মারাদোনা কেন মারাদোনা
সমীরণ কুণ্ডু

আগে বলতাম পৃথিবীতে একমাত্র একজনকে ছুঁয়ে দেখার জন্য জনসমুদ্রেও মিশে যেতে পারি --- তিনি হলেন মারাদোনা। সেইমতো সল্টলেক স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম যেবার শুধু ঘুরতে এসেছিলেন। খেলা ছাড়ার অনেক বছর বাদে। তাতেও লক্ষাধিক মানুষের ভিড় --- দূর থেকে হলেও জ্যান্ত কিংবদন্তিকে দেখা তো যাবে। জনপ্রিয়তায় এরকম দ্বিতীয় ব্যক্তি আমার জীবনে দেখিনি। 

নিজে ফুটবল খেলতে ভালোবাসতাম। স্বপ্ন ছিলো বড় ফুটবলার হবো। হতে পারিনি। তবে খেলাটি অনেকের থেকে বেশী ভালো বুঝি বন্ধুজন জানে সেকথা। তখন জেনেছি পড়ালেখা-খেলাধুলো একসাথে হয় না। এখন যেমন --- দেখলাম জীবিকা ও কবিতা লেখা একসাথে হয় না। মানে দুটিই হয়। মধ্যমানের। 

তখন ১৯৮২। মারাদোনা সাড়া জাগিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এলেন। লালকার্ড দেখে মাঠের বাইরে। মতি নন্দী আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখলেন --- এই খেলোয়াড়ের ট্রান্সফারেন্স ফীস্ সাড়ে আট কোটি ডলার! এই তাঁর নমুনা? পরে ১৯৮৬র বিশ্বকাপে মতি নন্দী ভুল স্বীকার করেছিলেন। এটিও তাঁর মহত্বের মধ্যে পড়ে। তখনই ১৯৮২ তেই আমরা পত্রিকা মারফত জেনেছিলাম এই খেলোয়াড় নাকি একরুমাল জায়গায় চারজনকে ড্রিবিল করে। অসম্ভব প্রতিভাবান। ১৯৭৮-য়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ওঁর বিশ্বকাপ অভিযানটি শুরু হতে পারতো। শেষপর্বে মেডিক্যাল টেস্টে মারাদোনা মূল দল থেকে বাদ পড়ে যায়। ঈশ্বরেরও দুর্ভাগ্য হয় তাহলে। 

এবার ১৯৮৬। আমার ২২-২৩ বছর। বুঝি তখন ফুটবল খেলা। পৃথিবী দেখলো সর্বকালের সেরা ফুটবলারকে। একা এগারো জনের দলকে বিশ্বকাপ এনে দিতে পারে এই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটি। নক আউট পর্যায়ে প্রথমে ইংল্যাণ্ড, পরে বেলজিয়াম ও ফাইনালে জার্মান দলকে একাই শেষ করে দিলো। ১৯৯০-য়ে আবার সেই একা। এবার ফাইনালে হেরে গেল ঠিকই কিন্তু তার আগে খেয়ে নিলো ব্রাজিল ও ইতালিকে। ১৯৯৪ সালে আমেরিকা নির্লজ্জের মতো কলঙ্ক সেঁটে দিলো ওঁর গায়ে। যাঁরা কুৎসিত ও ভয়ংকর বললেও কম বলা হবে। আরে বলবর্ধক ওষুধ খেয়ে ওয়েট লিফটার ১০ কেজি ওজন বেশী তুলতে পারে। ফুটবল খেলায় বল কনট্রোল ও ডিস্ট্রিবিউশনের মুন্সিয়ানা বাড়ানো যায় না।  ঈশ্বরের খেলোয়াড় জীবনকে ওই বদমায়েশি দিয়ে আটকানো যায়? ততদিনে আর্জেন্টিনা মানেই মারাদোনা। একটি গোটা দেশ, জাতি চিহ্নিত হচ্ছে মারাদোনার নামে। এরকম কখনও আগে দেখিনি। 


মারাদোনার গেম সেন্স, উপস্থিত বুদ্ধি, গেমসম্যানশিপ, লিডিং করার ক্ষমতা, উন্মাদনা ও আবেগ --- এতখানি উদ্বুদ্ধ করতো অন্যদের সেখানে মধ্যমানের খেলোয়াড়ও সম্পূর্ণ নিঙড়ে দিত খেলার সময়। এত নিখুঁত ফুটবলার আমি দেখিনি। শুধুই বাঁপায়ের ফুটবলার, উচ্চতা কম থাকলে কী হবে অদম্য প্রাণশক্তি ও বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ অসাধারণ। মাঠের প্রতিটি ইঞ্চি ও কোণা ওঁর চেনা। ডেড বল সিচুয়েশনে তুলনাহীন। বার উঁচিয়ে ফ্রিকিক মারতে কখনও দেখিনি। অ্যাতো পারফেকশন ছিলো। সঙ্গে অবলীলায় একের পর একেক জনকে কাটিয়ে গোল করার ঈশ্বরীয় ক্ষমতা। কোচ বিলার্দোকে প্রশংসা করতে হবে মারাদোনাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্য। দেশপ্রেম দেখবার মতো। ক্লাব ফুটবলেও সমানভাবে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। ফুটবলের প্রতি অসম্ভব সৎ ও আবেগপ্রবণ। ইতালির দ্বিতীয় ডিভিশনের দল নেপোলিকে একাই পৃথিবীর প্রথম সারির দলে পরিণত করেছিলেন। ইতালিয়ান লীগ থেকে শুরু করে ইউরোপিয়ান ক্লাব পর্যায়ের সব ট্রফি এনে দিয়েছিলেন। সঙ্গে আরো এক তারকা ফুটবলার ব্রাজিলের কারেকার যুগলবন্দী ছিলো অপ্রতিরোধ্য। বিরল প্রজাতির মারাদোনার বল জাগলিং ছিলো জাদু মাখানো। 

জীবনে প্রচুর বড় ফুটবলারের খেলা দেখেছি। সবার নাম বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু মারাদোনা একটিই হয় --- বিকল্প নেই। হ্যাঁ বর্তমানের রোনাল্ডো, মেসিকে দেখেও এই কথা বলছি। এছাড়া আরো অনেক নাম আসবে বেকেনবাউয়ার, ক্রুয়েফ, প্লাতিনি, বুত্রাগুয়েনা, বোনিয়েক, বাজ্জো, ম্যাথিউজ, লিনেকার, জিকো, ভালদোরামা, শিফো, বেকহ্যাম, রোনাল্ডো, জিদান,  রোনাল্ডিনহো, ক্লিন্সম্যান, ফোলার, ফোরলান, গুলিট, বাস্তেন, কার্লোস, মালদিনি, কারেকা, লেভেনডেস্কি, ওর্তেগা, রুনি, ব্রাঙ্কো, মার্সেলো, সক্রেটিস, বেনজিমা, হিগুয়েন, ফ্রান্সিসকোলি, রিভাল্ডো, আরো কতো নাম একসাথে স্মরণে আসছে না। ইউসোবিও, বেস্ট, পেলে, গ্যারিঞ্চা, চার্লটনদের খেলা আমি দেখিনি। তাই তুলনায় গেলাম না। মারাদোনার মতো সাবলীল সোলো ডজ এঁদের কারো নেই। মেসি, রোনাল্ডো, জিদান, ওর্তেগা, ফ্রান্সিসকোলি খুব কাছাকাছি থাকবে এই জায়গায়। তবে মারাদোনার মতো নয়। আসলে মারাদোনাকে নিয়ে বলে শেষ করা যাবে না। কমপ্লিট ফুটবলার। মাঠে সকলের রাজা মারাদোনা। ওইরকম কর্তৃত্ব নিয়ে ফুটবলকে শাসন করতে আমি কাউকে দেখিনি। যাঁদের নাম লিখলাম জাদুকর তাঁরাও। কিন্তু মারাদোনা বিরলতম ও শ্রেষ্ঠ। 

ছোট্টো শিশুটি তখন পাড়ার মাঠে একাই বল খেলতো এমন অনেক হয়েছে। এক ভদ্রলোক ওঁর বল নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ওঁর বাড়িতে বুঝিয়ে একটি ফুটবল ক্লিনিকে নিজে অর্থ ব্যয় করে ভর্তি করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর সেখানেই মারাদোনার ফুটবলের পাঠক্রম চলতে থাকে। মারাদোনা বিখ্যাত হয়ে উঠলে প্রচুর খুঁজেও সেই মানুষটিকে পান নি। এটি কথিত ও সত্য। মারাদোনার ওই নিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ছিলো। 

অচেনা সেই মানুষটির কাছে গেলে এখন মারাদোনাকে দেখতে পাওয়া যাবে --- আমার ধারণা। নির্দিষ্টে এরকমই লেখা ছিলো। অনেক প্রতিভাই প্রকাশিত হয় না। আমাদের কৃতজ্ঞতা ওই মানুষটির প্রতি। উনি না থাকলে হয়তো মারাদোনাকে পেতাম না। বিরলতম প্রতিভা হারিয়ে যেত অজান্তে। মারাদোনার শৈশব নিয়ে অন্য একদিন বসা যাবে। এখন শুধু প্রণাম করার সময়। মৌন থাকি তবে? 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন