রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার
আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সংযুক্তা পাল

পর্ব-৮


রবীন্দ্রপরবর্তী আধুনিক কবিদের মধ্যে এতটা মাটির কাছাকাছি কেউ নামেননি; বিশেষত সুভাষ তাঁর পূর্বসূরীদের তুলনায় অনেকখানিই মাটির জীবন কে পর্যবেক্ষণ করেছেন।এই মাটির মেয়ে-জীবনও তাঁর চোখ এড়ায়নি। শুধু ঘর বা বৃহত্তর রাষ্ট্রিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নয় তার বাইরে রাস্তা বা ফুটপাত , শহরের অলিগলি,গাঁ-গঞ্জের ধানক্ষেত সমস্তটাই চোখ এবং মনন দিয়ে শুষে নিয়েছেন তিনি,হয়তো সাংবাদিক ছিলেন বলেই; সেই দেখা-শোনাই গড়ে তুলেছে তাঁর অনুভবের জগৎ।

'ট্যাঁকে বাচ্চা নিয়ে/এ-বাড়ি ও-বাড়ি বাসন মাজে /রাত্তিরে গাছতলায় মাদুর বিছিয়ে শোয়/যে মেয়েকে স্বামী নেয়না/যমেরও অরুচি–/ছি ছি!/আবার তার ছেলে হবে!'

নারী থেকে মেয়েমানুষের নিতান্ত 'মেয়েছেলে' ব'নে যাওয়ার ইতিকথা রচিত হয় তখনই যখন তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়–এও এক জীবনদর্শন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনদর্শন কতগুলি দৃশ্যের সমন্বয়; সেই দৃশ্য সমূহের ব্যতিক্রমী সংযোজন নারী দর্শন–

"... বকুল গাছটা পেরিয়ে এসে হরিগোপালের হঠাৎ দুটো পুরনো দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল। অনেক দিন আগে একটা দুধের শিশু এই গাছতলায় তার মায়ের কাছে শুয়ে বড় হচ্ছিল। পাড়ার বুড়িরা বলত, মাথায় সিঁদুর থাকলেও ওটা নাকি ওর বৈধ ছেলে নয়।..."
তাঁর অধিকাংশ কবিতায় ফর্ম হিসেবে সংলাপধর্মিতা প্রযুক্ত।বিশ্বজীবন বা বিশ্বরাজনৈতিক প্রতিবেশকে তথাকথিত এক ঘরোয়া মেয়ের সংলাপের দ্বারা তুলে ধরেছেন। সমসাময়িক অনেক কবিই যেখানে মেয়েদের এই দৃঢ়চেতনা এবং জ্ঞান ও বোধ সম্বলিত রাজনৈতিক দর্শনে পুষ্ট মেধা ও মানসিকতার প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি,তাই নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের 'কালো অলুক্ষণে','পায়ে খুরঅলা' বউয়ের গর্ভে মেয়ে সন্তানের জন্ম হলে

'কী নাম দেব জান?/আফ্রিকা।/কালো মানুষেরা কী কান্ডই না করছে সেখানে।।'('মেজাজ'/'যত দূরেই যাই')
তাকে এই গুরুদায়িত্ব দেবার সাহস প্রদর্শনে শঙ্কা ও সংকোচ দুইই বোধ করেছেন সম্ভবত।
পূর্বপ্রতিকল্পে মেয়েমানুষকে 'মেয়েছেলে' ব'নে যেতে দেখেছি আমরা। 'মেজাজ' কবিতায় সেই মেয়েমানুষেরই শুধুমাত্র নারী নয় মানুষ হিসেবে উত্তরণ ঘটতে দেখলাম।একজন পুরুষের মতই তাকেও তার রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিবেশ নিয়ে চিন্তা করার স্বাধীনতা তার পরিপার্শ্ব না দিলেও কবি দিয়েছেন।
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় 'দেশ' পত্রিকার 'সুভাষ মুখোপাধ্যায়' সংখ্যা-য় একজায়গায় বলছেন–
"আটপৌরে সাধারণ চেনাশোনা প্রসঙ্গের এক অসাধারণ অচেনা মোচড় রয়েছে 'মেজাজ' এর অন্তিমে।
'আফ্রিকা'–এই নামটির ম্যাজিকে গেরস্থালির চেনা বর্ণবিদ্বেষের একদিন-প্রতিদিন হঠাৎ যেন আন্তর্জাতিকতার বৃহত্তর আকাশে উড়ান দিল এই কবিতায় "
প্রত্যক্ষভাবে এইসব জীবনের ছোঁয়াচ না পেলে এমন অনায়াস পঙক্তি নির্মিত হয়না।
'বাপ গিয়েছে স্বর্গে
দাদার লাশ 
মর্গে

ভালো চাস তো,যা এই বেলা
ধর গে 
            ঐ অমুককে–'
                           ('বোনটি')

'কাঠ কুড়োচ্ছি বনে,/ভাই রয়েছে রণে...' ('ফোঁটা')

কিংবা

'ভাই আমাকে নাই বা দেখুক/মারুক লাথি,ঝাঁটা/ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যমের দুয়ারে কাঁটা'
এমনকি কবি-পুরুষের নিজস্ব মানস-প্রতিমায় যে 'টাইপ' নারীর ছবি বা ধ্যান-ধারনা সযত্নে লালিত থাকে তার থেকে বহুদূরে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর অবস্থান। পুরুষের ভালোলাগা নারী কাব্যের রসায়নে তাকে আরও মাধুর্যমন্ডিত করে তোলার অলৌকিক যে প্রচেষ্টা আলোচ্য কবি সে পথে 
হাঁটেননি শুধু নয়, ভালোলাগার 'স্টিরিওটাইপ' কে ভেঙে নারীত্বের এক ভিন্ন সংজ্ঞা নির্মাণ করেছেন তিনি।

'কারো বাঁশির মতো নাক ভালো লাগে/কারো হরিণের মতো চাহনি নেশা ধরায়/কিন্তু হাত তাদের নামানো মাটির দিকে,/ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রে জ্বলে ওঠে না তাদের দৃপ্তমুখ/ফসফরাসের মতো।/আমাকে উজ্জীবিত করে সমুদ্রের একটি স্বপ্ন/মিছিলের একটি মুখ।/অন্য সব মুখ যখন দুর্মূল্য প্রসাধনের প্রতিযোগিতায়/কুৎসিত বিকৃতিকে চাপার চেষ্টা করে,/পচা শবের দুর্গন্ধ ঢাকার জন্যে /গায়ে সুগন্ধি ঢালে,/তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেই মুখ/নিষ্কোষিত তরবারির মতো/জেগে উঠে আমাকে জাগায়।'
'মিছিল ' অর্থাৎ এক বিস্তৃত , প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক 
প্রেক্ষাপটকে ব্যবহার করছেন কবি তাঁর পছন্দের নারীকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে; এই উত্থিত হাত আর শাণিত মুখ যেখানে কবি আগামীর বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে দেখতে পেয়েছেন এমন নারীর রূপকল্পই একমাত্র কবিকে সম্মোহিত করতে সক্ষম, অন্য যেকোনো রকম দৈহিক সৌন্দর্য দিয়ে তিনি নারীর সত্তাকে বিচার করেননা।পূর্বতন কবিদের কবিতায় এমন স্বতন্ত্র ঘোষণা লক্ষ করা যায়নি শুধু নয়, নারীকে এভাবে ভাবার আগে প্রথাগত দেহবাদ বা দৈহিকতাই প্রধান অন্তরায় একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

সমালোচক রমাকৃষ্ণ মৈত্র এর কথায় 'প্রেমের কবিতা ছাড়া প্রথম কবিতার বই' এই শংসাপত্র সত্ত্বেও এটাতো অনস্বীকার্য যে চাঁদ, ফুল , কোকিল,বসন্ত, প্রেম সম্বন্ধে তাঁর প্রথম দিককার কাব্যপরিক্রমায় নির্মম তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া অন্য কোনো কোণ নেই। গীতার সঙ্গে বিবাহ এবং ১৯৫২-৫৩ সালে বজবজে বছর দুয়েকের নর-নারীর জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে জীবনবোধের অন্যান্য পরিবর্তনের সঙ্গে তাঁর কাব্যদেহে এই বৃত্তিগুলিও সমুচিত মর্যাদা পেতে শুরু করেছিল।তাও সেগুলির মধ্যে আকুতি,আর্তি,হিন্দোল থাকলেও উষ্ণ রক্তের টগবগে ভাব তেমন নেই।
তাই 'মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ' থেকে যার শুরু তা যখন 'উত্তোলিত বাহুর তরঙ্গে তোমাকে ঢেকে দিল/যখন তোমাকে আর দেখা গেল না–তখনই/আশ্চর্য সুন্দর দেখাল তোমাকে' এর মধ্যে দিয়ে 'তুমি আলো , আমি আধাঁরের আল বেয়ে /আনতে চলেছি /লাল টুকটুকে দিন'–বড়োজোর 'মুখখানি যেন ভোরের শেফালি ' এবং 'ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত' পর্যন্ত পৌঁছে প্রায় শেষ হয়ে গেল। সুভাষের কাব্যসৃষ্টিতে প্রেম ও কামের ঝড়ঝাপটায় দিকভুল হবার প্রেরণা নেই বললেই হয়।'

উপরে উল্লিখিত পঙক্তিগুলির সূত্রেই আমাদের আসতে হবে আরও একটি ব্যতিক্রমী ভাববর্ণিত কবিতায় ; 'সুন্দর' এর সংজ্ঞা নানাভাবে বিচার্য–বস্তুর সৌন্দর্যকে তার বর্ণ–রূপ-রস–গন্ধ দিয়ে বিচার করি আমরা অর্থাৎ যা ইন্দ্রিয় সাপেক্ষ। রবীন্দ্রনাথের মত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড়োজোর বলা যায়–
'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/চুনী উঠল রাঙা হয়ে'
পাশাপাশি নারী সৌন্দর্যের বর্ণনায় পৃথিবীর বড়, ছোট কবিরা যুগ যুগ ধরে নানাবিধ অলংকারের আশ্রয় নিয়েছেন; আধুনিক কবিরা সেসব কাটছাঁট করেও নিদেনপক্ষে অস্থায়ী হলেও স্বপ্ন বিলাসিতার রাজ্য নির্মাণ করেছেন, সেখানে চেতন ও অচেতনের মধ্যবর্তী এক অধিচেতনের নিজস্ব পৃথিবীতে প্রিয়তমারা ক্ষনিকের জন্য নেমে এসেছে মধুচন্দ্রিমাযাপনে ;তাকে যুগের তথা সমাজের প্রয়োজনে কালের নিরিখে কেউ কেউ বাস্তবে শরীরী রূপ দিলেও মাটি সেখানে নারীর সঙ্গে এতটা একাত্মভাভাবে কথা বলেনি। সুভাষ ও তাঁর স্ত্রীর বজবজে কাটানো দীর্ঘ জীবনাভিজ্ঞতা তাঁর নারী ভাবনাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। আমার এ হেন বক্তব্যের সুপারিশে সমগ্র কবিতাটাই উদ্ধৃত করবার প্রয়োজন মনে করলাম।
'যখন তোমার আঁচল দমকা হাওয়ায় একা একা উড়ছিল/তখনও নয়/বিকেলের পড়ন্ত রোদে বিন্দু বিন্দু ঘাম/ তোমার মুখে যখন মুক্তোর মতো জ্বলছিল/তখনও নয়/কী একটা কথায় আকাশ উদ্ভাসিত ক'রে /তুমি যখন হাসলে/তখনও নয়/যখন ভোঁ বাজতেই/মাথায় চটের ফেঁসো জড়ানো এক সমুদ্র/একটি করে ইস্তাহারের জন্যে/ উত্তোলিত বাহুর তরঙ্গে তোমাকে ঢেকে দিল/যখন তোমাকে আর দেখা গেল না–/তখনই/আশ্চর্য সুন্দর দেখাল তোমাকে।।'('সুন্দর'/'ফুল ফুটুক')

এপ্রসঙ্গে গীতা বন্দোপাধ্যায়    এর একটি মন্তব্য স্মরণে আসে–
"চটকলের মেয়েদের মধ্যে বহু হিন্দু মেয়ের কাছাকাছি এসে অবাক হয়েছিলাম তাদের বেঁচে থাকার ক্ষমতা দেখে।বিধবা-স্বামী-পরিত্যক্তা,
গৃহছাড়া আইবুড়ো মেয়ে, ধর্ষিতা–সব চটকলে নামমাত্র মজুরিতে বেঁচে আছে। কিন্তু নানা রঙ আছে তাদের মনে।"

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন