হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা 

অন্যমনস্কতার রঙ


কালেভদ্রে ভোরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেদিন ভোরকে আয়নার মতো মনে হয়। আমার শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত ছায়া। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলো লাগাই। ভোরের সঙ্গে মাখামাখি শেষ হলে আমি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যাই। অন্যমনস্কতার রঙ মনে হয় ধূসর। আলোর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে এইমাত্র যেন মাঠে সন্ধ্যে নেমে এলো। তবুও আলোর কাছাকাছি এলে শরীর জুড়ে ছায়ারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘুরে দেখার প্রয়োজন হয় না। শুধু ধূসরতার বৃত্তে ডুবে যেতে যেতে মনে হয় ভোরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।



ছায়াছন্ন বিকেলের মনবিতান 


দুপুরে জানলায় এলেই দেখা যায়। সামনে একহাত মতো জমি। তারপর বাচ্চাদের নিয়ে অনায়াসে ঘুরপাক খাওয়া যাবে এমন একটা রাস্তা পার হয়ে জানলায় ধরা দুটি হাত। অনেক বিবাদের মিটমাট করে দেওয়া ঠাণ্ডা মাথার দুটি হাত। সকাল হওয়া থেকে সামান্য দূরে থাকা একটা অন্ধকারের বৃত্ত যেখান থেকে ভেঙে ভেঙে কিছু যন্ত্রণা রোজ হাতের দূরত্বে এসে থামে, বৃষ্টি এলে উড়ে যায় যাবতীয় গা গরম ------ এমন সহজ মেঘের সাবলীল যাত্রা সারা দুপুর জানলায় দাঁড়িয়ে দেখি এবং নিজের অজান্তেই কখন যেন ক্যানভাসের সারা শরীর জুড়ে এঁকে ফেলি ছায়াছন্ন বিকেলের মনবিতান। 



মনখারাপের দিন 


মনখারাপ হলেই আমি ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটা পোড়োবাড়ি দেখতে পাই। তার দোতলার জানালায় যেন আমার চেনা কেউ রাতের খাওয়া শেষ করে দূরে মাঠের দিকে চেয়ে বসে থাকে। তার কিছু মনে পড়ে না। কোনো শব্দ কানে গেলেই সে জানলা থেকে সরে গিয়ে পুরোনো জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। আর ঠিক তখনই ভোররাতের বৃষ্টির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। অনেক চেষ্টার পরেও কিছুতেই মনে করতে পারি না জীবনে আমার আদৌ কোনো বন্ধু ছিল কিনা। 



বিকেলের এক অদ্ভুত ভাঙা সেতু 


বই পড়তে পড়তে সন্ধ্যে নেমে এলে দেখতাম বিকেলের এক অদ্ভুত ভাঙা সেতু সন্ধ্যের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। চিনতে পারি, বহুবার বাবার বাড়ি গেছি এর ওপর দিয়ে। অথচ আজ পরিচয় দিতে গিয়ে পরিত্যক্ত শিশুর মতো তার সম্বন্ধে একটা বাক্য উচ্চারণ করতে গেলেও দমবন্ধ হয়ে আসে। বুঝতে পারি, দেশ জুড়ে শুধু অক্ষরের কোলাহল। চেনা দুয়ারে বৃষ্টি আসে নি কতদিন। 



নদীর গল্প 


নদীর গল্প বলতে বলতে ঘুম আসে না। গল্প যত এগোয় ক্লান্তি কোথায় যেন উবে যায়। হাঁটতে হাঁটতে রাগ আসে। পাশ থেকে কে যেন চুল টেনে দিয়ে চলে যায় ---- গলা উঁচু করেও নামিয়ে নিই। মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মাথা গরম হয়ে যায়। তবুও যখনই সামনের দিকে তাকাই দেখি গড়িয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারি রাগ অভিমান দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণা সব গলে জল হয়ে গেছে আর গড়াতে গড়াতে আমি কখন নদী। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন