জন্মদিন

শান্তনু রায়চৌধুরী

সময়টা ১৯৯৭-৯৮ সাল একটু এদিক ওদিক হতে পারে। আমরা কয়েকজন বন্ধু সবকিছু ভুলে কবিতা লেখার ও পড়ার নেশায় সকাল-বিকাল এক করে ফেলতাম। একে অন্যের সদ্য লেখা শুনতে ও শোনাতে ব্যস্ত থাকতাম। নোতুন নোতুন লেখকের লেখা নিয়েও আগ্রহী হয়ে উঠছি। দু-চারটে পত্রিকায় আমাদের লেখা ছাপা হচ্ছে  সবমিলিয়ে কবিতার নেশা বেশ পেয়ে বসেছে। ঠিক সেরকম সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্যকেন্দ্রে প্রকাশিত এ্যাকটা ছোট গল্প পড়ে তাক লেগে গ্যালো। লেখক প্রভাত চৌধুরী। এই নাম তখন আমাদের কাছে অজ্ঞাত। গল্পটা এ্যাকটা পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক পত্র বিনিময়ের। চারটে চিঠিতে গল্পটা আশ্চর্য কাহিনির বয়ান। গল্পটা পড়ে আমি বিভোর হয়ে জনে জনে বলতে লাাগলাম আমাদের আড্ডার প্রতিদিনের সদস্য বিষ্ণু চক্রবর্তী, আমিনুল ইসলাম, অনুপ চ্যাটার্জী ও নীলাদ্রি ভট্টাচার্য- ওরাও প্রভাত চৌধুরীকে চিনত না। কথা প্রসঙ্গে আমাদের (রহিম রাজা- সম্পাদক 'গুপিযন্ত্র') রহিমদাকে ওই গল্পের কথা বলতেই জানলাম রহিমদা লেখক প্রভাত চৌধুরীর স্নেহভাজন। তখন আমি মনে মনে প্রভাতদাকে নিয়ে নানা কল্পনা করতাম। ভাবতাম লোকটা মোটাসোটা রাশভারি টাইপের হবে বুঝি। মনে মনে তাঁকে দেখাবার প্রবল ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করতেই রহিমদা প্রভাতদার সাথে দ্যাখা করিয়ে দেবার আশ্বাস দ্যায়। কিন্তু রহিমদার শর্ত ছিল প্রভাতদার সাথে দেখা করার সময় কোনো অমূলক তর্ক বির্তক করা যাবে না কারণ তখন রহিমদার সাথে কবিতা নিয়ে তুমুল তর্ক হোতো আমার। তাই পাছে প্রভাতদার সামনে অ-সৌজন্য প্রকাশ পাই, নিজেদের অপ্রস্তুত করে ফেলি। আমি রহিমদাকে কথা দিয়েছিলাম কোনো রকম তর্ক বিতর্ক করবো না। রহিমদার সাথে কবিতা নিয়ে তর্ক হলেও দারুণ প্রশ্রয়ও পেতাম।  বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর এ্যাকদিন সুখবর এলো প্রভাতদা সদলবলে বহরমপুর আসবেন। কবি সন্দীপ বিশ্বাসের বাড়িতে বসবে ঘরোয়া আড্ডা। সেখানেই হবে আমার দেবদর্শন।

সাল তারিখ মনে নেই শুভদিনটি চলেই এলো। এ্যাক দুপুরে রহিমদার সঙ্গে এলাম বহরমপুর।  কবি সন্দীপ বিশ্বাসের বাড়িতে তখন আড্ডা চলছে।  চুপচাপ ফাঁকা জায়গা দখল করলাম। দারুণ উপভোগ্য আড্ডায় নানা কথা হচ্ছিল,  চলছিল কবিতা পাঠ। আমি খুঁজছিলাম প্রভাত চৌধুরীকে। রহিমদা তাঁকে চিনিয়ে দিতেই আমার কল্পনা খানখান। মনে মনে যা ভেবেছিলাম ঠিক তার উল্টো প্রভাতদা। আড্ডায় অংশ গ্রহণকারীরা সবাই খুব আন্তরিক।  নাসের হোসেন নিখিলকুমার সরকার সমরেন্দ্র রায় অমিতাভ মৈত্র সন্দীপ বিশ্বাসদের না চিনলেও আমার মতো নবাগত ও অনাহুতর কোনোরকম অসুবিধা হলো না। অল্প সময়ের মধ্যে আমাকেও কবিতা পাঠের সুযোগ দেওয়া হল। পাঠ করলাম এবং প্রশংসিত হলাম। য্যানো এই প্রথম নিজেকে কবি মনে হল। আমার পাশেই ছিলেন অমিতাভ মৈত্র। আমার আগে তাঁকে কবিতা পাঠের অনুরোধ করতেই দেখেছিলাম তিনি লজ্জায় পাঠ করতে চাইছিলেন না। আমি অবাক হয়েছিলাম।  অত বড় মাপের কবির বিনয় দেখে। সেদিন সম্ভবত মুরারি সিংহও ছিলেন। আর সে আড্ডাতে ছিলেন দিল্লিতে বসবাসকারী এ্যাকজন ইতিহাসের অধ্যাপক।  তিনি আড্ডা শেষে প্রভাতদাকে রাত্রের খাবারের নেমন্তন্ন করলেন কিন্তু প্রভাতদা শিশুসুলভ বললেন তিনি এ্যাকা খেতে যেতে পারবেন না তাই ভদ্রলোক আমাদের সকলকে আমন্ত্রণ জানালেন।  রাত্রে খাবারের অনেকরকম পদ ছিলো (হোটেল থেকে আনানো কারন অধ্যাপক মশাই বাড়িতে একাই ছিলেন)। বেলে মাছের এ্যাকটা পদ ছিলো। আমি বেলে মাছ খাই না তাই সেটা পাশে সরিয়ে রেখে রহিমদার কানে ফিসফিস করে খেতে অনুরোধ করতেই সবার সামনে রহিমদার বকুনি খেলাম। কিন্তু প্রভাতদা আমার পক্ষ নিয়ে রহিমদাকে বিরত করেছিলেন।  সাহিত্যে এপর্যন্ত কীর্নাহারের বাইরে সেরকম আড্ডা দিইনি। সন্দীপ বিশ্বাসের বাড়ির আড্ডায় অতিথি পরায়নতা ছিলো দারুণ। বারবার চা চানাচুর বিস্কুট চলছিলো। সন্দীপ বাবুর স্ত্রী এবং কন্যারা পান থেকে চুন খসতে দেয় নাই। সেদিন মনে হয়েছিলো ইন্দ্রপুরীতে দেবতাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। 

রাতের আহার শেষ করে আমরা এলাম বিদ্যুত দপ্তরের গেস্ট হাউসে।  শোবার আগে আবার এ্যাক দফা আড্ডা।  কিছু কবিতা শুনলাম কিছু শোনালাম। হঠাৎ নাসেরদা বললেন 'শান্তনু তোমার গান শোনাও।' এবার লজ্জা পেলাম। কারণ গানের গ জানি না তবু পত্রিকা বিক্রির উদ্দেশ্যে (রহিম রাজা সম্পাদিত 'গুপিযন্ত্র' তখন 'কবিতা বারোমাস' নামে প্রকাশিত হতো) আমরা বন্ধুরা কলকাতার কিছু গোষ্ঠীর বইমেলাতে দেখাদেখি কিছু কবিতাতে সুর দিয়ে গান বাঁধছি। তাই নাসেরদার মতো কবির সামনে গান গাইতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কিন্তু নাসেরদার সহজ সরল ব্যবহার আর আমার পিঠে হাত রাখাতে ধরলাম আমার লেখা এ্যাকটা জোলো প্রেমের গান। গাইবার পর খুব লজ্জা পেলাম। কিন্তু তবু নাসেরদা উৎসাহিত করলেন। এবার জীবনানন্দের হায় চিল কবিতাটা (আমার করা সুর) গেয়ে শোনালাম।  নাসেরদা খুব মন দিয়ে শুনছিলেন।  গানটা শেষ করতেই প্রভাতদা রাগে ধমকের সুরে আমাকে বললেন, 'তোমার সাহস তো কম নয়। জীবনানন্দের কবিতায় সুর দিতে গ্যাছো।' ভয় পেলাম অবাকও হলাম।  তবু বললাম দোষটা তো জীবনানন্দের কারণ কবিতায় সুরটা তিনিই লুকিয়ে রেখেছিলেন আমি শুধু সেটা ব্যবহার করেছি মাত্র। প্রভাতদা রাগে গরগর করছেন। রহিমদা চিমটি কেটে এখানে আসার শর্তটা মনে করালো। আমার খারাপ লাগছিলো এই সময় নাসেরদা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন 'এই কবিতাটাতে আর কে সুরারোপ করেছেন তুমি জানো?' বললাম- যদিও গানটা শুনিনি তবে লোপামুদ্রা সুর করেছেন এবং গেয়েছেন। নাসেরদা স্মিত হেসে বললেন-'আমি শুনেছি তিন তিনবার, এ্যাকবার লোপামুদ্রার বাড়িতে এ্যাকবার রেকর্ডিং-এ আর এ্যাকবার স্টেজ পারফরম্যান্সে। তবে এ কবিতাটার সুরে তুমি জীবনানন্দকে অনেকটা ছুঁয়েছো, চালিয়ে যাও।' আমি এ হ্যানো প্রশংসায় হতবাক।  মনে অনেক  জোর পেলাম।  প্রভাতদার বকুনিতে অনেকটা মুষড়ে পড়েছিলাম। নাসেরদা আমার ডায়েরির পাতায় লেখা ও আঁকা ছবিগুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে বলেছিলেন -'শান্তনু ভক্তিভরে ছবি দেখবে তাতে তোমার লেখা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। সেই কথাগুলো আমার কবিতা জীবনে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছে। তারপর থেকে ছবি দ্যাখা শুরু করি। নাসেরদার উৎসাহদান আমাকে সমৃদ্ধ করেছিলো। গান কবিতা ছবি নিয়ে নাসেরদার সঙ্গে কাটানো সময় আমার কাছে চিরস্মরণীয়। প্রভাতদাকে দেখতে গিয়ে আমার উপরি পাওনা।

পরদিন ভোরে প্রভাতদার ডাকাডাকিতে ঘুমভাঙলো। আমার বাড়ি ফেরার কথা কিন্তু শুনলাম বাংলা বানানবিধির এ্যাকটা ওয়ার্কশপ -এ প্রভাতদারা রঘুনাথগঞ্জ যাবেন। আমাকেও সঙ্গে যেতে প্রভাতদা নির্দেশ করলেন। জানলাম পবিত্র সরকার পবিত্র মুখোপাধ্যায় অশোক রায়চৌধুরী এবং আরও অনেক দিকপালরা থাকবেন। আমার মতো অজ্ঞাতকে এ্যাতো বড় অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার ব্যপারে প্রভাতদার উৎসাহ দেখে অবাক হলাম। গাড়িতে উঠলাম। সেই দারুণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ধন্য হলাম। প্রভাতদাকে যত দেখলাম ততই বিস্মিত হলাম। গেস্ট হাউসে প্রভাতদার রাগ দেখে মুষড়ে পড়েছিলাম আবার তাঁর প্রশ্রয় দেওয়া দেখে অবাকও হয়েছিলাম। রঘুনাতগঞ্জের ওয়ার্কশপে অনেককিছু শিখলাম জানলাম। অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিলো।  প্রভাতদাদের সঙ্গ মনে করিয়েছিলো শুধু লিখলে হবে না ভালো মানের লেখার জন্য প্রচেষ্টার দরকার।
সেই অনুষ্ঠানের খবরও কবিতা পাক্ষিকে প্রকাশিত হয়েছিলো। গর্ব হয়েছিলো সেই খবরে অকুলীন আমাকেও সমান মর্যাদা দান করাতে। সেদিন কিছু কবিতা কপি করতে বলেছিলেন প্রভাতদা কিন্তু আমি বলেছিলাম - প্রভাতদা আমরা কয়েকজন এ্যাকসাথে লিখি তাই ওদের লেখাও দেখে ছাপুন। প্রভাতদা বলেছিলেন 'বেশ তবে তোমরা কাটোয়া লিটিল ম্যাগাজিন মেলাতে এসো, দ্যাখা হবে।'

সেদিন কবিতা পাক্ষিক প্রথম ছুঁয়ে সমিহ জেগেছিল। কাটোয়া লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় আমরা দলবেঁধে গিয়েছিলাম। শুধু আমিনুল যেতে পারেনি কর্মসুত্রে দিল্লিতে থাকায়। পরের সংখ্যায় কবিতা পাক্ষিকের প্রচ্ছদ কাহিনিতে ছিল কীর্নাহার। আমাদের চারজনের (আমি, বিষ্ণু, নীলাদ্রি ও রহিমদা) অনেকগুলো কবিতা 'কবিতা পাক্ষিক'-এ প্রথম ছাপা হয়। এটা চমকে যাওয়ার মতোই ব্যপার ছিলো। আর তারপর প্রভাতদার 'লাবণ্য একী লাবণ্য'- গ্রন্থে আমাদের নিয়ে আলোচনা দেখে স্তম্ভিত হই। আমরা তারপর থেকে লেখাকে তপস্যা জ্ঞান করতে শুরু করি। প্রভাতদার কাছেই শুনি মলয় রায়চৌধুরী সমির রায়চৌধুরী রবীন্দ্র গুহর কথা। আমার খুব কম পত্রিকাতেই লেখালেখি। তবে বেশিটাই কবিতা পাক্ষিকে আর রহিমদার পত্রিকায়। তাই বলতে পারি প্রভাতদার সঙ্গ আমাদের লেখার মার্গদর্শন। আজ তাঁর প্রশ্রয়েই লেখালেখির যেটুকু।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন