সংযুক্তা পাল (ধারাবাহিক প্রবন্ধ)
রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার
আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
পর্ব-৯
খুব ছোট ছোট সাধারণ বিষয় অথচ তার সঙ্গে বৃহত্তর জগতে বৈষম্যের এক ইতিহাসের ধারাবিবরণী লেখা হয়ে যায় তারই এক উদাহরণ বর্ণবৈষম্য। পূর্বে আলোচ্য 'মেজাজ' কবিতায় এই ভাবনার ধারাভাষ্য পাওয়া যায় আবার 'ফুল ফুটুক না ফুটুক' কবিতাতেও একটি 'কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে' র প্রসঙ্গকে কবি ব্যবহার করেছেন খুব সচেতনভাবেই যেখানে ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্বে মেয়েদের পণ্য হিসেবে মূল্য ধার্য করা হয় রং বা চামড়ার নিরিখে।
'লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মতো/আকাশটাকে মাথায় নিয়ে/এ -গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে/রেলিঙে বুক চেপে ধরে/এই সব সাত - পাঁচ ভাবছিল–/ঠিক সেই সময়/চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল/আ মরণ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি!/তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।'('ফুল ফুটুক না ফুটুক'/'ফুল ফুটুক')
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী বিবাহের প্রতীক প্রজাপতি আর বিবাহের স্বপ্ন আঁকা কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ের দু চোখ–অদ্ভুত আয়রনি; এই বিপ্রতীপতায় দাঁড়িয়ে মানবীয় যে দুঃখ-বিষাদ-হতাশ্বাস আমরা লক্ষ্য করি তার পেছনে কি বৃহত্তর কোনো সামাজিক প্রশ্ন নেই?
'শান বাঁধানো ফুটপাথে/পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছে'র হাসির সঙ্গে ওদের পরিচয় আছে, কলকাতার ব্ল্যাকআউট বা হরবোলা ছেলে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও আইবুড়ো মেয়েদের ওরা বড়োই চেনে। আর, প্রতিদিনের আকাশের রং খেলার ছাপছোপ থেকে তো অতি বড়ো দুর্ভাগা ও বঞ্চিত নয়,তাই ওরা সহজেই বুঝে যায় বিকেলের রোদের সঙ্গে হলদে চিঠির যোগ। আইবুড়ো মেয়ে,'ঠিক সেই সময় এক প্রজাপতি এসে' তার গায়ে বসে,–এ তো তাদেরই প্রতিবেশিনীর কথা অথবা তাদেরই ঘরের কথা। 'দড়াম' করে দরজা বন্ধ হবার শব্দে স্তব্ধতা নেমে আসে।'
সেই স্তব্ধতাকে, জীবনের ছন্দপতনকে 'স্বর্গীয়' হিসেবে দেখা তাঁর মত কবির পক্ষেই সম্ভব। নারী কে 'চরিত্র' হিসেবে তিনি যেন তাঁর কবিতায় আবিস্কার করেন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। মনস্তাত্বিকতার গভীর আলো–আঁধারির মাঝে ডুব দিয়ে এক মগ্ন সত্যকে তুলে আনেন পাঠকের সামনে–
'শূন্য ঘর,/পিঁড়ি পাতা,/পাথরে গরম ভাত,/কাঁচালঙ্কা, গন্ধরাজ লেবু /মেঝেতে শোয়ানো হাতপাখা/বাইরে শব্দ কাঁচের চুড়ির–/ছুটে গিয়ে দেখি/অবিকল তার মতো/অথচ সে নয়/অন্ত্যমিল, অনুপ্রাস,/উৎপ্রেক্ষা,যমক/কিছু নেই।/সাদা সিঁথি, মোটা থানে তাকে /দেখাচ্ছে স্বর্গীয়।'('স্বর্গীয়'/'ধর্মের কল')
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলছেন –''তীব্র আবেগময় রাজনীতি আর মায়াকভস্কির ভাষায়' আবেগের গলায় পা রেখে' চূড়ান্ত আবেগবহুল কাব্যচর্চা ছাড়া –সুভাষদা আর কিছুই করেননি। শুধু কবিতা লিখে সংসার চলবে কি করে এ-ভাবনা ছিল। তাই যথেষ্ট গদ্যও লিখেছেন। এমনকী উপন্যাস। কিন্তু যাই লিখুন, এমনকী খবরের কাগজের কলমেও দেখা যায়, লুপ্ত বেড়ালের হাসি নিয়ে সবার শেষে বসে আছে এক দুষ্টু লিরিসিস্ট। ... লিরিক কবিরা, বস্তুত, অনেকেই নারীলালিত।"
সুভাষ কতটা লিরিসিস্ট সে নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও রিয়ালিস্টিক তো বটেই এবং রিয়ালিস্টিক কবিরাও বিশেষত সুভাষেরও জীবনের বহু ক্ষেত্র জুড়েই নারী মানস প্রভাব বিস্তার করেছিল নানাভাবে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ 'জয়মনি স্থির হও কবিতাটি।
'মাকে মনে পড়ে।/মা আমাকে বলতেন বাঁদর।/কিন্তু তবু যখনই বৃষ্টিতে ঝড়ে চমকাত বিদ্যুৎ/পাশে এসে মা বলতেন হেঁকে: জয়মনি! স্থির হও।/যে- মন্ত্রে ঘেঁষে না কাছে ভূত/সে-মন্ত্র তো মার কাছেই শেখা।'
'জয়মনি স্থির হও' তাঁর এমন একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি যা তিনি মা'র কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
"আকাশ কালো করা মেঘে যখন চমকে চমকে উঠত বিদ্যুৎ, তালগাছের মাথাগুলো দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইত বৈশাখের ঝড়–কেমন যেন আর্ত গলায় মা চেঁচিয়ে বলতেন, 'জয়মনি স্থির হও', 'জয়মনি স্থির হও'। শুনে আমাদের গা ছমছম করত।"
বিপদের সম্ভাবনায় মায়ের এই আশ্বাসবানীই দীর্ঘ জীবনের সংগ্রামে কবির প্রেরণা হয়ে থেকেছে, যার প্রমাণ তাঁর বক্তব্য–
"খালি মেঝেয় শোওয়া, রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা, নুন তেল লঙ্কা মেখে শুধু ভাত খাওয়া এ সবই মার কাছে শিখেছি। ফলে, জীবনে কষ্টকে কখনও কষ্ট বলে মনে হয়নি।"
যে নারী প্রেরণার আধার হিসেবে কাজ করে সেই ভাবনা কেবল প্রেয়সী বা প্রিয়তমাকেন্দ্রিকই–সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসা এই বদ্ধভূমিকে খোলসের মত সরিয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কবিতা রচনার প্রেরণা হিসেবে কখনো মা, কখনো স্ত্রী আবার কখনো 'সালেমনের মা'-এ দের মত নেহাত চোখে দেখা কোন চরিত্র কিংবা মিছিলে হেঁটে বেড়ানো এক সত্যের শাণিত মুখ অনায়াস স্থান পরিবর্তন করেছে নিজেদের মধ্যে।
সুভাষ তাঁর নিজের একটি কবিতার বইএর মলাটের পরের পাতায় লাল-নীল কালিতে লিখেছিলেন–
'যিনি আমাকে গদ্যের হাত
ছাড়িয়ে
পদ্যের আসরে
একদিন উঠিয়ে এনেছিলেন
অনেক আদরের সেই
অনুদিকে'
ব্যক্তি সুভাষ থেকে গদ্যকার সুভাষ অতঃপর কবি সুভাষ হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রেরণা ছিলেন সুভাষের 'অনু দি'। গদ্য সাহিত্য থেকে কবিতার দিকে এই যাত্রাপথে 'অনুদি' র ভূমিকা তিনি নিজেই উপলব্ধি করেছেন–
'মুশকিল বাধাল অনুদি। গদ্য লিখে লেখক হয়েছিস, তোকে আরেক ধাপ উপরে উঠতে হবে। তোকে কবি হতে হবে।'
মরেছে। গদ্য লিখেও ছাড়ান নেই? এরপর পদ্য লিখতে হবে?'
ক্রমশ:-
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন