"আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি"

অণিমা মিত্র


তিনি চিত্তপ্রিয় ঘোষ। তিনি অমলাবালার সন্তান। মণীন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁর পিতা।  তিনি চিত্তপ্রিয়। ভিতরে ভিতরে চোরাবালির মতো সবার শ্রদ্ধা- সম্ভ্রম পেয়ে এসেছেন তাঁর বৈদগ্ধ প্রজ্ঞা-আলোয়। তিনি যাদবপুর ও দিল্লিতে এবং বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেছেন। কতো যে পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন! হ্যাঁ, তিনিই আমাদের বাংলা সাহিত্যের কোহিনুর , যিনি এই তো পশ্চিমের স্থায়ী অধিবাসী হ'লেন। তিনিই আমাদের কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর একটিমাত্র উত্তরীয়। বাংলাভাষার সম্মানিত - সুশিক্ষিত সন্তান। 


যে কবিতা আমাদের হৃদকমলকে নাড়া দেয় আজও, সেই ' বাবরের প্রার্থনা ' র জন্য ১৯৭৭ এ পেলেন সাহিত্য একাদেমি ' পুরস্কার।

আহা , এমন উচ্চারণ! কী প্রচণ্ড ঋতবাক যে তাঁর জিহ্বা থেকে উদ্গাত হয়: আজ বসন্তের শূন্য হাত। ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

আমরা জানি, বসন্ত ঋতু জীবনের সংগীত। সেই বসন্ত যখন রিক্ত হস্ত, তবে আর জনকের কি প্রয়োজন? তাঁর সন্ততি ভাবনাতেই বেঁচে থাক, যেখানে কোন ' মার ' এর প্রবেশাধিকার নেই। বড়ই মরমী আমাদের কবি। প্রায় একশতক ধরে তিনি বাংলা ভাষা-জননীর বরপুত্র ছিলেন। সময় হয়েছে প্রতীচীদেব সান্নিধ্যের। আর কী কখনো প্রতিবাদী মঙ্গল-শঙ্খ বেজে উঠবে আমাদের সমাজে? 

২০১৬ তে পেলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ' বটপাকুড়ের ফেনা ' র জন্য।  তিনি যে লিখলেন, ' মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে '! কতো সহজেই না বুঝেছেন কবি, আমাদের যতো না জানা, জানার অধিক প্রপাগাণ্ডা।  কতোটা মার্জিত স্বভাবী হ'লে এমন মৃদু ভর্ৎসনা! কোন রূঢ় পরুষ ভাষা নয়, মিষ্টি আলঙ্কারিক শব্দের সমাহারে আমাদের চারিত্রিক শোধন চেয়েছেন তিনি। এমন কবি তো ক্ষণজন্মা-ই হন। ঐ যে তিনি লেখেন, না পড়েন, ' ধুম লেগেছে হৃদকমলে ' আমাদের হৃদয় দ্বিপথগামী। তিনি একবগ্গা। একরোখা। He calls spade a spade. এমনই ঋজুরেখ তিনি তাঁর ধ্রুবপদে।


লোকে বলবে, ' মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়!' 

কীই বা আসে যায় তাতে? লোকে বড্ড বেশি কথা বলা-কওয়া করে। কবি , কথা চান সংযত। কাজ চান অপরিমিত সমাজ-সংসারের জন্য।  তাই কবি বলেন,"মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পড়ে নিই মানবশরীর...।" কেমন ছিলো বরিশালের মাটি - জল- হাওয়া মাখা এ কবির শরীর?  জীবনানন্দের মতো মিতভাষী হয়েও স্পষ্টবাক। তাঁর প্রতিটি কবিতায় রয়েছে সত্যস্ফুলিঙ্গ।

কেমন সেই সত্যের তেজস্ফুলিঙ্গ? আজীবন রাজনৈতিক সত্তার সাধনা। একেক সময় আমার ইচ্ছে হয় বলি, আমাদের জানা রবীন্দ্রনাথের পরেই উচ্চারণ করি শঙ্খ ঘোষকে। বরিশালের জীবনানন্দ কবিতায় রূপক গ্রহণ করেছেন প্রতিবাদের জন্য। আমাদের জানায় তিনি মুখচোরা ছিলেন, বরং এভাবে বললে বলা যায়, তিনি ছিলেন স্বভাবে অন্তর্মুখী।

শঙ্খ ঘোষও অন্তর্মুখী হয়েও লাজুক ছিলেন না। ছিলেন স্পষ্টবক্তা। যেটা তাঁর মনে হয়েছে অন্যায়, আত্মাবিরোধী, সেখানেই তিনি ঋজু প্রতিবাদী। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে বার বার তিনি প্রতিবাদী কলম ধরেছেন তাঁর নিজের মতো করে। 

তিনি প্রশ্ন রাখেন দৃপ্ত ভঙ্গিতে: আমার কথা কি বলতে চাও না?  তাঁর ' বহিরাগত ' তে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকদের উদ্দেশে বলেন,"উঁচু স্বর তুলে কথা বলে যারা জেনে নাও তারা বহিরাগত। --চালার উপরে ঝুঁকে পড়ে চাঁদ বহুদূর থেকে বহিরাগত।


শেষে বলেন, " বর্শাফলকে বিষ মেখে নিয়ে কালো মুখোশের আড়ালে যত বহিরাগতরা এসে ঠিক ঠিকই বুঝে নেয় কারা বহিরাগত।"

কবিতায় তিনি কোন অবিস্পষ্টতা হাতিয়ার করেননি , যেমনটি আমরা আরেক বরিশালের কবির ক্ষেত্রে পাই এবং আমরাও রূপক- সংকেত-ধর্মী কবিতায় মগ্ন।

না, কবি শঙ্খ ঘোষ কোন  নীতিবাণীর জিগির তোলেননি তাঁর কবিতাতে অথবা অযথা ভারি জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য কোথাও রাখেননি। তাঁর শীলিত জীবনচর্যা থেকেই তিনি নাতিউচ্চ মৃদুভাষী হয়ে বিলম্বিত লয়ে বলতেন এবং লিখতেন। 

বাংলা কবিতায় তিনি আমাদের এক অন্য ভুবন দেখান-- চেনান, বরং যদি বলি, কবি বাংলা কবিতার মুখ ঘুরিয়ে দেন। ' বাবরের প্রার্থনা- মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে--গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ তাঁর অনন্যতার অভিজ্ঞান।

গবেষণামূলক গ্রন্থ: ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ-- শব্দ আর সত্য-- উর্বশীর হাসি-- এখন সব অলীক ---এসব তো বাংলার বুধমণ্ডলীর চর্চিত আড্ডা। ২০১৯ এ ' সন্ধ্যানদীর জলে ' মূলত বাংলাদেশ নিয়ে তিনি লেখেন। ভুলতে যে পারেন না তাঁর জন্মভিটেকে! 

কবির লিখিত সমস্ত বই-ই এভাবেই দুই বাংলায় আদরের চর্চা।

' সন্ধ্যানদীর জলে ' একটি ভ্রমণপঞ্জি ও অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণের সংকলন। 

তাঁকে আমরা দেখি আদ্যন্ত রবিভাবনায় জারিত। এতেই তিনি প্রসিদ্ধ। ধবধবে সাদা ধুতি- পাঞ্জাবি-র কবিকে দেখে মনে লাগে, তিনি দূরের তারকা। তফাতে থেকেই দেখা। তাই কী! না, তিনি চাইছেন," চল বেঁধে বেঁধে থাকি।" আর কী ফিরে পাবো এ কবি-কে!  না, আর ফিরে আসবে না এই বাঙ্ময় আশ্বাস। এ কবি চাইতেন, অন্য সকলের মতো; তাঁরও যে লোকসান্নিধ্য চাই। ওইটুকুই , ওই উষ্ণতাই তাঁর দিনের অক্সিজেন। অথচ কবি স্বল্পবাক। তিনি স্থিতধী। তীনি স্থির প্রত্যয়ে ভরপুর। তাঁকে কেউ না বাঁয়ে না ডানে না সামনে অথবা পিছনে -- কোনদিকেই হেলাতে পারেনি। তিনি চলেছেন তাঁর ধ্রুবপথ ধরে। হঠাৎ হেলে গেলেন পশ্চিমের আকাশে। ঘরে তাঁর প্রাণ- প্রতিমা তাঁর অপেক্ষায় থেকে কবি-ছায়া-সঙ্গিনী হ'তে চলে গেলেন সেই অন্য কিন্নরভুবনে। 

এমন কবি ব্যক্তিত্ব বিরল যে! কতো না লোকের কতোদিকে হেলদোল! কবি যেন নিজেই তর্জনী। লোকে তাঁকে ভাবে ,' সামাজিক দূরত্বের কবি। কবি বলেন: বেঁধে বেঁধে থাকি।

কবি, আপনাকে জানার এখনও অনেক বাকি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন