রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার

আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সংযুক্তা পাল

পর্ব-৭


ব্যতিক্রমী নারী চিন্তনের যে অভিঘাত  বাংলা কবিতার মুখ ঘুরিয়ে দিল সমর সেন এর হাতে পরবর্তীকালে আরও ব্যতিক্রমী স্বতন্ত্রতায় প্রকাশ পেল সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর নারী ঘরানা। গার্হস্থ্য রাজনীতি, বৃহত্তর সামাজিক বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবী চিন্তাধারায়,শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবৈষম্যের মত সামাজিক ইস্যু এমনকি কলকারখানা, মিটিং-মিছিলে নারীরা একাত্ম হয়ে গেল।নারীর সৌন্দর্যে কোন মিস্টিকতা নেই,নেই এতটুকু ভাসমানতা আবার সমর সেন এর উর্বশীদের মত কেবল পাঁকের পুঁতিগন্ধময় নাগরিক দুর্বিষহ সস্তা শরীরী উপলব্ধির মধ্যেও বদ্ধ নয় সুভাষ রচিত নারী সমাজ। নারী মানে আশ্রয়–প্রতিদান পাওয়ার এই চূড়ান্ত ইচ্ছার একমাত্র বহিঃপ্রকাশ নয়, তার বাইরেও আরও বৃহৎ কিছু; নারীর প্রতিস্পর্ধিতায়,

ভাবনায়,মনন ও মেধায় থেকে যাওয়া নিজের সামাজিক ও রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিক জটিলতাও যে পুরুষের পাশাপাশি একান্তই স্বাভাবিক, এবং সেই অভিব্যক্তির শুরুয়াদ ঘরের চারদেয়াল থেকেই ঘটে যেতে পারে... নারীর সংগ্রামের ইতিবৃত্ত যে আসলে ঘর থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বহির্জগতে তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর কবিতাতেই আমরা পাই।

এর কারণ সুভাষের ব্যক্তিজীবন, পার্টির সক্রিয় কর্মী সুভাষ তাঁর স্ত্রীকে একই সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে বিভিন্ন ভূমিকায় শেষ জীবন পর্যন্ত অবতীর্ণ হতে দেখেছেন। এছাড়াও তাঁর চোখে দেখা, ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায় রয়ে যাওয়া এমন অসংখ্য নারীকে তিনি দেখেছেন যাঁদের প্রভাব তাঁকে দিয়ে সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছে এক স্বতন্ত্র নারী ভাবনার ইতিহাস। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নিজের এবং চারপাশের দেখা জীবন যে তাঁর কবিতা রচনায় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল তা তিনি নিজেই স্বীকার করছেন-

' সবই ঘুরে বেড়িয়ে চোখে দেখে কানে শুনে লেখা।'

ব্যক্তি থেকে সমষ্টির অভিসারী এই কবি যত পরিনতির দিকে যাত্রা করেছেন তত সমষ্টির মধ্যে থেকেই ব্যক্তি জীবনকে খুঁজে পেয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত এই সামাজিক কবির কবিতায় কখনো উঠে এসেছে  'মিছিলের মুখ' কিংবা ' 'সালেমনের মা', 'কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো' মেয়ের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা আবার কখনো 'লড়াকু সংসার' এর ছবি।দেখা দিল নানা রূপে নারী–মা, বোন, মেয়ে,বউ–নৈর্ব্যক্তিকভাবে তাদের দেখছেন কবি, নির্লিপ্ত ভাবে নয়।কবি যখন বলেন–


" পাগল বাবরালির চোখের মত আকাশ।/তার নিচে পাঁচ ইস্টিশান পেরনো মিছিলে/বারবার পিছিয়ে প'ড়ে/বাবরালির মেয়ে সালেমন/খুঁজছে তার মাকে।"('সালেমনের মা'/'ফুল ফুটুক')


তখন আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় 'আকালের দিনে অনেক মেয়ে আর মায়ের ইতিহাস' ,যার পরিচয় পাই তাঁরই নিজের লেখায়—


"বজবজ থানার দক্ষিণের এক গাঁয়ের শেখ বাবর আলি মন্ডল হঠাৎ বদলে গিয়ে আমার কবিতার একটি উপমার ভিতসুদ্ধ এভাবে নাড়িয়ে দেবে আগে ভাবতে পারিনি...বাবর আলির মাথা খারাপ হবার পর সালেমনকে কোলে নিয়ে পুরো একটা বছর অপেক্ষা করেছিল গোলসান। কিন্তু পরের বছরেও চালের দর পড়বার যখন কোনো লক্ষণই আর দেখা গেল না, কারো কাছে হাত পাতবারও উপায় থাকল না–তখন এক রেস্তওলা আধবুড়োর গলায় গোলসানকে ঝুলে পড়তে হল।মার সেই নতুন সংসারে সালেমনের জায়গা হয়নি। কিন্তু তাতেও আপশোষ ছিল না সালেমনের –

     যদি না দু-বছর যেতে না যেতে দেখত মার কোলে তার জায়গা জুড়ে বসেছে গোল গোল হাত নিয়ে ফুটফুটে একটা ছেলে।মার নতুন ময়না। নানীর কাছে আরও একবার তার মা এসেছিল কলকাতার চাটিবাটি উঠিয়ে নতুন স্বামীপুত্র নিয়ে বরাবরের মত পাকিস্তানে চলে যাবার আগে।"

নারীকে দেখার ক্লান্তিকর গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত এই কবির কবিতা, 'মেয়ে' নামক নিসর্গের যে অংশকে বুকে জাপটে আরাম বোধ হয় সে আরামকে কবি যেন স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়েছেন,নির্বাসন নিয়েছেন নারী মানেই আলাদা এক শরীরীচেতনা বা দেহবাদের গল্প–এই বোধ থেকে , বরং প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন এক মানবী পরিমন্ডলকে যা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে এক মানবীয় যুক্তিবোধের জন্ম দিতে পেরেছে নিঃসঙ্কোচে।


নারী কখনো বঞ্চিত নিঃসঙ্গতার অনুষঙ্গ হিসেবে


' ছাদের পারে হেথাও চাঁদ ওঠে–/দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন/আসছে লাঠি উঁচিয়ে পেশোয়ারী/ব্যাকুল খিল সজোরে দিই মেলে।/ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম/উধাও ;লোকলোচন উঁকি মারে/সবার মাঝে একলা ফিরি আমি/—লেকের কোলে মরণ যেন ভালো' ('বধূ'/পদাতিক)

আবার কখনো নিত্য-নৈমিত্তিকতার লড়াই-ইতিবৃত্তের অপ্রকাশ্য নায়িকা–গড়ে তোলে একেকটি 'লড়াকু সংসার' যেখানে পুরুষ রাজনৈতিক আন্দোলনে সামিল আর মেয়েদের লড়াই অভাবের সঙ্গে; নাতনিকে নিয়ে সারাদিন লাইনে কয়লা কুড়োয় ঠাকুমা কিংবা আসন্ন সম্ভবা বউ 'কোনরকমে কোমর বেঁকিয়ে খুঁটির  সঙ্গে বাঁধা ছাগলটাকে খাওয়ায়।' মেয়েদের এই সংসার টিকিয়ে রাখার মানসিকতা কিংবা প্রচেষ্টা খুব সাধারণ মনে হতে পারে ; বিপ্লব করতে যাওয়া পুরুষের ভাত রেঁধে 'বিপ্লবের সেবাদাসী' তে পরিণত হওয়ার  মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই তাও হয়তো প্রকারান্তরে সত্যি কিন্তু খাদ্য আন্দোলন, তেভাগার মত কৃষক আন্দোলন কিংবা শ্রমিক আন্দোলনে যে খেটে খাওয়া মানুষেরা নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য সংগ্রামে রত , কখনো ঘরে, কখনো বাইরে সেই বিপ্লবকে,সংগ্রামকে ত্বরান্বিত এবং সুফলকামী করে তোলায় এইসব অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত মেয়েদের ভূমিকা কিছু কম ছিল না;খন্ড খন্ড যে ছবি তিনি কবিতায় ব্যবহার করেছেন তার দ্বারা তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে এই জাতীয় নারী বীক্ষণ অবশ্যই ব্যতিক্রমী এবং আধুনিক।

মেয়েরা ঘর বা সমাজ যাকে কেন্দ্র করেই হোক না কেন নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবার জন্য তারা যে স্বেচ্ছায় টানাপোড়েনের মুখোমুখি হচ্ছে এও ভাববার বিষয় বটে-


'অসহ্য গরমে/ একবার এপাশ একবার ওপাশ করছে /

ব্যঞ্জনহেড়িয়া গ্রামের ঘুটঘুটে রাত্তির।'

'এত রাত্তিরে জোলাদের ছোট বউটা,/পাড়ে ল্যাম্পো রেখে আছড়ায়/এক গাদা বিশ নম্বর সুতোর বান্ডিল।'('বাসি মুখে'/'ফুল ফুটুক')

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন