এক অলৌকিক সান্ধ্যআড্ডা

তপন গোস্বামী

সালটা ২০১১, ১০ই মার্চ । সময় রাত আটটা পেরিয়ে যাবে। তাই সান্ধ্যআড্ডা বলাটা কি ঠিক হবে? আবার রাত্রিও বলতে পারছি না। কেননা দশটার মধ্যেই আমাদের আসর শেষ হয়ে গিয়েছিল।ক্যান্টিনের লোকজন বাড়ি চলে যাবে, খাওয়ার পাট চুকিয়ে তাদের ছাড়তে হবে। অগত্যা সান্ধ্যআড্ডা।

আমরা তখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকে গেস্টহাউসে থেকে তূতীয়বর্ষের বাংলা অনার্সের খাতা দেখতে গেছি। শুনলাম বাংলাবিভাগে একটা সেমিনার হচ্ছে ।বিষয় রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টি। আসছেন প্রথিতযশা অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক অশ্রুকুমার শিকদার এবং কবি ও আমাদের স্যার শঙ্খ ঘোষ।

আরও কেউ কেউ নিশ্চয়ই এসেছিলেন, তাঁদের কথা অন্যত্র বলা যাবে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা খুব উৎসাহিত ও উত্তেজিত হয়েছিলাম। উপরি পাওনা ছিল সেদিন আলোচনার শেষে বর্ধমান রবীন্দ্রভবনে অধ্যাপক শিবব্রত চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায ও অভিনয়ে এবং অধ্যাপক সৌমিত্র বসুর অভিনয়ে পরিবেশিত নাটক রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’। প্রযোজনায় নান্দনিক।  অসাধারণ সেই পরিবেশন, দুর্দান্ত অভিনয়। দলগতভাবে সবার অভিনয় চোখ টেনেছিল, আলাদা করে শিবব্রত–সৌমিত্র জুটি। এখানেও দর্শক ছিলেন সপরিবারে অশ্রুবাবু এবং শঙ্খবাবু। সেখান থেকে গেস্টহাউসে ফিরে নাটকের রেশ ধরেই আমাদের গল্পগাছা। আমরা বসেছিলাম গেস্টহাউসের অফিসলাগোয়া ১নং ঘরে। ওখানেই শঙ্খবাবু ছিলেন।

জানি আলোচনাসভার কথা এ প্রসঙ্গে আসে না, আমরা যাবও না। কেবল বলব, পূর্বশর্ত অনুযায়ী শঙ্খবাবু সেই আলোচনাসভার বক্তা ছিলেন না। আগাগোড়া তিনি চুপ করে ছিলেন। তখন তাঁর শরীর বিশেষ করে গলার অবস্থা ভাল ছিল না, ডাক্তাররা বিশ্রাম দিতে বলেছিলেন। উদ্যোক্তারা চেয়েছিলেন তিনি কথা না বললেও উপস্থিত থাকুন। তাঁর উপস্থিতি এমন একটা আবহ তৈরি করে, যা ভেতরে ভেতরে আলোচনাকে সমূদ্ধ করে। তাছাড়া তাঁর সামনে বলতে পারার সুযোগ অনুজ বক্তাদেরও উদ্দীপিত করে। সভায় কথা না বললেও তিনি অনেকেরই অনেক জিজ্ঞাসা অনুচ্চকন্ঠে মেটাচ্ছিলেন। ছাত্রছাত্রীরাও তাঁর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়নি।

নাটক দেখে ফিরে আসার পর আমরা স্যারকে ঘিরে বসি স্যারের অস্থায়ী আবাসে, অর্থাৎ অফিসসংলগ্ন গেস্টহাউসের নীচের তলায়। ছিলেন  সস্ত্রীক অশ্রুবাবু, সৌমিত্রদা, শিবব্রতদা, কবিবন্ধু অধ্যাপক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। কথা শুরু হয় সদ্য দেখে আসা নাটকটি নিয়ে। অনুচ্চস্বরে স্যার তাঁর ভাললাগার কথা জানাচ্ছিলেন। স্যার যেভাবে ‘বিসর্জন’ পড়িয়েছেন, যেভাবে পড়ার কথা বলেছিলেন, সেই পাঠকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখি আমরা নাটকে।ঘরে বাইরের দ্বন্দ্বে রাজা গোবিন্দমাণিক্যের বেদনাবোধ, দায়বদ্ধতা আর বিবেকের টানাপোড়েনে জয়সিংহের রক্তক্ষরণ, মানবিকবোধের উত্তরণে রঘুপতির ভেঙে পড়া –– আর একবার স্যারের মুখ থেকে আমরা শুনছিলাম, সংলাপের ওঠানামায় কীভাবে রবীন্দ্রঅভীপ্সা মূর্ত হতে পারে।সংলাপের কোন কোন জায়গায় পরতে পরতে খুলে যায় চরিত্রের জট, কোথায় ছোঁয়া যায় আবেগের উচ্চাবচতাকে আর দ্বন্দ্বমুখর নাট্যধর্মকে, স্যার আপনমনে বলে যাচ্ছিলেন। আমরা ছিলাম নিবিষ্ট শ্রোতা। বোঝা যায় স্যার খুব খুশি হয়েছেন আজকের নাটক দেখে।

কথা প্রসঙ্গে এসে যায় রবিবারের আড্ডার কথা। তবে সে আড্ডায় স্যার প্রায়শই থাকতেন শ্রোতা, আর এখানে তিনি প্রায়শই বক্তা। শিবব্রতদা বা সৌমিত্রদা মাঝে মাঝে মেলে ধরছিল নানান জিজ্ঞাসা, কখনও কথার পিঠে কথা। বাকিরা চুপচাপ ছিলাম। বাইরে রাত বাড়ছে আর একটা আবেশ ঘিরে ধরছে আমাদের। কত রকমের মানুষ আসে রবিবারের আড্ডায়, কত রকমের প্রসঙ্গ আলোচনা হয়, মাঝে মাঝে মূদু তর্কাতর্কি –– আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম স্যারের মুখে। কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, পরিচালক, নট ও নাট্যকার, রবীন্দ্রজিজ্ঞাসু, ছাত্রছাত্রী –– এরা তো আসতই, সঙ্গে আসতেন সমাজের নানান স্তরের মানুষ। প্রতিবাদী সমাজকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী, হকার, স্বনিযুক্তি প্রকল্পের মানুষ, রাজনীতির মানুষ, আরও কত। সবার জন্য ছিল অবারিত দ্বার, সমান আপ্যায়ন।কয়েকজনের কথা স্যার বলেছিলেন। অনেকের কথা লিখেছিলেন পরবর্তী কালে ‘বট পাকুড়ের ফেনা’ বইতে। আমরা চোখে দেখতে পাই প্রত্যেককেই কবি এগিয়ে দিতে যাচ্ছেন দরজা পর্যন্ত। না, এটা অবশ্য স্যার বলেননি, আমাদের অভিজ্ঞতা।

একজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে। তিনি জীবনানন্দ–গবেষক, কবি ও বিশিষ্ট হূদরোগবিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসক ভূমেন্দ্র গুহ। খুব ভাল মানুষ কিন্তু সহজেই রেগে যান। তাই কেউ কেউ তাঁকে রাগিয়ে একটু মজা পেতেন। ‘‘এরা কি মানুষ? আপনার এখানে আবার মানুষে আসে?’’ ––একথা বলে মাঝেমাঝে গজগজ করতে করতে উঠে যান ভূমেন্দ্র গুহ। বোঝা যায় কেউ খেপিয়ে দিয়েছে। অন্যরা অপমানিত এবং ব্যস্ত হলেও শঙ্খবাবু খুব বেশি ব্যস্ত হন না। বরং স্মিত হেসে বাকিদের আশ্বস্ত করেন।তারপর বলেন, এরকম নাকি আগেও অনেকবার হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত কয়েকদিন পরে ভূমেন্দ্র নিজেই ফোন করেন এই আড্ডার মধ্যমণিকে, ‘‘আগামী রবিবার আমি কি আসতে পারি’’? পুরানো প্রসঙ্গ তুলে লজ্জিত না করে তিনিও যথারীতি হেসে বলেন – ‘‘অবশ্যই, আমি তো আসতে বারণ করিনি।’’দু–এক সপ্তাহের বিরতির পর ভূমেন্দ্র আবার যথারীতি আসতেন। এই স্মূতিলেখক জীবনানন্দের ওপর গবেষণা করেছে, ভূমেন্দ্র গুহের লেখা পড়ে খুবই ঋদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ভুমেন্দ্র গুহের সঙ্গে আলাপ ছিল না। স্যারের কথার ভেতর দিয়ে আলাপ হয়ে গেল।

তখন আশির কাছাকাছি বয়স স্যারের। কিন্তু সারাদিনের ধকলের পরেও অক্লান্ত। খাওয়ার পরেও স্যার আর একপ্রস্ত লেখাপড়া নিয়ে বসবেন। এই অভ্যাসের কথা আমরা জানি। তাই এবার উঠে পড়লাম। তখন আর একটা জিনিস দেখলাম।  ল্যান্ডফোনে অভ্যস্ত স্যার, মোবাইল ধরতে পারেন না। বাড়ি থেকে প্রতিমাদি একটা মোবাইল দিয়ে দিয়েছেন পকেটে, বলে দিয়েছেন ফোন করলে যেন ধরেন স্যার। কিভাবে ধরতে হবে তাও নিশ্চয়ই দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্যার তো ফোন করা শেখেননি। অথচ বাড়িতে তো খবর দিতে হবে। তাই আমাদের বললেন বাড়ির নম্বরটা ধরে দিতে।

স্যার চলে গেলেন, অশ্রুবাবু আগেই চলে গেছেন। ভূমেন্দ্রবাবু তারও আগে। তাঁদের সূষ্টি তাঁরা রেখে গেছেন, সান্নিধ্য এখন কেবল স্মূতি।অনেকের অজস্র সুখস্মূতি। আমাদের অল্প। কলকাতা থেকে অনেক দূরের মানুষ আমরা। ক্লাসের বাইরে স্যারের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ ছিল আমাদের কম। তাই এইসব স্মূতি আমাদের সম্পদ। এই অবসরে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম।

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অনেক স্মৃতি থেকে যায় । তা থেকে বহু অজানা জানা হয়। আবার অনেক হারিয়ে যায় । তপনবাবুর কথা ধরে ভুবনডাঙা সেই অসাধ্য সাধন করেছে । কিছু হলেও হারিয়ে যেতে দেয় নি

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন