাচীন সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণে বাংলা কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ।
"হিমালয় মেনকা যদ্যাপি দিলা সায়
  লগ্নপত্র করিয়া নারদ মুনি যায়"
(অন্নদামঙ্গলকাব্য, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর)।

তাঁর সেই প্রাচীন বাগভঙ্গি ভেদ করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্যে যোগ দিল মাইকেল মধুসূদন। নতুন ধারার প্রতিভায় প্রশস্ত রাজপথ। সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক সাহিত্যের মোড় ঘোরালেন একাই। 
 
"অন্নদা! বহিছে শূন্যে সঙ্গীত-লহরী,  
 অদৃশ্যে অপ্সরাচয় নাচিছে অম্বরে।"
(অন্নপূর্ণার ঝাঁপি, মাইকেল মধুসূদন)।

কিন্তু তিনি যে ফল ফলালেন তাতে বীজ ধরল না, লেখা হলো সন্তুষ্টিহীন, উপযুক্ত বংশাবলী সৃষ্টি করলো না।  মিল্টন, বর্জিল, হোমার প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের কাছ থেকে সাহিত্য-সাধনার উৎসাহ কুড়িয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যেও তা প্রতীয়মান ছিল ঢের। 
    "পর্ব্বতশিখরে নাচি, বিষম তরসে, 
       মাতিয়া মেঘের সনে,"
(বায়ু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।
কিন্তু কালের বিবর্তনে সব হলো গত।

নতুন বাঁকে রবীন্দ্রনাথ এলেন আকাশছোঁয়া প্রতিভার দীপ্তি নিয়ে। তাঁর মানসিকতা মার্কসীয়- ফ্রয়েডীয় ভাবনার অনুসৃতি যা শিনতা ও দেহগত কামনা সম্পৃক্ত প্রেমের এক গভীর সমুদ্র। রবীন্দ্রনাথের শব্দ গঠন, ভাষাশৈলী, বৈচিত্র চিত্রকল্পের অনুভূতি প্রকাশের বিষয় ছিল অতুলনীয়। তাঁর কবিতা বৈশিষ্ট্য পরিশীলন এবং পরিমিতিবোধ যা বাংলা সাহিত্য তেমন করে কারোর মাঝে দেখতে পায়নি। আধ্মাতিকতা, পার্থিব-অপার্থিব জীবনের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন কলমের খোঁচায়।

"ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী 
 আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।"
(সোনার তরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

মাইকেল, বঙ্কিমদের মধ্যে আধুনিকতা ছিল না কেননা আধুনিকতা তখনো বাংলা কবিতা স্পর্শ করেনি। মূলত রবীন্দ্রযুগ হচ্ছে আধুনিকতার প্রস্তুতিযুগ।  

এবার নব নজরুলযুগ। নজরুল তার স্বকীয়তায় এতটাই উচ্ছল ছিল যে মানসিক ব্যক্তি সংকট উষ্ণতাকে  অতিক্রম করে  নতুন কাব্য দর্শন  সৃষ্টি করেছেন। দিগন্ত কাঁপানো  অবসাদ  ও জড়তা  ঘুচিয়ে  উল্কার মতো  আবির্ভূত হন কাব্য, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসে। বাঁধভাঙা জোয়ার বইয়ে দেন সাহিত্যের ডেরায়‌। নারী-পুরুষের বৈষম্য বিরোধী কবিতা রচনা করেন,,,

"বিশ্বে যা কিছু মহান চির সৃষ্টি কল্যাণকর 
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর" 
(নারী, কাজী নজরুল ইসলাম)।

হিন্দু-মুসলিম মিথ ইতিহাসকে তুলে ধরলেন তার কবিতায়। পাশাপাশি আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের ব্যবহার ঘটান। তাই তার কবিতা হয়ে ওঠে বলিষ্ঠ এবং সমৃদ্ধ যাকে বলে সাবলাইম। এ যেন গণতান্ত্রিক ও গণমুখী ভাবনার নির্যাস। আধুনিকতার পূর্ণ সোপান নজরুল যুগে ঘটে।

নজরুলের প্রয়ানের পর, কল্লোল যুগের শুরু বা তিরিশের কবিরা স্বতন্ত্র ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছেন। আধুনিকতার জোয়ারে স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাস, অস্থিরতা, হতাশা, নৈরাশ্য, নৈঃসঙ্গ প্রভৃতি বিষয় উঠে আসে। জীবনানন্দ দাশ হয়ে ওঠেন বাংলা কবিতার সম্রাট‌। ভিন্ন মাত্রা দেখা যায় চিত্রকল্প ও উপমায়। তিনি ঈশ্বর ভাবনায় নিরব থেকে সম্পূর্ণরূপে ইহলৌকিক কবিতা লিখেন।
 
"লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে 
বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;" 
(অঘ্রাণের প্রান্তরে , জীবনানন্দ দাশ)।

সাহিত্যে মোড় ঘুরানো কবিরা হলেন মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ আর আল-মাহমুদ প্রভৃতি। বাঁক সৃষ্টির পেছনে কাজ করে কবির শক্তি ও কল্পনা প্রতিভার দূরদৃষ্টি। সৃজনক্ষমতা, মৌলিকত্ব ও বাস্তব নিয়োগ প্রক্রিয়া এভাবেই নতুন দিগন্তের কবিতা পাঠকদের গ্রহণযোগ্য করে তুলে।

সময় এগোয়, বদলে যায় সাহিত্য; পুরোনো চিন্তার জরাজীর্ণ কলেবর মুক্ত হয়ে গড়ে উঠে নতুন ধারার ইস্তেহার। বস্তুতঃ, বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম সময়োপযোগী ও পূর্ণাঙ্গ কোনো সাহিত্য ধারার ইস্তেহার রচিত হয়। যার হাতে রচিত হয় এই ইশতেহার তিনি এমন এক কবি যিনি ইতিমধ্যেই বাংলা কাব্যসাহিত্যে স্মরণীয় অবদান রেখে চলেছেন। উনার তেজস্বীতায় বাংলা সাহিত্যে খুলেছে নব দ্বার বাতিল সাহিত্যের বিরুদ্ধে। তিনি হলেন কবি ফাহিম ফিরোজ।

বাংলা কাব্য সাহিত্যে এখন নতুন ধারার জয় জয়ধ্বনি। এ ধারায় কোথাও কোথাও ধারাবাহিকতা নেই আছে একটি ছেদের পর আরেকটি ছেদ, যার মধ্যে নেই কোন পরম্পরায় তাৎপর্য, নেই কোন ক্রমিক প্রগতির ইঙ্গিত। কোন কিছুর সাধারণ সূত্র দিয়ে একে সূত্রবদ্ধ করা বোকামি। হেগেলের বিশ্ববীক্ষাও যেমন ভ্রান্ত, তেমনই মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মিশেল ফুকো তো পরিষ্কার সিদ্ধান্ত টেনে দিয়েছেন_ মার্কসবাদ বিংশ শতকে অচল। একবিংশ শতকে তো কথাই নেই। পৃথিবীর সত্যকে জানা যাবে না এই ভ্রান্তিতে নিবিষ্ট হয়ে থাকলে। তাই একবিংশে নতুন ধারাই একমাত্র শ্রেয়।

জীবন ও শিল্পের যে দাম্ভিকতা তার মাত্রায় ভর করে পরাবাস্তবতার মিশেল বা বহুমুখী সমাপ্তির খোঁজে দৃঢ় অগ্রসর এই নতুন ধারার কাব্য। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দায় তাই পাঠকের উপরই। এই জন্যই নতুন ধারায় পাঠ পান্তাভাত নয়। মনস্তাত্ত্বিক জাগরণের অন্যতম উপায়ও বটে। প্রমিতের সাথে লোকজ ভাষার অভেদ বন্ধনে পাঠক সমাজের কাছে আকর্ষণীয় নিস্পৃহ ভঙ্গিমায় উপস্থাপনের মাধ্যমে বাস্তবতার কঠিন অনুষঙ্গগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই কবিগণ।

"ভেতরে গরম। 
বলাও  যায়না, কারো  কাছে। পাছে 
মিথিলা ননদ ঘুরঘুর পদান্তর, ছায়ান্তর।
টের পেলে 
হয়ে যাবে দাপুটে মাইক!"
(মরিচ গীতিকা, ফাহিম ফিরোজ)।

একথা অনস্বীকার্য যে, সাহিত্য সমাজ বিকাশের কোন শাশ্বত পদ্ধতি পন্থা থাকে না । সাহিত্য সমাজে একই সাথে বিভিন্ন অস্তিত্বের স্রোত চলে, এর মধ্যে থেকে প্রধান অপ্রধান চিহ্নিত করে মীমাংসায় পৌঁছানো যায় না। কেননা, আজ যেটা প্রধান কাল সেটা অপ্রধান হয়ে যেতে পারে, পরশুতে সেই অপ্রধানের মধ্যে আবার একটি প্রধান আবির্ভূত হতে পারে।  নতুনধারার কাছে তাই কাব্য সাহিত্য হলো বহুবিধ নির্মাণ এবং বিনির্মাণের অবিরাম যুদ্ধ ধারা। 

"উত্তম--সবুজ আমরা - কার লিগা করি অপেক্ষা? 
    আরেকদফা মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে;
    পলিথিন ঠোঙ্গা চা কফির কাপ জুস ও 
পানি'র বোতল ড্রেন অভিমুখী করতিছে যাত্রা-----
পাবলিকের চুল হালায় 
নাকে তেল দিয়া ঘুমায় ঢাকা ওয়াশা।"
(বহুরূপী আগুন, কবির আহাম্মদ রুমী)।

"লাতি চোর, পাতি চোর, সোনার মোহর চোর,
পাগাড় পুকুর হয়, পুকুর হয় দিঘি। 
অমাবস্যার কঠিন কালা রাইতে কৃষ্ণবিবরও কৃত্রিম আলোয় করে ঝিকিমিকি।"
(কলিকালের কপাইল্যা, আমিন সাদিক)।

নিগূঢ় সত্যের অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নতুন ধারার কাব্যগৃহে। গ্রামীণ চিরাচরিত যে সম্বন্ধবাচক শব্দ যা এতকাল বাংলা সাহিত্যে ছিল অনুপস্থিত তা আজ সেই শূণ্যস্থান পূরণ করেছে নতুন ধারার কবিরা। কবিতার শরীর গড়ে উঠেছে নিপুণ বাচনভঙ্গিমা আর শৈল্পিক দক্ষতার অমোঘ বন্ধনে।

"না, যায়দিন নয়, দাদাজান! আসেদিনই ভালা।
কোরানে কয়।
সরকারও তো কয়, কয় না?...
হাছা, হাছা_ মাথা আলগাইয়া কইতাছে যে রাষ্ট্র, পঞ্চাশ বছইরা বাংলাদেশ।"
(দিন, ফারুক আফিনদী)।

মনোজগতের গহীনে লুকানো সত্ত্বা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে কানে কানে বলে যায় শেকড়ের কথা, মাটির কথা, বিশুদ্ধ গাঁয়ের কথা। এসব ভুলেনি নতুন ধারার কাব্যিকরা। সেই সাথে ভুলেনি বর্তমান উত্তরাধুনিক জীবনধারণেরও কথা। নতুন ধারার কবিগণ বাস্তব ও অলৌকিকতায় বিশ্বাসী। কবিতার কাঠামো শৈথিল্যে প্রবাহমান।

"ঘটকার মাথা এইবার কাটা যাবে। 
খাইবে ঝাড়ুর প্রেম। 
এসব হুনছি বাতাসে, হাসছে 
পথ,পন্থের আংগুল। বড় কিছু গিলে, 
বাজাইরা লাকির কানা রাইতে, 
দিছেরে গুইজা  সরল নজুর! 
ফতুর। ভাগ্যের ফল ঘুমটাহীন। কাক।" 
(বাজাইরা খন্ড, ফাহিম ফিরোজ)।

কবিতার দেহে এবার নতুন পোশাকের সমৃদ্ধ আবরণ। হওয়া নির্মল। গ্রামীণ চিরাচরিত কোল ঘেঁষে শহুরে তান্ডবে গড়া কবিতার নতুনা চিত্রপট। যা ছিল অনুপস্থিত আজ তা দৃশ্যমান। ঘনিষ্ঠজনদের ঘনিষ্ঠতা, রূপ, রস, উপমা, অলংকারের কাব্যিকতা প্রতীয়মান। নতুন ধারায় আছে বহুভাষীকতা, আছে শব্দ নিয়ে খেলার নিঁখুততা। যা কি না আধুনিক কবিদের মধ্যে কমই চোখে পড়ে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রগতি আর দর্শনের নির্ভরতম মাধ্যম এই নতুন ধারার কাব্য।

নতুন ধারায় প্রভাবিত হয়ে নিয়মিত লিখছেন এমন আরো কয়েকজন কবির কবিতার চুম্বক অংশ তুলে ধরছি  যাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক কবিগণও রয়েছেন :-

"ইলিশের ঝাঁকের লাহান উজান ঠেইল‍্যা 
মনের গাঙ্গে ঢুইক‍্যা পড়ে স্মৃতির ঝাঁক 
বৃষ্টিস্নাত দিনমানে আবেগের বারিধারায় 
খুইজ‍্যা পাই এক নতুন জীবনের ঠিহানা"।
(বাইষ‍্যার দিনে, উৎপলেন্দু পাল)।

"আমাগো আসমান বেইচা দিছি আধুনিকতার দামে বিষকণার কাছে,
নিঃশ্বাস পথে লাগাইছি হোফা, খুঁজে নিছি ডিব্বা ভর্তি অক্সিজেন। 
কাটছি গাছ, বন -জঙ্গল ধুয়েমুছে বানাইছি রংমহল।"।   (বৈপরীত্য, রাবেয়া হ্যাপী)

"নয়া বল্লম হাতে, নি:শ্বাসে নি:শ্বাসে
কোপায়, কাঁপায় পয়োধর ফুল।
তাইফুন আইলেই উইপোকার উড়োউড়ি
আখের খোঁজে কীটের দূর্যোধন।"
(চিল উপাখ্যান, সাইদ খান)।

"জীবনের হিসেব সাজায় উকিল বয়াতি 
কখনও বনিবনা সময়ের গল্প লইয়া 
 জ্যামিতিক মনছবি আঁকে আঙ্গুরি বিবি। 
দুঃসময়ের সরলিকরণ কইরা
 কতোটাই বা এগুনো  যায় --!!"
(নীল ছোঁয়া মন, শাহানারা ঝরনা)।

"বাগে, যঅ্যান এক অটোমেটিক গ্রিনহাউস।
হের লগে মাঠের পর মাঠ ভাঙে, রাতের পর
রাত জাগে, দোয়া মাগে মান্নত করে ফকির।"
(বশির শেখ ম্যাঘ ধরততে চায়, কিংকর দাস)

আধুনিকাতায় পিকাসোর ছবি আজ ফ্যাকাসে। কারণ, নতুন ধারার জোয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধারার কাব্যসাহিত্য হলো অনিঃশেষভাবে অনির্ণেয়তার সন্ধানী। নতুন ধারা দুর্বার গতিতে পালাতে চায় অতীতমুখীনতা থেকে। কেননা ভবিষ্যৎ অভিমুখেই তার ছুটে চলা। আর এই পথের মহানায়ক কবি ফাহিম ফিরোজ যাঁর নাম বাংলা কাব্যসাহিত্যে স্বর্ণাক্ষরিত হয়ে থাকবে যুগের পর যুগ।

3 মন্তব্যসমূহ

  1. আধুনিকতা ফিকে হয়ে গেছে। সময়ের নিজস্ব নিয়মে এলো নতুনধারা। জয়তু নতুনধারা।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে নতুনধারার মর্মলিপি। কিছু জেনে সমৃদ্ধ হলাম

    উত্তরমুছুন
  3. এভাবেই কালের খেয়ায় জেগে উঠবে নতুন দিন নতুন গান, সুচিত হবে নতুন ধারা...

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন