তাপস গুপ্তের ধারাবাহিক
পোস্টমডার্ন কবিতা: কিছু কথা
(২য় পর্ব)
পোস্টমডার্ন একটি নির্দিষ্ট সময়ের আর্থ সামাজিক পরিকাঠামোর সাংস্কৃতিক পরিভাষা রূপে বহুল ব্যবহারের গ্রহণ যোগ্যতা পেলেও এটি বুদ্ধিজীবি মহলেও সংশয়াতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। এমন কি, নোয়াম চমস্কি ব্যাঙ্গের সুরে বলেন, পোস্টমডার্ন দার্শনিক দের লেখা তাঁকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু তিনি তার অর্থ কিছুই বুঝতে পারেন না।
কিন্তু লক্ষনীয় যে, এইসব বৌদ্ধিক মেধার আক্রমণ সামলেও পোস্টমডার্ন দর্শন ইউরোপ ফ্রান্স হয়ে মার্কিন দেশের চিন্তা জগতে তুমুল প্রভাব ফেলেছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে এই চিন্তাদর্শন মার্কিন দেশে পাড়ি দিলেও ১৯৬০ এর পর থেকে তার তরঙ্গ স্রোতে আমেরিকার সাহিত্য সম্ভার ভরে উঠতে শুরু করে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জন্ম সূত্রে ইজিপসিয়ান মার্কিন বুদ্ধিজীবি - প্রাবন্ধিক ইহাব হাসান। কান্ট, নিৎসে, হেগেল, মার্ক্স, সর্ত্র, হাইডেগার, হুসার্ল, বার্থ, দেরিদা, লাঁকা, কর্বুশিয়োর, লিয়োতার (এখানে সবাই পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদ না হলেও, তাঁদের উল্লেখ্য ভূমিকা রয়েছে... আমরা পরে সুযোগ মত ধরে ধরে আলোচনায় আনবো প্রতি জনকেই) ইত্যাদির প্রচলিত অধিবিদ্যার প্রোথিত বিশ্বাসের ফাঁক ফোকর ধরে যে সূক্ষ্ম শাব্দিক আলোচনার অভিযাত্রা তা মার্কিন সাহিত্য ক্ষেত্রে এমনকি বাংলার সাহিত্য ভাবনার আকাশেও নতুন রং এনেছিল।
মনে রাখতে হবে, অধিবিদ্যার ফাঁক খুঁজে তাকে সমালোচনায় বিদ্ধ করা মানেই তাকে খারিজ করা পোস্টমডার্ন ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য নয়; এই মেটা ফিজিক্স আমাদের প্রাচীন ইতিহাস সমন্বিত পরম্পরা, যুক্তি তর্কের বুননে তাকে নিয়েই উত্তর আধুনিকের পথ চলা। অর্থাৎ নির্মাণের অবিনির্মান। বার্থ বললেন, ইতিহাসকে যখন অস্বীকার করা হয়, তখনই তা অভ্রান্ত ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিয়োতার বললেন, পোস্টমডার্নিজম মেটান্যারেটিভ গ্রহণ করে না। ইতিহাস বা ট্র্যাডিশনে ফিরে যাওয়া নয়, কোনো সু পরিকল্পিত চিরস্থায়ী আইডেন্টিটি নয়, থাক শুধু স্বপ্ন। তাঁর পোস্টমডার্ন চিন্তা ভাবনার ওপর লিখিত বই গুলি মার্কিন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লিয়োতারের সঙ্গে পূর্বেই পরিচয় ছিল ইহাব হাসানের, ফলে এই চিন্তা দর্শন ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নেয় নি আমেরিকায়।
মেটান্যারেটিভ মান্যতা দেয় তার সর্বজনীন সত্য কে, সেই সত্য উন্নয়নের গল্প শোনায়, সমৃদ্ধির বিভিন্ন স্তরের প্রকল্পিত রূপ - রঙের রূপকথা শোনায় এবং তা কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন। যে বা যাঁরা এটি বিশ্বাস করেন তিনি বা তাঁরা হলেন আধুনিক অর্থাৎ মডার্ন। আবার কিছু মানুষ একটু অন্য রকম ভাবেন। তাঁদের কাছে এটি কেবল স্বপ্ন, ভবিষ্যতের সুখ কল্পিত এক ছবি মাত্র। এই দল পোস্টমডার্ন বা উত্তর আধুনিক। সুতরাং একই সমাজ সময় বন্ধনীর মধ্যে দুই বিপ্রতীপ দর্শনের সহ অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। আরও সরলী করণে বলা যায় পোস্টমডার্ন বর্তমান চলমান সময় বা মুহূর্ত কে যেমন ধরে রাখবে তেমনি "স্বপ্ন সুন্দর" ঐতিহ্যকেও মুহূর্ত সজ্জায় জায়গা দেবে। এই জায়গা পোস্টমডার্ন তাকে দিচ্ছে তার ঐতিহ্যময় ইতিহাসের অসম্পূর্ণতা জেনে বুঝেই। আলেকজান্ডার জেংকস তাই বললেন, নতুন শহরের মধ্যে পুরোনো শহর কে রাখা মানেই ইতিহাসকে সংরক্ষণ নয়, ট্র্যাডিশনে ফিরে যাওয়া নয়, কোনো চিরস্থায়ী আইডেন্টিটি নয় -- শুধু স্বপ্ন।
উত্তর আধুনিকতায় যেমন চিরস্থায়ী আইডেন্টিটি কিছু থাকবে না, তেমনি থাকবে না সুনির্দিষ্ট কোনো মেথড বা প্রকল্প। ডোনাল্ড জাস্টিস এর একটি কবিতা পাঠে যাওয়ার আগে আমরা কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে দেখে নেব কবিতা তৈরির নিয়মভাঙা এক ছক। ডোনাল্ড জাস্টিস তাঁর এক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানালেন, সে কবিতা নিয়ে পড়লেও নিজে কবিতা লিখতে পারে না। জাস্টিস ছাত্র টিকে জিজ্ঞেস করলেন, সে ইংরেজি ছাড়া ফ্রেঞ্চ বা ল্যাটিন জানে কিনা। ছেলেটি জানে না। জাস্টিস তাকে ফ্রেঞ্চ ও ল্যাটিনের বেশ কিছু কবিতা দিলেন অনুবাদ করার জন্য। ছেলেটি কয়েকদিন পরে প্রায় কুড়িটি কবিতা নিয়ে এলো অনুবাদ করে। জাস্টিস দেখলেন (অবশ্যই পড়ে) তার মধ্যে সাত আটটি কবিতা বেশ ভালো মানের হয়েছে। এই পরিকল্পিত পথে না হাঁটার যে পদ্ধতি এটি তাঁর কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রেও দেখা যায়…
জাস্টিসের On the death of friends in childhood কবিতা টির অনুবাদে নাম দিয়েছি "শৈশব বন্ধুদের মৃত্যুতে"....
শৈশব বন্ধুদের মৃত্যু তে
শ্মশ্রু শোভিত হয়েও
আমাদের দেখা হবে না স্বর্গের বাগানে
এমনকি দেখা হবে না সূর্য শাসিত
বিকচ জাহান্নামের ন্যাড়া মাথায়
বৃত্ত বলয়ের চক্রাকার নির্মাণ সম্ভাব্যতায়
যদিও কোথাও গোধূলি অথবা ঊষার
মায়া আলোয় শূন্য ত্যক্ত স্কুলের আঙিনায়
মিলিত হাতে খেলা শুরু হয়
নাম ভুলে যাওয়া খেলা গুলোয়
এসো প্রকাশিত হও উদার স্মৃতি
ছায়াময় প্রত্নছায়ায়।
ক্রমশ:-
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন