জীবন থেকে কবিতায় এবং কবিতা থেকে জীবনে ফেরা 

( প্রাবন্ধিকের কলম )

আফজল আলি 


পৃথিবীতে এত কিছু বিষয় থাকা সত্ত্বেও, এক একটা সময় লেখার মতো কিছু থাকে না, কোনো কিছুই মাথায় আসে না।  যেন মনে হয় কিছু বলতে পারছি না নতুন করে।  অথচ কবিতা লিখতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।  বিষয় ভিত্তিক প্রবন্ধ লেখা যেমন কষ্টকর , কারণ ওই নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর পড়াশোনা , দক্ষতা তৈরি করতে হয় , না হলে বিষয় ভিত্তিক প্রবন্ধ লেখা কঠিন।  বিষয় ভিত্তিক প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে লেখক অনেক সময় নিজের ভাবনাটি সুরক্ষিত করতে পারেন না বা করতে চান না , তিনি ক্রমান্বয়ে অন্যের উদ্ধৃতি লেখার মধ্যে এনে তাঁর ভাবনাটিকে সমৃদ্ধ এবং সমর্থন করাতে চান । এটি একটি positive দিক । সেক্ষেত্রে লেখক নিজের মতামত বা ধারণাটিকে প্রকাশ নাও করতে পারেন।  বিভিন্ন জনের মতামত ভাবনার সমাহারে বিষয়টিকে তাঁদের ভাবনার নিরিখে প্রকাশ করেন। এবং নিজের ভাবনাটি ব্যক্ত করেন না।  এটি একটি দিক । আবার লেখক যখন বিষয় সম্পর্কে  নিজের ভাবনাটি প্রকাশ করেন এবং তাঁর ভাবনার নিরিখে যুক্তি সাজান এবং সেই যুক্তির সমর্থনে quotation ব্যবহার করেন , ব্যবহার করেন বিভিন্ন কবি সাহিত্যক বা চিন্তাবিদদের উদ্ধৃতি বা বক্তব্য।

এটি হল কোনো বিষয় সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব ভাবনাকে শক্তিশালী করা । আবার এমন হতে পারে লেখক কোনো বিষয় সম্পর্কে কেবল নিজের অবস্থান মতামত বিশ্লেষণ প্রকাশ করে চলেছেন  , প্রকাশ করছেন নিজস্ব ভাবনার এবং চেতনাবোধের সুগন্ধি নির্যাস,  তখন তাঁর প্রয়োজন পড়ছে না অন্যের ভাবনার সাহায্য নেওয়া কারণ লেখক বা প্রাবন্ধিক সেই বিষয়টিকে নিজের মতো করে আত্তীকরণ করতে পেরেছেন এবং সেই সম্পর্কে নিজের ভাবনার স্পষ্ট এবং পরিস্কার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আরো একটি মৌলিকতার উন্মেষ পাঠক দেখতে পান , পাঠকের বুদ্ধির দরজায় নতুন ভাবে আলোক ধারা সঞ্চারিত হয়।  এবং অবশ্যই দরকার লেখকের বা প্রাবন্ধিকের মুন্সিয়ানা।  কিন্তু বিষয়টি যদি এমন হয় লেখক বা প্রাবন্ধিক তাঁর লিখিত  বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করতে পারেননি  , হয়তো বিষয়টিকে তিনি অনুধাবন করতে পারেননি , বিষয়টি তাঁর কাছেই স্পষ্ট নয় , কিন্তু তিনি ওই সম্পর্কে লিখছেন , নানান quotation ব্যবহার করছেন এবং ভাষার মোড়কে সমগ্র বিষয়টিকে করে তুলছেন একটি জটিল ধোঁয়াশা যুক্ত যা পড়লে একটা ঘূর্ণাবর্ত ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না  । পাঠক বিভিন্ন শ্রেণীর আছে । যে সব পাঠক প্রাবন্ধিকের লিখিত ভাবনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় সঠিক ভাবে  ,তাঁদের কাছে এ সব লেখা কিছুটা জ্ঞানের সমন্বয় হতে পারে  , কিন্তু যে পাঠক আগে থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানে অনেকটা বিস্তারিত এবং নিজস্ব ভাবনাটিকে অনেক এগিয়ে রেখেছেন , সেই সব পাঠকের কাছে প্রাবন্ধিকের সেই ঘূর্ণাবর্তের লেখা একটি বৃথা শ্রম বলেই মনে হবে । কারণ কিছু কিছু পাঠক ভাবনা বা ভাবনা বিস্তারের মৌলিকতা পছন্দ করেন।  যখন লেখক বা প্রাবন্ধিকের চিন্তার থেকে কোনো কোনো পাঠক এগিয়ে থাকেন তখন সেই সব প্রবন্ধ সেই পাঠকের কাছে একটা বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।  কাজেই প্রাবন্ধিকের উচিত লিখিত বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করা , না হলে কেবলই এক বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়ে থাকবে ।


যে সমস্ত বিষয়বস্তুর সাথে বিজ্ঞানের প্রভাব জড়িয়ে আছে,  জড়িয়ে আছে দর্শনের প্রভাব,  সেই বিষয়ে লিখতে হলে লেখককে অবশ্যই বিজ্ঞান এবং দর্শনের টুকিটাকি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে  , নচেৎ তাঁর লেখা একটি অসমাপ্ত এবং অজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন ছাড়া আর কিই বা হতে পারে।  মাঝে মাঝে এটা আমার মনে হয় যে একজন বিজ্ঞানের শাখার মানুষই যিনি সাহিত্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল  , তিনিই এগুলো সঠিক অনুধাবন অনুভব করতে পারবেন। কেবল সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা প্রাবন্ধিকের পক্ষে তা সঠিকভাবে অনুধাবন সম্ভব নয়  , যদি না বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা  করেন । কারণ মৌলিক চিন্তা প্রকাশ আলোচনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ঢুকে যায় বিষয়ের প্রয়োজনে , এড়ানো যায় না।  সাহিত্যের বিষয় আলোচনার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন সাহিত্য মনস্ক মানুষ বা একজন সাহিত্য প্রেমী সঠিক সদর্থক ভূমিকা রাখতে পারেন , এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । সাহিত্য যেমন  যে কোনো বিষয়কে ধারণ করতে পারে,  তেমনি যেকোনো শাখার মানুষ ও সাহিত্যে বিচরণ করতে পারে , এ বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।  কিন্তু আলোচনার বিষয় যখন কোনো গবেষণালব্ধ বা পরীক্ষামূলক সাহিত্যধর্মী যেখানে কোনো মতবাদ বা দর্শন চিন্তার প্রয়োগ করা হয় সাহিত্যে , যেখানে কিছুটা হলেও বিজ্ঞান মনস্কতা চলে আসে , সেখানে বিজ্ঞানের বা দর্শনের basic কিছু জানা আবশ্যক।  না হলে আলোচনা নিছকই এক ধোঁয়াশার আবর্ত ছাড়া কিছু হয় না।  সেক্ষেত্রে কেবল quotation দিয়ে দায়সারা কাজ ই  হয় , ভ্রম তৈরি করা হয় ।


আবার যখন কোনো ভুল ধারণার উপর কেউ দীর্ঘ প্রবন্ধ বা বই লেখেন , যে ধারণা বিজ্ঞান স্বীকৃত নয়  ,  নেই লজিকের মান্যতা , যা কেবলই এক ভুল চিন্তা ছাড়া কিছু ই নয় , বাস্তবে তার উপস্থিতি হওয়ার নয়  , তা কীভাবে মান্যতা পাবে । ঠিক এই জায়গাতেই আমার বক্তব্য।  সাহিত্যে কোনো কিছু নতুন দিশা বা নতুন ভাবনা বা নতুন চিন্তনের ক্ষেত্রে তার বিশ্লেষণ প্রকাশ এবং ব্যক্ত বিজ্ঞান ও  যুক্তির দ্বারা পরীক্ষিত হওয়া খুবই প্রয়োজন।  না হলে সেই চিন্তন ভুলের ধারক হিসেবেই চিহ্নিত হবে। দর্শনকে যেমন বিজ্ঞানের মতো পরীক্ষালব্ধ হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে না  ,  কারণ দর্শন নতুন কিছু বলতে চায় যা exactly আগে ছিল না  , এবং সেই বলা বা চিন্তন একশো ভাগ সত্য বা একশো ভাগ মিথ্যা  তা প্রমাণ করার ও  দায় থাকে না।  কিন্তু কোনো চিন্তন বা মতবাদ কতটা গ্রহণযোগ্য তা বুঝতে পারা যায়।  পড়াশোনার ফসল হিসেবে ভুল চিন্তাকে যদি কেউ আত্তীকরণ করতে থাকে তাহলে যুক্তিগ্রাহ্যতার নিরিখে তা বাতিল এবং ফাঁপা বলেই গণ্য হবে । একদিন না একদিন প্রকাশ্য হবেই।  যারা প্রবন্ধ লেখেন তাঁরা কি এই বিষয়গুলো তলিয়ে দেখেন এবং যা পাঠকের জন্য নির্ধারিত করে দিচ্ছেন তা আদৌ কতটা সঠিক।  সাহিত্যে সঠিক ভুল বলে কিছু নেই।  যেমন যখন একটি কবিতা লেখা হয় তখন কবিতার ভাব বা কবিতার অন্তরের বিভাব , বক্তব্য একশো ভাগ সঠিক হতে হবে এমনটা নয় । আবার একশো ভাগ বেঠিক তাও বলা যাবে না।  বাস্তব জগতে না হলেও কাল্পনিক জগতে সাহিত্য একশো ভাগ সঠিক হতে বাধ্য এবং হয় । এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ-ই নেই।হতে পারে সেই জগতটি পরাবাস্তব । কোনো কবিতা বা গল্পের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন প্রাবন্ধিক বা লেখক তাঁর ইচ্ছে মতো ভাব প্রকাশ করতে পারেন , এ ব্যাপারে কেউ তাঁকে বাধা দেওয়ার নেই । এ ব্যাপারে প্রাবন্ধিক সম্পূর্ণ স্বাধীন। 


রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতাটিকে বিশ্লষণ করলে দেখা যাবে সেখানে জীবন থেকে  মৃত্যুর এক পারাবার এবং মৃত্যুর পূর্বে মাঝি রূপে এক ত্রাতাকে দেখা গেছে যিনি জীবনের যা কিছু সঞ্চয় তা নিতে এসেছে।  এবং আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলিয়ে দেবার প্রয়াস । এইভাবে প্রতিটা স্তবকে কবি নানান রূপক বহন করে নিয়ে গেছেন , আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে এই জীবন এবং সঞ্চয় ত্যাগ করার কল্পনাতে। আবার কিছুটা আনন্দ থাকে পরমাত্মার সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষায়।  এখন এই বিষয়টি যদি কেউ অন্য ভাবে  , অন্য ভঙ্গিতে  , অন্য দৃষ্টিতে বর্ণনা করেন  , তাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।  বরং তা হবে ভিন্নতর রস আস্বাদনের এক দ্যোতনা । এবং যে কেউ কবির ভাবনাকে নিজস্ব উপস্থাপনর রঙে রাঙাতে পারেন । কোনো দোষ নেই।  কিন্তু বিষয়টি যদি এমন হয় যে আলোচনা করতে হচ্ছে আধুনিকতাবাদ,  কাঠামোবাদ, উত্তর আধুনিকবাদ , উত্তর কাঠামোবাদ , বিনির্মাণবাদ বা ডিকনস্ট্রাকশন,  বা দর্শন সম্পর্কিত বস্তুবাদ ভাববাদের নিগূঢ় সনদ , তখন কেবল আপন কেবল আপন কল্পনা বিস্তারের দ্বারা প্রভাবিত হলে চলবে না।  সেখানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষণ জরুরি  , এবং বিষয়কে ভুল দিকে চালিত করা যৌতিকতা নয় । তাই খেয়াল রাখা অবশ্যই জরুরি যাতে পাঠক বিভ্রান্তির স্বীকার না হয়ে পড়ে। আমি নিজে বেশ কিছু প্রবন্ধ পড়েছি এবং আমার এইরকম ই  মনে হয়েছে।  আজ বিষয়হীন সম্পর্কে দু চার কথা লিখতে গিয়ে দেখি বিষয় একটা চলেই এল । আলোকপাত করলাম কিছুটা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন