ফারুক আফিনদীর দ্য

তুনধারা, কেন কিভাবে


 

চলতি চিন্তা (বিষয়), স্বয়ংশাসিত চিন্তনভঙ্গি বা বলবার শৈলীর ভেতর দিয়ে নির্মাণ লাভ করাই সাহিত্যের স্বভাব চলমাফিক এর বিস্তৃতির কাজ বিদ্যমান পথ প্রান্তরে, যাকে বলা যেতে পারে গড়সাহিত্য কিন্তু পথ যে সব জায়গায় সোজা চলে না এটা সে বুঝতে শেখে, যখন মোড়ে এসে একটু থামতে হয় বদলে যাওয়া দেশ এবং বদলপ্রবণ অর্থনীতি জনগণের মাঝে এর বিলিপ্রথা, ব্যক্তিসবের বদলে যাওয়া নতুন যাপনপ্রণালী- এসব খাড়া হয়ে থাকে মোড়ে, শাসন করে চলে শিল্পের কথা সুরকে এইখানে এসে বদলে যায় সে, সময় সময়ের মেজাজ মাফিক চলতে হয়, খুঁজে নিতে হয় নতুন এক পথ সেই তো সাহিত্যের পথ সেতো চোখলোভা নৈসর্গিক কোনো বদ্ধ হৃদ নয় চলার এই নিয়ম মেনে আধুনিকতাকে আজ মোকাবেলা করতে হচ্ছে নতুন সৌন্দর্যের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে সেই সৌন্দর্য্য- ‘নতুনধারা

নতুনধারা ব্যক্তি নয়, ব্যাপকভাবে ব্যক্তিদলের নিবিড় জীবনঘনিষ্ট ব্যক্তি সেখানে সাড়ামাত্র অনুঘটক সাহিত্যে অনুঘটনের ব্যাপার একেবারেই নতুন নয় কিন্তু সেটা অনেকটাই সরল, সুসমঞ্জস সংযত গোছের এই চিরন্তনতা সবসময় সুগন্ধী রূপে এসে হাজির হয় না এর ঘেয়েমির একটা গন্ধও থাকে সময় সে গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে চায় সেজন্য বুঝি সে তৈরি করে নিচ্ছে নতুনধারা

নতুনধারায় শিল্পক্রিয়া-বিক্রিয়ার মধ্যে ব্যক্তির একক অস্তিত্বের বদলে সামাজিক গঠন-সংগঠনের রূপে স্বক্রিয় সমাবেশ ঘটে এভাবে কাব্যমূল থেকে বহুকাব্য ছড়িয়ে পড়ে, গোলাপ যেমন, অথবা রক্তজবা, অথবা টর্চ লাইট, হ্যাজাক আরো ঘরোয়া করে বললে ঝর্নার কল জলের ক্রিয়াটা ভেবে নিক শতজন, সহস্রজন, কোটি মানুষ নতুনধারা সেই ক্রিয়াটা নিয়ে তীক্ষ্ণভাবে কাজ করে চলেছে

নতুনধারা কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত কবিতা কবি ফাহিম ফিরোজের হাতধরে মোড় ঘোরানো ধারার কবিতার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রমিত আঞ্চলিক ভাষার মিলন নতুনধারা বলতে চায়, গণমানুষের মুখের ভাষাই মূল ভাষা ভাষায় কথা বলাতে পারলেই হৃদয়ের দিক থেকে ইটসুড়কিতলার মানুষগুলোকে কাঠখড়তলার মানুষগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসা যায় এবং এটা সমৃদ্ধির সোপান তৈরির জন্য অনিবার্য হাজার বছরের বাংলা কবিতায় অনুপস্থিত সামাজিক সম্বন্ধের প্রভাব আমাদের নতুনভাবে জীবনঘনিষ্টতা এবং শেকড়ের অন্বেষার পথ দেখাবে নতুনধারা, এটা ব্রতসম

ভাষাগত দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছাড়াও নতুনধারার চিন্তনভিত্তিক (আদর্শ) কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে সম্পদ, রাজনীতি, ধর্মরাগ-ধর্মবিরাগ ইত্যাদি বিষয়ে প্রচল পুরানা আধুনিকতা থেকে নতুনতর করে বিবেচনা করছে নতুনধারা

পুঁজি অপুঁজির যে বিরোধ, নতুনধারা সেটা ভেঙে সন্ধি স্থাপনে আগ্রহী সংঘাতঘন বিশ্বে শান্তির ফাগুনি বাতাস বইয়ে দিতে এটাই সহজ পথ মনে করে নতুনধারা

আর, খুব সহজভাবে বলা যেতে পারে- স্বীকৃত শিক্ষিত ভদ্রজনদের ভাষার সঙ্গে প্রান্ত তথা অন্তঃশ্রেণি তথা মাটির ভাষার মিলন ঘটিয়ে একটি কার্যকরমানুষসমাজ তৈরি করাই নতুনধারার লক্ষ্য শ্রেষ্ঠাংশের লক্ষণ, যার মণিরূপ হলো সম্বন্ধ বা আত্মীয়বাচক শব্দের উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ

 

ভাষা, বিষয়

[সকিনা বু, সুন্দর আলী মামু, বন্ধু ভুবন শেখ প্রমুখকে]

.

শুধু কথ্য ভাষায় লেখা নতুনধারার সাহিত্য নয় নতুনধারার কবিতার প্রধান মুখবৈশিষ্ট্য লেখ্য/প্রমিত কথ্য/আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ একে মিশ্রণ বললেই চলবে না বরং বলা হবেমিলন মিলন যেমন আনন্দ-স্বস্তি-শান্তিকর তেমনই নতুন ভাষার নান্দনিক কাজ মিলনসৌন্দর্যের মধ্যদিয়ে কেন্দ্রীয় গোষ্ঠীর মনোকাঠামোতে প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম, সাহজ্য (সহজের ভাব-স্বভাব), জীবনাচার একটা দাগ কেটে যাক-নতুনধারা সেটা দেখতে চায়

নতুন ভাষা কেবল কবিতার মাধ্যম হিসেবেই দেখা দেয় না, মিলনটা একটা শিল্পরূপে হাজির হয় আর অবশ্যই, যতটা সহজ মনে করা হবে জনভাষা তৈরি, ততটা সহজ-সাবলীল নয়, একদমই নয়

নতুনধারার সৌন্দর্যটা এখানেই শক্তিটা এখানেই শিল্পটাও

.

নতুনধারার ভাষার মিশ্রণটা হতে হয় এমন যে তা লেখ্য নাকি কথ্য তা চটজলদি নির্ণয় করতে পারবে না মন এই ভাষার ক্ষেত্রে কানকে সবচে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় কানে যদি কথ্যের টান লাগে তবে সেটা কথ্যই নতুনধারার ভাষা লেখ্য নয় কথ্য নয়, হতে হয় মধ্যবর্তী একটা প্রাণভাষা এখানে কেন্দ্র প্রান্তের ভাগটা থাকবে সমান

.

শুধু কথ্য/আঞ্চলিক কিংবা ১০ লাইন কথ্য/আঞ্চলিক লেখার পর ১০ লাইন প্রমিত- নতুনধারা নয় প্রবণতা নতুনধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সাহিত্যের দুর্বৃত্তরা সুযোগ নেবে

.

নতুনধারার ভাষায় প্রমিত কথ্য/আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণের মধ্যে স্পষ্ট কোনো বিভেদ রেখা ফুটে উঠলে চলব না

সেটা বুঝে নিতে যাওয়া যাক তিনটি নদীর কাছে নারায়ণগঞ্জের কাছে মেঘনা শীতলক্ষ্যার কিংবা কুমিল্লার হোমনার শ্রীমদ্দিতে মেঘনা তিতাসের মিলনস্থলে দুই নদীর পানি সাদা/ঘোলা কালো রঙে নিজেদের আলাদা করে রাখে সেখানে রয়েছে স্পষ্ট এক রেখা কিন্তু দূর থেকে জল জলই, মনে হয় কুলকুল লহরি তুলে চলেছে সে কণ্ঠ এক তবু জল দেখে মেঘনাকে মেঘনা বলে, শীতলক্ষ্যাকে শীতলক্ষ্যা বলে চেনার উপায়টি হারায় না

.

নতুনধারার লেখকদের কারো কারো মধ্যে এমন ধারণা জন্মেছে যে ধারার কবিতা হবে শুধু এতিহ্য, গ্রামীণ জনপদের দুঃখগাথা, লোকজীবনাচার কিন্তু নতুনধারা উড়োজাহাজেও উড়বে

কেউ কেউ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে চর্চিত খিস্তিখেউড় বা রসাল বিষয়কেই নতুনধারা মনে করছেন আমাদের মনে রাখা দরকার, অশ্লীলতা মানেই নগ্নতা নয়, অশ্রাব্য নয় সাহিত্যে অশ্লীলতাও একটা জামা পরে থাকে, সেটা শিল্পের জামা নগ্ন বা নগ্নিকাকে শিল্পের জামাটা পরিয়ে দিলেই সেটা ন্যুড, নচেত নগ্নপনা

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন