শঙ্খ ঘোষঃ কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি

  বাসুদেব দাস

বন্ধু কিশোর ভট্টাচার্যের কাছ থেকে এনে পড়া ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’গ্রন্থের শীর্ষক প্রবন্ধটি আমাকে অনুবাদ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। শঙ্খ ঘোষ দুঃখ করে তাঁর প্রবন্ধে বলেছিলেন –‘আমরা বর্তমান অসম বা উড়িষ্যাতে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে সেই বিষয়ে জানি না,সেইভাবে কেরালা বা অন্ধ্রপ্রদেশের সাহিত্যেও কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে সেই বিষয়ে অবগত নই। ফ্যাসি বিরোধী আন্দোলনের সময়ে অথবা প্রগতি আন্দোলনের সম্পর্কিত কোনো চিন্তা-চর্চা করা পরিলক্ষিত হয় না।’শঙ্খ ঘোষের আলোচ্য প্রবন্ধ আমাকে একদিন অসমিয়া সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় অনেকটাই অনুপ্রাণিত করেছিল।

শঙ্খ ঘোষকে প্রথম দেখার কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। ১৯৯২ সনে শঙ্খ ঘোষ অসমের কমলকুমারী ফাঊণ্ডেশন থেকে  ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’র জন্য কমলকুমারী ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর কালচার পুরস্কারে সম্মানিত হন। সোমবারের এক সকাল। রোজকার মতো খবরের কাগজে চোখ রাখতে গিয়েই চমকে উঠলাম।রবীন্দ্রোত্তর যুগের প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ এবং জীব বিজ্ঞানী ত্যাগরাজন কমলকুমারী পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। গতকাল বিজ্ঞানী ত্যাগরাজন এবং শঙ্খ ঘোষকে রবীন্দ্র ভবনে যে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে তাতে শত চেষ্টা করেও উপস্থিত  থাকতে পারিনি।কাজেই মনে মনে ছটফট করছিলাম।শুনলাম দুজনেই হোটেল ব্রহ্মপুত্র অশোকে রয়েছেন।সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলাম,এই সুযোগ কোনোমতেই হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।বাড়ির পাশেই থাকত সাংবাদিক বন্ধু তুষার সাহা। তুষারের আর একটি পরিচয় সে শঙ্খ ঘোষের ছাত্র।ব্যাস,আমাকে আর পায় কে?দুজনেই ছুটলাম হোটেল ব্রহ্মপুত্রের উদ্দেশ্যে। রাস্তা যেন আর ফুরোতে চায় না। কেবলই মনে হচ্ছে কখন দেখা হবে।ইতিমধ্যে আমি শঙ্খ ঘোষের প্রায় প্রতিটি বই-ই পড়ে ফেলেছি।রবীন্দ্র গবেষনার আশ্চর্য ফসল ‘এ আমির আবরণ’,‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’,’উর্বশীর হাসি’,‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক’,’ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়’, ‘শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা’আমার নিত্য সঙ্গী হয়ে  বন্ধু তুষার এবং আমি যথাসময়ে হোটেল ব্রহ্মপুত্রে পৌছে গেলাম। এতদিন শবরীর প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করে চলেছি ,শুভ্র বেশ পরিহিত সেই শঙ্খ ঘোষকে সামনে থেকে দেখতে পেয়ে  আমি তখন ভীষণ উত্তেজিত। আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন। আমার মনে হল এই বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে প্রগলভ হওয়া মানায় না,এক ফাঁকে প্রণামটা সেরে নিলাম।

হোটেলের ঘরে ততক্ষণে একে একে অনেকেই এসে পড়েছেন।মুক্তিদি এবং রবিজিৎদাকেও আসতে দেখলাম। কটন কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার সময় বাংলার অধ্যাপিকা মুক্তি দেব চৌধুরীকে খুব কাছ থেকে পেয়েছি। দিদিকে দেখে অনেকটাই উৎসাহ পেলাম।মুক্তিদি আমাকে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মুক্তিদির সঙ্গে কবির বেশ ঘনিষ্ঠতা রয়েছে দেখলাম।দিদি কবিকে কিছু শারীরিক ও পারিবারিক প্রশ্ন করলেন।মুক্তিদি এবং রবিজিৎদার সঙ্গে আমরাও কবিকে দুই একদিন থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করলাম।শঙ্খ ঘোষ তাঁর নিরুপায়তার কথা জানালেন। শেষপর্যন্ত সবার বিশেষ করে মুক্তিদি এবং রবিজিৎদার অনুরোধে আগামী বিহুতে আমাদের উষ্ণ আমন্ত্রণে সাড়া দিতে রাজি হলেন। পাক্ষিক বসুমতীতে সেইসময় শান্তিনিকেতনের প্রবোধচন্দ্র সেন সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষের একটি স্মৃতিচারণ মূলক লেখা বেরিয়েছিল।লেখাটি খুব ভালো লেগেছিল কারণ পত্রিকার স্বল্প পরিসরেও শঙ্খ ঘোষ সুন্দরভাবে ছাত্রবৎসল প্রবোধচন্দ্রের রূপটিকে স্পর্শ করেছিলেন। প্রবোধচন্দ্রের এই মহানুভবতার সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার ও হয়েছিল।সত্যিকারের পান্ডিত্য এবং জ্ঞানচর্চা যে মানুষকে কতটা মহান এবং নিরহঙ্কার করে তুলতে পারে সেদিন তার পরিচয় পেয়েছিলাম। প্রসঙ্গটা মনে পড়ে যাওয়ায় শঙ্খ ঘোষকে জানালাম। উনি স্নেহের হাসি হাসলেন।তুষারের এক প্রশ্নের উত্তরে শঙ্খ ঘোষ জানালেন যে,সাহিত্য চর্চা অর্থাৎ লেখালেখির ক্ষেত্রে ধৈর্য একটা বড় জিনিস।পাঠকের উপেক্ষাকে মূল্য না দিয়ে নিজের সৃষ্টিতে সমাহিত থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন।এই প্রসঙ্গে তিনি আমেরিকান কবি ডিকিনসনের কথা বলেন। জীবিতাবস্থায় তাঁর একটি কবিতাও ছাপা হয়নি। তাই কোনোরকম প্রতিকূল অবস্থাতেই হৈ চৈ করা চলবে না। কবিকে প্রণাম জানিয়ে সেদিন যখন হোটেল থেকে  বেরিয়ে এসেছিলাম তখন মনে হয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য যেন ‘সব পেয়েছির দেশে’চলে গিয়েছিলাম।

১৯৯৭ সনের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে আমি চাকরিসূত্রে কলকাতা বদলি হয়ে আসি। অবশ্য এটা ছিল স্বেচ্ছায় বদলি বা যাকে বলে Willing Transfer।সেই শৈশব থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল কলকাতায় পড়াশোনা করার।এখানকার সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে নিজেকে আবিষ্কার করার,কোনো একটি বিদেশি ভাষা শেখার। আমাদের স্টাফ কোয়ার্টার ছিল সল্ট লেকের ডিবি ব্লকে। সল্ট লেকের প্রবেশ মুখে বিধান নগরের ঈশান চন্দ্র নিবাসে কবি শঙ্খ ঘোষ থাকেন বলে শুনেছিলাম।কিন্তু এত কাছে এসেও কোনোদিন দেখা করতে যাইনি।কেমন যেন একটা ভয় মেশানো সঙ্কোচ ছিল।অথচ বন্ধুবান্ধবদের কাছে শুনেছিলাম প্রতি রবিবারেই নাকি শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে তরুণ কবি এবং ছাত্র ছাত্রীদের আড্ডা বসে।খুবই ইচ্ছে হত ছুটে চলে যেতে,কিন্তু কেন যেন এক ধরনের সঙ্কোচ এবং আড়ষ্টতা আমাকে ঘিরে ধরত। মনে হত এত বড় মানুষটার সামনে গিয়ে আমি কী কথা বলব।তাছাড়া আমি তো কবি নই ,জীবনে কোনদিনই একটিও কবিতা লিখি নি। কাজেই কবিকে দূর থেকেই প্রণাম জানিয়ে সন্তুষ্ট থাকা ভালো।আমার অফিস চ্যাটার্জী ইন্টারন্যাশনেল থেকে রবীন্দ্র সদন এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। সারা দিন প্রভু শাপে বন্দি যক্ষের মতো অফিসের ডেবিট ক্রেডিট আর ব্যালান্সসিটের অরণ্যে বন্দি থাকার পরে রবীন্দ্র সদনের স্নিগ্ধ পরিবেশ মনের  ওপরে শান্তির প্রলেপ মাখিয়ে দিত। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবি শঙ্খ ঘোষকে বসে থাকতে দেখতাম। তিনি খুব একটা কথা বলতেন না।কিন্তু তবু তার সেই নীরব উপস্থিতিই যেন পুরো অনুষ্ঠানকে ভরিয়ে তুলত। কখনও কাছে যাবার বা কথা বলার চেষ্টা করিনি । দূর থেকেই প্রণাম জানাতাম। তবে একদিন আশাতীত ভাবে শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে যাবার সুযোগ এসে গেল।  

খুব সম্ভব ২০০০ সনই হবে। আজ এতদিন পরে স্পষ্টভাবে আর মনে নেই। গুয়াহাটি থেকে যুবক কবি হেমাঙ্গ দত্ত সাহিত্য আকাদেমির ফেলোশিপ নিয়ে কলকাতা এল। আমার মাস্টারমশাই, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উষা রঞ্জন ভট্টাচার্যের পরামর্শক্রমে হেমাঙ্গ একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। সাহিত্য আকাদেমির কার্যসূচি অনুসারে হেমাঙ্গকে কলকাতার বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেখা করতে হবে।বলা বাহুল্য,কবি শঙ্খ ঘোষ তাদের মধ্যে অন্যতম। আমাকে বলতেই আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। টেলিফোনে সাক্ষাৎকারটা ঠিক করে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে হেমাঙ্গকে নিয়ে শঙ্খ ঘোষের বাড়ি চলে গেলাম। হেমাঙ্গ সেই সময়ের অসমে তরুণ কবিদের মধ্যে অন্যতম।এখানে বলে রাখি যে কবি হেমাঙ্গ দত্ত আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এভাবে এমন একটি তরতাজা যুবক যে রাতারাতি উবে যেতে পারে তা অসমের অনেকের মতো আমারও বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও হেমাঙ্গর আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। যাক এবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই।শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে আমরা অনেকক্ষণ ছিলাম। হেমাঙ্গ কবিকে নানান প্রশ্ন করলেন।সাহিত্য থেকে রাজনীতি কোনো কিছুই বাদ গেল না।মিতভাষী শঙ্খ ঘোষ প্রতিটি প্রশ্নেরই জবাব আন্তরিকভাবে দিলেন।পুরো সময়টুকু আমি নিজেও খুব উপভোগ করলাম। মনে পড়ে,যখন দুজনেই উঠব বলে ভাবছি তখন শঙ্খঘোষ হেমাঙ্গকে উদ্দেশ্য করে বললেন-‘কলকাতা শহরের প্রাণকে স্পর্শ করতে হলে শুধুমাত্র সাহিত্য আকাদেমি ,রবীন্দ্র সদন বা বাংলা আকাদেমিতে ঘুরে বেড়ালেই হবে না। কলকাতাকে জানতে হলে বা বুঝতে হলে কলকাতার অলি গলি ঘুরে বেড়াতে হবে,থিয়েটার দেখতে হবে ,নাটক দেখতে হবে। তাহলেই কলকাতার হৃদস্পন্দনকে স্পর্শ করতে পারবে। আজ কত বছর পার হয়ে গেল কিন্তু আজও মনে হয় কান পাতলে আমি আজও যেন সেই মৃদু কণ্ঠস্বর শুনতে পাব। 

কিছুদিন আগে সাহিত্য অকাদেমির গ্রন্থাগার থেকে শঙ্খ ঘোষের প্রবন্ধগুলি আবার নতুন করে পড়তে শুরু করি। ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’তারই অন্যতম একটি। ১৯৬৭ সনের অক্টোবর থেকে ১৯৬৮ সনের জুন পর্যন্ত আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আগত এক অভিনব লেখক সমবায়ের মধ্যে কাটিয়েছিলেন ।বিনিময় করেছিলেন চিন্তা ভাবনার।সেদিন যাদের সঙ্গে মিশেছিলেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কথা রয়েছে এই ডায়েরিধর্মী রচনায়। বইটা পড়তে পড়তে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে উঠেছিল ।মনে হচ্ছিল কবি শঙ্খ ঘোষ যেন দূরের কেউ নন,আমি যেন তাকে এই লেখার মধ্য দিয়ে স্পর্শ করতে পারছি।

এভাবেই কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর অসামান্য সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে আছেন,চিরকাল বেঁচে থাকবেন।মাইকেল মধুসূদনের কবিতার একটি পঙক্তি দিয়েই আমার প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটা শেষ করছি-

‘সেই ধন্য নরকুলে লোকে যারে নাহি ভুলে 

মনের মন্দিরে পূজে সর্বজন।


2 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন