কবিতা
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ:– বাসুদেব দাস

১)
অপরিচিতা/সৌরভ শইকীয়া


-কাল দেখলাম আপনাকে
রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোনোদিকে না তাকিয়ে 
আপনি যাচ্ছিলেন,কোথায় যাচ্ছিলেন? 
-কোথাও যাচ্ছি না,ঘরেই আছি
যাকে দেখেছিলে,কে জানে হয়তো সে আমি নি
তুমি অন্য কাউকে দেখেছ
-কিন্তু সে তো আপনিই বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে  ভেসে যেতে থাকা
হুবহু আপনিই 
গোস্বামী সার্ভিসে সেই আপনার মতোই উড়োউড়ো চুল 
আপনি??
-হ্যাঁ।
সাধারণত আমি মাটিতে নৌকা বাই।
ভর দুপুরবেলা সেইজন্যই নৌকা যাচ্ছিল,যাচ্ছিল 
ভুল করে পাক ঘুরণি খেয়ে মরীচিকায় গিয়ে লাগল
-কিন্তু এদিকে তো মরুভূমি 
হু হু বাতাস,তপ্ত সূর্য মাথায়,পুড়িয়ে দেবে পুড়িয়ে দেবে
গাছের দেখাদেখি নেই 
-গাছের মতোই নেচে নেচে নীরদবাহন যদি আসত 
-পাতার আড়ালে ঢাকা পড়ে ছোট্ট  খড়ের ঘর হতাম
-খড়ের ঘরের স্বপ্ন সিনেমা হতে পারে 
খড়ের ঘরে কিন্তু কেউ থাকে না (হাসি…)
-এই প্রথম সোনালি হাসির সুতো ছিঁড়লাম 
আমরা আপনাকে মরতে দেব না 
-কে বলল মরব বলে?
-ইউ উইল নেভার ওয়াক এলোন
-দেখছি আপনাকে 
রিক্সায় আপনি কেন উঠেন না?
-নিয়তি টেনে নিয়ে যাওয়া বলে মনে হয়
-আপনি ভালোবাসেন
কার গোলাপে আপনার দুঃখের পাহাড় ঢেকে যায়?
-কেন?কেন??
-কাল দেখলাম আপনাকে 
কাল আপনাকে দেখলাম… 
 
২) 
কৃষ্ণচূড়ার ক্রোধ/সৌরভ শইকীয়া

যেন 
শুকনো মেঘের চালে কেউ আগুন লাগিয়েছে সেদিন।
শরণীয়া পাহাড়ের নিচে 
একটা নিঃসঙ্গ রাধাচূড়া 
সবার অগোচরে বেড়ে আসে
একটা দুটো করে রাশি রাশি কৃষ্ণচূড়া।

কৃষ্ণচূড়া ভাবে –
একটা লাল কাক হয়ে পাহাড়টিতে ডাকব
পাহাড়টা আমাদের 
পাহাড়টা আমাদের 

বেকায়দায় পেয়ে একদিন 
নিঃসঙ্গ রাধাচূড়াকে ওরা চেপে ধরল।
আমরাই স্থায়ী বাসিন্দা 
আমাদের গায়ে গা ঘষে 
তুই কোথাকার,কোন রাধাচূড়া…
গান ভালোবাসা মাটি দিয়ে খেলা করা সেই নিঃসঙ্গ রাধাচূড়াটি 
তাকে ঘিরে ঘিরে কৃষ্ণচূড়ার ঝাঁক
কাড়াকাড়ি 
টানাটানি

দূর থেকে তাকিয়ে ঘটনাটা দেখছিল শুকনো মেঘের পাহাড়টা।
এল।
চোখে চোখ রাখল রাধাচূড়ার।সে ও।
পিরিতের খোঁচ থেকে ছুরিটা বের করল।সোনালি।
কেটে কেটে লিখল তার বুকে 
রা...ধা...চূ...ড়া  
রা...ধা...চূ...ড়া   

সুখী হয়ে যায় রাধাচূড়া
পাহাড়টার ঘাড় দিয়ে প্রজাপতিদের উড়িয়ে 
একা একা সে হাসে

ক্রোধে জ্বলে উঠে কৃষ্ণচূড়াগুলি 
রাধাচূড়ায় যার ঈর্ষা।

৩) 
অনুশীলন/গঙ্গামোহন মিলি  

মানুষের প্রতি সহজ বিশ্বাস 
বারবার আমাকে প্রতারিত করেছে
অপমানিত আহত হৃদয় নিয়ে 
একা ফুঁপিয়ে উঠেছি।
আমি অবাক হয়ে গেছি 
কীভাবে বাঁশি বাজানো ঠোঁটে 
উচ্চারিত হতে পারে নিদারুণ শব্দ
নীল দুচোখে মেখে নিতে পারে 
ছলনার মায়াময় চাহনি,
প্রেমের কবিতা লেখা হাতে 
তুলে নিতে পারে অস্ত্র
মাটি ছুঁয়ে থাকা দুই পা
মাড়াতে পারে নারীর বক্ষ।
তবু,প্রেমের সংজ্ঞার খোঁজে 
আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকিয়েছি 
গোলাপ এবং শিশিরের সান্নিধ্যে 
উচ্ছসিত হয়ে পড়েছি 
পাঠশালা অভিমুখী শিশুর হাসিতে 
ভরে উঠেছে বুকের শূন্যতা 
প্রিয় নারীর স্নেহময়ী হাতের পরশ 
বয়ে এনেছে জীবন গড়ার অদম্য প্রেরণা।

৪) 
জনৈক কবিবন্ধুকে/গঙ্গামোহন মিলি 

সহৃদয় কবি বন্ধু,এখন সময় নয়
রূপসী রমনীর রমনীয় কল্পনায় 
নিজেকে ডুবিয়ে দেয়ার,
এখন কবিতা
কেবল ফুল-তারা-চাঁদের 
প্রশংসায় পঞ্চমুখের মুখপত্র নয়।
কিছুদিন আগে নির্মম ভাতৃঘাতী সংঘর্ষে 
আশ্রয়হীন আত্মীয়ের জন্য 
নিজেকে উৎসর্গ করার লগ্ন,
মারনাস্ত্র নিয়ে থাকা প্রতিটি ক্ষুব্ধ ভাইয়ের দিকে 
পরম বন্ধুত্বের আশ্বাসে নিজের দুইহাত এগিয়ে দাও।
জান কবি বন্ধু!
প্রতিটি মানুষেরই থাকে প্রাণের মমতা 
মানুষ এমনিতেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে না।
নিশ্চয় তার দুর্যোগ ভরা অতীত রয়েছে।
নিশ্চয় তার অস্তিত্বের প্রতি আশঙ্কা আছে।
এটাই আমার বিনম্র প্রার্থনা 
হাজার অপরাধী হলেও কবি কাউকে যেন 
দেখা মাত্র গুলির নির্দেশে সায় না দেয়।
বিপর্যস্ত বিবেকগুলিকে অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দিতে হবে 
সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ার জন্য বারুদের প্রয়োজন নেই।
সরকারকে সতর্ক করে দিতেই হবে 
লাঠি বন্দুক দিয়ে কখনও রোধ করা যায় না 
বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ। 
৫) 
তোমাকে/মদারজ্যোতি 
  
তোমার চোখজোড়ায় কাল পর্যন্ত কিছুই ছিল না
স্থির ছবিতে একটা বিল জড়িয়েছিল 
আকাশ
তীরের ঝাউবনগুলি কাঁপছিল জলের ধারে 
ধীরে ধীরে আকাশ উঁচু হয়ে উঠছিল 
উঁচু আকাশের নিচে ছোট হয়ে এসেছিল 
ঝাউবনগুলি 
কাজল মেঘের সামিয়ানা পার হয়ে 
তোমার চোখে আজ মেঘমল্লার 
পোড়া টায়ারের ধোঁয়ার জন্য অনমনীয় 
এই বর্তমান 
আমি দেখিনি 
অস্তিত্বের সমস্ত সঙ্কটের বোঝা বয়ে 
আমি তোমার চোখের আর্তি শুনিনি 

দিনে উজান থেকে খবর এসেছে 
একটি মেয়ে মারা গেছে 
রাতে ভাটি থেকে খবর এসেছে 
একটি ছেলে মারা গেছে 
বুলেট ভেদ করেছে দুজনেরই 
কোমল হৃদয় 

আজ তোমার চোখজোড়ায় সবই আছে 
বাগানে ফুলগুলি ফুটেছে 
পাপড়ি খসে পড়ছে একই বাগানে 
মৃত পাপড়ি শুকিয়েছে 
আর তোমার দুইগালে চোখের জলের দাগ

দাগ কেটে যাবার মতো আমার দুইচোখে 
নাকি খাজ কেটে যাবার মতো দুইচোখে ভেতরে 
উপড়ে যাওয়া একটি মহীরুহের ইতি 
নাকি বৈশাখের দুপুরের টিহিটি শব্দ 
আমি জানি না
এখনও আমি শুতে পারিনি 
মুহূর্তে বদলে যাওয়া দুজোড়া চোখের কোলাহল 
এখনও মিলিয়ে যায়নি 
বুর্জোয়া রাষ্ট্র হত্যা করা ছেলেমেয়েদের বুকে 

৬) 
তৃতীয় বিশ্ব/ মদারজ্যোতি 
  
আমি ততটাই উঁচু ছিলাম 
যেখান থেকে সাদা চাঁদটার বুকে শুয়ে পড়েছিল 
নারকেলের একটি পাতা 
আর তীব্রভাবে বেরিয়ে আসা 
মেরুদণ্ডগুলির সঙ্গে পুষ্টিহীন একটা মানুষ 
খাপ খেয়ে পড়েছিল 
চাঁদের বুকে 

আমি ততটাই উঁচু ছিলাম 
যেখান থেকে যুদ্ধ জাহাজগুলি দেখা যায়
চিলপাখির মতো 
আর যার চোখে ক্ষুধা ছাড়া চোখে পড়েনা 
কিছুই 
আর তার থাবার নখের খাদ্য পিণ্ডে 
আমার বাহুমূলের টুকরোর সঙ্গে ঘর্মাক্ত 
জামাটা 
খাপ খেয়ে যায়

আমি ততটাই উঁচু ছিলাম 
যেখান থেকে সবচেয়ে বিস্তত দেশের পতাকাটা 
ছোট চিল পাখির মতো দেখায় 
নাগরিকদের বর্ণ আর ধর্মের ধূসর 
ধারণার মতো 
যে পতাকাটির বৈশিষ্ট্য খাপ খেয়ে যায় 
সমস্ত দেশের সঙ্গে

বোধহয় আমার উচ্চতাও ছিল ছিল ততটাই 
যেখান থেকে নিম্নশ্রেণির মানুষ দূরে দেখতে পায় না
যেখান থেকে কেবল নির্বাচন করা যায় 
নেতা 
যেখান থেকে ভেটো কেবল দলনির ভেটফুল
যেখান থেকে প্রতিবাদ মানে মাঠের কাঠামো
যেখান থেকে স্বপ্ন মানে পুঁজিবাদের বিপণন
বিজ্ঞাপন

আমি কতটা উঁচু ছিলাম 
বাবা বলেনি একথা
কেবল উল বোনার সময় মা 
নিজের অজান্তে পিগমি মাপের সোয়েটার 
একটা 
তাঁর স্ফীত উদরে খাপ খেয়ে পড়েছিল 
অবলীলাক্রমে 

৭)
উত্তরাধিকারী/ রণজিৎ গগৈ

এই পৃথিবী থেকে আমরা 
কে কী নিয়ে যাব?
হাতের মুঠিতে কার জন্য কী রেখে যাব?
একটা বীজধানের ভাঁড়ার 
একটা বড় উঠোন!
ওহো,কিছুই পারলাম না দেখছি

তবু দুচোখ প্রতিদিন আশায় 
পরিপূর্ণ হয়ে থাকে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে 
কালো ছাই হয়ে যাওয়া হৃদয়টা 
নেড়েচেড়ে।
ভালোবাসাকে বাদ দিয়ে 
ভাবতে পারি কি একটা নতুন 
জীবনের কথা 
শেফালি ঝরে পড়া ভোরগুলি 
কার জীবনে আসেনি?
সময় গড়িয়ে  যায় 
বদলে যায় রূপ 
বুকের কঠীয়ানীত একটা হঁয়কলী 
ছটফট করে। 

৮) 
দুঃখ/ দিব্যজ্যোতি বরা 

যে দুঃখ তুমি দিলে 
তাকে ভোলার জন্য 
আরও অল্প দুঃখের প্রয়োজন 
যে ভুল আমি করলাম 
হৃদয় অপচয় করে তোমায় 
তা শোধরাবার জন্য 
আরও কিছু ভুল করার প্রয়োজন

হৃদয়ের সঙ্গে মুখোমুখি না হয়ে যে 
চালনা করে তাকে শরীর 
বুকের ভেতরে ফুল যদি ফোঁটে নি 
চোখের জলের কাঁটায় বালিশের ওয়ার 
লাল হয়ে যায় আর
দাগ থেকে যায় ক্লেদাক্ত অতীতের 
ভুলে যাওয়া গান,তোমাকে বললাম,মনে করিয়ে দিও না  
আমার খাণ্ডব দাহে,তুমি জান,হাড় আর ছাই পাবে 

যে দুঃখ তুমি দিলে 
তাকে ভোলার জন্য 
আরও কিছু দুঃখের প্রয়োজন 
পুঁতে রাখা কঙ্কা্ল থেকে মানুষ হওয়ার জন্য 
তোমার হাতে আমার মৃত্যুর প্রয়োজন

৯) 
দুঃখ কর না/ দিব্যজ্যোতি বরা 

দুঃখ কর না,দুঃখ করনা
জনগন খেতে পাবে দুর্ভিক্ষ হওয়ার পরে,দুঃখ কর না
শিক্ষক বেতন পাবে আত্মহত্যা করার পরে,দুঃখ কর না
পুলিশ আসবে রাস্তায় বলাৎকার হওয়ার পরে,দুঃখ কর না
ঘোষখোর,দালালরা শাস্তির সম্মুখীন হবে নরকে,দুঃখ কর না
শান্তি স্থাপিত হবে দেশ শ্মশান হওয়ার পরে,দুঃখ কর না
দুঃখ কর না।
ধুতুরা গুটি খাওয়ার পরে।    

১০) 
নখের কাব্য/ রাজেশ কুমার তাঁতী 

নখ ঝাড়া দিলে বহমান নদীর কথা নখ জানে না
যেভাবে নেইল কাটারের আঘাতে হওয়া নিজের মৃত্যুর কথা 

বেড়ে চলার নিজের ধর্মে নখ অটল থাকে।

নেইল পালিশে ঘিরে রাখলেও বেরিয়ে আসে কৃ্ত্রিম আবরণ থেকে 
অপ্রতিরোধ্য নখ,
কেউ তার বৃ্দ্ধি রোধ করতে পারে না।

আঁচরকে নখ নিজেও সমীহ করে চলে 
যেহেতু নখে বাসা বাঁধে বীজানুর দল 
ছড়িয়ে যায় নখ থেকে নখে,নখ থেকে রক্তে 
সংক্রামক ব্যাধি 
নখকে একদিন জিজ্ঞেস করা হল 
মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর নখ বাড়ে না 
কেন সবসময় মাপের মধ্যে থাকে বয়স অনুসারে 
মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর লালসা থাকে না 
কুনির আড়াল থেকে ভয়ে ভয়ে নখ বলল 
নখ লালসার অন্য এক নাম নাকি 
নখকে পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল
নখ এবং লালসা একই নয় 
নখ বলল 
নখে স্নায়ু থাকে না এবং 
লালসায় চেতনা। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন