মানিকমামা
মন্দিরা  ঘোষ 

"ভালো থেকো।কবিতার সঙ্গে যেমন আছো, যেভাবে  আছো, সেভাবেই থেকো।"... হঠাৎই মেসেঞ্জারে শুরুটা এভাবেই।
নিজে থেকেই দেখা করতে বলেছিলেন বলে কারণ জানতে চেয়েছিলাম।আসলে তখনও জানি না উনি ঠিক কতোখানি কবিতার জগতে।জানি না পারিবারিক সম্পর্কের কথাও।কারণ তখনও আমার কবিতাযাপন একান্ত  নিজের মধ্যেই এবং যতটুকু যা তা সম্পূর্ণ নিজের অর্জনে।তাই অযাচিত  আমার ভালো চাওয়ার কারণ জানার স্পর্ধা দেখিয়ে ছিলাম সেদিন।

"আর 'কি কারণে' হবে না, লিখতে হবে 'কী কারণে' ।আপাতত বানান শেখার জন্য  আসতে পারো ।অনেকেই আসে ।"
 ধমক খেলাম আর আশ্চর্য!আমার  রাগ হলো না।ভাবলাম আমি এরকমই  কারোকে খুঁজছিলাম মনে মনে। ঈশ্বর প্রেরিত মনে হলো।তবু তর্ক বহাল রাখলাম।
উনি লিখলেন,
"বাংলা বানান ভুল লেখা অপরাধ । সেই অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য  আর কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না । সহজ কথাটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কেন ?"
আবারও ধমক খেলাম।আবারও রাগ না হয়ে ভালো লাগলো আমার।বললেন,
"একটা কথা শুনে রাখো, আমি বিশ্বাস করি আমার সাহায্য এবং সহযোগিতায় কেউ যদি কবিতাকে আপডেট করে বা এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে  আমার চিন্তার কোনো কারণ নেই ।বাংলাকবিতার মঙ্গল হলেই আমি খুশি । আর আমি জানি আমি কী লিখি । তুমিও জেনে যাবে, ক্রমে ক্রমে ।"
আরও  বললেন,
"যার ভেতরে লেখা  আছে, তাকে পদ্ধতিটি শেখানো কঠিন নয়।আমি আছি তোমার পাশে । এটাই আমার ব্রত ।"
উপরের কথাগুলোতে সাহস হলো।ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর নিজের স্পর্ধা বাড়লো চতুর্গুণ। 
ক্লাস চলতে থাকলো কথোপকথনের মাঝে।বের হলো পারিবারিক  সম্পর্ক। উনি কবি প্রভাত চৌধুরী ব্যতিরেকে  আমার মানিকমামা হয়ে গেলেন কখন।

"এবার  একটু মাস্টারি করি ।
সন্ধ্যা --- সন্ধে
হয়নি --- কিন্তু  হয় না ।
ক্রিয়াপদের পর না আলাদা,  
নি একসঙ্গে ।
এটা ভুলে গেলে চলবে না ।
আমার নাতনি স্কুলে একটা শব্দে আ-কার দিতে ভুলে গিয়েছিল । আমি ওকে বলেছি স্কুলের ম্যামদের বলবে না, তোমার দাদার নাম প্রভাত চৌধুরী ।
তোমার মানিকমামার নামও প্রভাত চৌধুরী ।".....
চমকে উঠে ছিলাম শেষ  লাইনে এসে।কোথাও যেন ভিতরে ভিতরে দায়িত্ব বেড়ে গেলো আমার।
প্রথম যে কবিতার গোছা দিয়ে ছিলাম,সেগুলো দেখে বলেছিলেন একটাও কবিতা হয়নি।তবু ও তারমধ্যে থেকে কবিতা পাক্ষিকে আমার কবিতা ছাপলেন।
আমার সাহস ক্রমে বাড়তে লাগলো।
আমার নানা প্রশ্নের উত্তরে লিখতেন,
”আধুনিক কালখণ্ডে আধুনিক কবিতা লেখা হত। এখনো অনেকে লেখে বা লেখেন ।আধুনিক কবিতা ছিল একরৈখিক । যেখানে শুরু হতো, সেখানেই শেষ হত । আধুনিকদের হাতে বিকল্প ছিল না ।সারারাত যাত্রার  আসরে বসে থাকতো ।ওদের বিনোদন বলতে ওই যাত্রাই।
আমাদের হাতে উঠে এসেছে কিবোর্ড । আমরা মুহূর্তে এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে চলে যেতে পারি । আমাদের কাছে সংখ্যাহীন বিকল্প ।
বুঝতে পারলে কিছু ? 
খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে, পোশাক পাল্টে গেছে, ভাষারও পরিবর্তন হয়েছে । কেবলমাত্র কবিতা পুরোনো চেয়ারে বসে থাকবে, এটা হতে পারে না । 
একদিন সময় নিয়ে চলে এসো । আরো অনেক কথা জানা দরকার । নাহলে  অন্ধ থেকে যাবে, কিন্তু প্রলয় বন্ধ থাকবে না ।”
একদিন  সাদা বানান নিয়ে জানতে চাইলে, উনি লিখলেন,
"এটা খুব ভালো প্রশ্ন।
শাদা কিছুতেই শ্বেত থেকে আসেনি। অতএব শাদা বাতিল।
সাদা এসেছে সফেদ থেকে। মুঘলশাসনকালে বহু আরবি ফার্সি শব্দ বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছিল।"
এরকম বহু প্রশ্নের উত্তর মানিকমামাকে জানতে চেয়েছি এবং প্রতিবারই আগ্রহের সাথে তার উত্তর, ব্যাখ্যায় সমৃদ্ধ করেছেন।
মাঝে মাঝে আমার সাথে পারিবারিক গল্পে ছবির মতো খুঁজে পেতেন অতীতকে।
"আমার শৈশবের  একটা  অংশে  বড়চাতরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ওবাড়িতে একটা উনোন ছিল যেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেবলমাত্র দুধ গরম হত বা জ্বাল দেওয়া হত । আমি এখনো দুধ খাই ।না খেলে ঘুম  আসে না ।তুমি তো জেনে গেছো ডাক্তার ত্রিলোচন পান  আমার জামাইবাবু । ডলিদি আমার ছোটো পিসিমার মেয়ে। আর হর আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু ।দিলুদার স্ত্রী, নাম কি মঙ্গলাদি? আমাকে নিজের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতো ।ডলিদিরা তো জামশেদপুরে থাকতো । সেই অনুপস্থিতি কখনো বুঝতে পারিনি ।
আজ স্মৃতি আমাকে ছাড়ছে না ।খুব তাড়াতাড়ি একদিন চলে এসো । অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে হালকা হব ।"
আরও  বললেন,
"শুধু গল্প  আর বানান নয়, ম্যাজিকও শিখিয়ে দেবো। কবিতা এই পৃথিবীর সব থেকে বড়ো ইন্দ্রজাল ।"
জানালেন,
"আমি বিকেল পাঁচটার পর কোনো অতিথির জন্য অপেক্ষা করে থাকি। তুমি চলে এসো।"
ওঁর কাছে গিয়ে সামনে বসে কথা বলে বুঝেছিলাম সত্যিই  উনি কবিতার ঐন্দ্রজালিক। 
প্রসঙ্গত বরচাতড়া দেবাঞ্জনের মামারবাড়ি।সেই সূত্রেই উনি আমার মানিকমামা।
সেদিন দেবাঞ্জন আর আমি ওঁর হাতের রান্না,আর মামিমার আন্তরিকতা,গল্প আর কবিতায়  নিজের ভিতরে কবিতাকে ছুঁয়ে দেখার সাহস অর্জন  করেছিলাম,আর সেই সাহসে ভর করে আজও  কলম ভাঙছি রক্তাক্ত শব্দের ভিতরে, কখনও  জেগে উঠছে কবিতার শরীর  কখনও  শুধুই দহন ছেঁড়া  ছেঁড়া  ছাইয়ের আকাশ।

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন