প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকার সঙ্গে জড়িত 

-----------------------------------------------------

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

               "ভুবনডাঙা" পত্রিকায় পরপর এমন দুজন মানুষকে নিয়ে লিখতে হলো যাঁদের সঙ্গে আমার কোনো সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। তাঁরাও আমাকে চিনতেন না। যদিও তাঁদের কবিতার সঙ্গে আমার যথেষ্টই পরিচয় ছিল। একজনের কবিতার সঙ্গে তো স্কুলে পড়া থেকেই পরিচয়। 

               তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। "অন্নদামঙ্গল"-এর অংশবিশেষ আমাদের পাঠ্যে ছিল। সেখানেই প্রথম পড়ি "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে"। লাইনটার মানে আমাকে আলাদা করে কাউকে বলে দিতে হয় নি। কারণ নিজের বাবাকে চোখের সামনে দেখেছি। কি অপরিসীম ত্যাগ। ভীষণ অভাবের মধ্যে মানুষ হয়েছি কিন্তু একদিনের জন্যও সেই অভাব আমাদের বুঝতে দেন নি। নিজের যা হয় হোক কিন্তু নিজের সন্তান যেন ভালো থাকে। ঠিক এই সময়েই কানে আসে ( বই থেকে পড়ি নি ) "ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।" কবিতার নাম কি, কবি কে ----- এসব কিছুই জানি না। কিন্তু শুনে মনে হলো, এ যেন আমার চেনা কবিতা। নিজের বাবাকে দেখে এমন কবিতা তো সন্তান লিখে

ফেলতেই পারেন। অথবা কবি নিজেই পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লিখে ফেলেন এমন এক কালজয়ী কবিতা। মনে হয়েছিল এ আমার প্রাণের কবিতা। একটু বড় হতেই জানতে পারি কবিতার নাম "বাবরের প্রার্থনা" আর কবি হলেন শঙ্খ ঘোষ। একটু বড়ো হতেই বইটি কিনে ফেলি। ১৯৮৬ সালে বইটির দাম ছিল মাত্র ছ' টাকা। প্রচ্ছদ কবি শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীর। বইটি প্রকাশ করছিলেন দে'জ। আমি যখন বইটি কিনি তখনই সতেরটি সংস্করণ হয়ে গেছে। 

               কোনোদিন তো তাঁর মুখোমুখি হই নি। আজকের সময়ের ছেলে হলে হয়তো যেমন করে হোক কাছে গিয়ে একটা ছবি তুলে এনে ফেসবুকে পোস্ট করে জানান দিতাম আমার দৌড়টা ঠিক কতদূর পর্যন্ত। কিন্তু আমার শিকড়টা যেহেতু একটু হলেও পুরানো তাই এই ইচ্ছাগুলোর কোনোটাই আমার ছিল না। সত্যি বলতে কি যাওয়ার ইচ্ছাও কোনোদিন জাগে নি। হয়তো নিজের দৌড় সম্পর্কে সচেতন ছিলাম বলেই। আসল দরকার তো কবিতা নিয়ে, সেটা সবসময় চেখের সামনে রেখেছি।

               শুধু আজ বলে নয়, শঙ্খ ঘোষ নামটা মনে এলেই মনে হতো একটা গাছ। আর তাকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু মানুষ। মানুষটা চুপ করে একটা জায়গায় বসে আছেন আর মানুষগুলো তাদের সুখ দুঃখের কথা একের পর এক বলে যাচ্ছে। প্রয়োজন হলে মানুষটা একটা কি দুটো কথা বলছেন। সেইটুকু নিয়েই বাড়ি ফিরে আসছে মানুষের দল। আসলে তারা যে তাদের সুখ দুঃখের কথা তাঁকে জানাতে পারছে এটাই তাদের বড়ো পাওয়া। 

               একজন কবির কবিতার কত দিক থাকতে পারে। কত কত দিক থেকে একজন কবির কবিতা রাষ্ট্র সমাজ মানুষকে সচেতন করতে পারে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা সেই গোত্রেরই কবিতা। "মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে" কবিতাটি তো আজ প্রবাদে পরিণত। কবিতাটির শেষ দুটি স্তবক আমাদের চোখের ওপর অনেক কিছু দেখিয়ে দেয় -------

"বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া 

                   তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত 

নিওন আলোয় পণ্য হলো 

যা - কিছু আজ ব্যক্তিগত। 


মুখের কথা একলা হয়ে 

               রইল পড়ে গলির কোণে 

ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু 

ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে। "

               "আকন্ঠ ভিক্ষুক" কবিতাটির দিকে যদি তাকাই তাহলে সে আমাদের কানে কানে এমনসব কথা শোনায় যা আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে যায় জীবনের কেন্দ্রে ------

"আকন্ঠ ভিক্ষুক, তুমি কথা বলো গৃহস্থের কানে 

ভাঙো তার সব স্থবিরতা 

ঝরাও প্রপাত তার সাবেক কার্ণিশগুলি থেকে 

পাঁজরে বাজাও বাঁশিগুলি

গুনগুন নাচাও তাকে ভিড়ের আবর্তে পথে পথে 

তারপরে দেখো আরো কতটুকু অশরীরী 

                               মূর্খতা শরীরে লেগে থাকে। "

               "যদি" কবিতাটি চোখের সামনে মেলে ধরলে দেখতে পাই মাটির কাছাকাছি থাকা একজন মানুষ। পার্থিব সম্পদে সম্পদশালী আমাদের সমস্ত চাওয়া পাওয়া যেন ওলট-পালট করে দেয়। কবি উপস্থিত করেন এক অন্য মানুষের ছবি  ------

"যদি আমি দেশ হয়ে শুয়ে থাকি আর এই বুকের উপরে যদি চলে যায়  / হাজার হাজার পা-র চলাচল  / রক্তের ভিতরে শুধু বয়ে যায় জলস্রোত প্রতিটি রোমাঞ্চে যদি  / ধান জেগে ওঠে  / কান পেতে শুনি যদি মাঠ থেকে ফিরবার অবিরাম জয়ধ্বনি  / চন্দনার গান / প্রতিটি মুখের থেকে যদি সব বিচ্ছেদের হেমন্তহলুদ পাতা / ঝরে যায়  / হাত পেতে বলে যদি, এসো ওই আল ধরে / চলে যাই সেচনের দেশে / যদি মাটি ফুলে ওঠে আর সব খরা ভেঙে / ছুটে আসে বিদ্যুতের টান ------ / হতে পারে, সব হতে পারে  যদি এই মহামৃত্তিকায় আমার মুখের দিকে  / ঝুকে থাকো আকাশের মতো। "


               শঙ্খ ঘোষ আমাদের প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকার সঙ্গে জড়িত। তাঁর কবিতার কাছ থেকে আমরা প্রতিদিন শিক্ষা পাই। তাঁর কবিতা শুধু বাংলা ভাষার মানুষের কাছে নয়, মানুষ জাতির কাছে বড় অবলম্বন। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন