আজ উনিশে মে।ভাষা আন্দোলন দিবস। ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা আমরা অনেকে জানলেও উনিশে মে’র খবর আমরা অনেকেই রাখি না। উনিশে মে’র অমর শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে এবং মূল বক্তব্যে যাবার আগে আমরা একটি ফরাসি গল্প শুনব। গল্পের নাম “শেষ পাঠ'বলাবাহুল্য এটি বাংলা রূপান্তর। লেখক আলফোস দোঁদে। ১৮৪০ সনে দোঁদের জন্ম হয়। গল্পের শুরু ফ্রান্স -প্রুসিয়ীর যুদ্ধের পটভূমিতে । ফরাসিরা প্রুসিয়ার কাছে হেরে যায়,ফলে ফ্রান্সের ছোট্ট দুটি জেলা আলসাঁস ও লোরেনের বিদ্যালয় গুলিতে এবং সমস্ত সরকারি কাজকর্মে ফরাসির পরিবর্তে জার্মানির প্রচলন শুরু হয়। ছোট ফ্রানজ স্কুলে যেতে ভালোবাসে না। বইগুলি তাঁর কাছে বোঝা বলে মনে হয়। সুযোগ পেলেই সে বইপত্রের পাঠ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। সেদিন বিদ্যালয়ে পৌছাতে ফ্রানজের কিছুটা দেরি হয়ে যায়। স্কুলের সামনের মাঠে সে প্রুশিয়ান সৈন্যদের ড্রিল করতে দেখতে পায়। শ্রেণিতে প্রবেশ করতে গিয়ে সে দেখতে পায় শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চগুলিতে গ্রামের অনেক বৃদ্ধ লোকেরা বসে রয়েছে। প্রাক্তন মেয়র, পোস্টমাস্টার ও তাঁদের মধ্যে রয়েছেন। শিক্ষক মঁশিয়ে হেমেল কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে যে কোট পরিধান করে সেটি পরে রয়েছেন। সমস্ত ঘরটিতে কেমন যেন এক অদ্ভুত ধরনের নীরবতা বিরাজ করছে। সবচেয়ে বড় কথা দেরি হওয়া সত্তেও অন্যান্য দিনের মতো মঁসিয়ে আজ তাকে কোনো রকম তিরস্কার করলেন না। লিটল ফ্রানজ কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণ পরেই সমস্ত কিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। মঁসিয়ে হেমেল জানালেন বার্লিন থেকে আদেশ এসেছে আগামীকাল থেকে আলসাঁস ও লোরেনের বিদ্যালয়গুলিতে ফরাসির পরিবর্তে জার্মানি শেখানো হবে। সে হিসেবে আজই তাঁদের শেষ ফরাসি ক্লাস। লিটল ফ্রানজের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। যে ভাষার প্রতি এতদিন সে কোনোরকম আকর্ষণই অনুভব করে নি তাঁর সঙ্গে আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ভেবে তার বুকের ভেতরটা যেন কেমন করতে লাগল। মঁসিয়ে হেমেল গত চল্লিশ বছর ধরে গভীর মমতার সঙ্গে ছাত্রদের ফরাসি ভাষা শিখিয়ে আসছেন। কাল তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। জার্মান ভাষার নতুন শিক্ষক আসবেন । তাই গ্রামের সম্মানিত বৃদ্ধরা মঁসিয়ে হেমেলকে তাদের হৃদয়ের শ্রদ্ধা,ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য ক্লাসরূমে সমবেত হয়েছেন। মঁসিয়ে হেমেল তাঁর বক্তব্যের মধ্যে মাতৃভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করলেন। একই সঙ্গে তিনি ফরাসি ভাষার মাধুর্ষযের কথা উল্লেখ করে এই ভাষায় চর্চা করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানালেন। তিনি এটাও বললেন কোনো জাতিকে যদি বাধ্য হয়ে দাসত্ব স্বীকার করতে হয় তাহলে একমাত্র মাতৃভাষার চর্চাই তাদের সেই দাসত্ব থেকে একদিন মুক্তি দান করে। মাতৃভাষা যেন জেলের চাবিকাঠি। ছাদের পায়রা গুলিও সভার গুরুত্ব বুঝে যেন আস্তে আস্তে কুজন করছে। লিটল ফ্রানজের কেন জানি মনে হয় এই কবুতর গুলিকেও কি আগামীকাল থেকে জার্মান ভাষায় কুজন করতে শেখানো হবে? এরপর মঁসিয়ে হেমেল আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন । কিছু বলতে চাইলেন, তাঁর কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেল।
লিটল ফ্রানজের মনে হল সে মঁসিয়ে হেমেলকে কোনোদিন এতবড় দেখেন নি। তাঁর মাথাটা যেন আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। অনেক কষ্টে বোর্ডের কাছে এগিয়ে গিয়ে মঁসিয়ে হেমেল একটা চক দিয়ে ধীরে ধীরে লিখলেন ‘ভি ভি লা ফ্রাঁ’ যার বাংলা অর্থ হল ফ্রান্স দীর্ঘজীবী হোক। মঁসিয়ে হেমেল ইঙ্গিতের সাহায্যে সবাইকে জানালেন সেদিনের মতো ক্লাস এখানেই শেষ।
মাতৃভাষা যে মানুষের জীবনে কতটা প্রিয় তা এই গল্পে ফুটে উঠেছে। পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো ভাষাতেই এই গল্পের আবেদন গভীর। এটা দেশ নিরপেক্ষ, ভাষা নিরপেক্ষ |
এবার আমরা উনিশে মে'র ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটিকে সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য পুরোনো ইতিহাসের কাছে ফিরে যাব। উনবিংশ শতকে অসম এবং বাংলার পরিস্থিতি একরকম ছিল না। ১৮২৬ সনের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইয়াণ্ডাবুর সন্ধির ফলে অসমে ব্রিটিশ রাজত্বের সুত্রপাত হয়। তার প্রায় সত্তর বছর আগে পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বঙ্গদেশে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত হয়। পাশ্চাত্ত সভ্যতা- সংস্কৃতির দরজা বঙ্গের মানুষের কাছে ইংরেজ শাসনের সুত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে খুলে গিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অসমের সঙ্গে বঙ্গের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
অসমে বিদেশি আগ্রাসনের রূপ ছিল বহুমাত্রিক। মান এবং ইংরেজ উভয়েই প্রত্যক্ষভাবে রাজ্য দখলের জন্য আক্রমণকারী হিসেবে এসেছিল। তবে দুটো আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ পৃথক এবং বিপরীতমুখি। কিন্তু এই দুই আক্রমণকারী ছাড়াও পরোক্ষ নীরব আক্রমণকারীরাও অসমে এসেছিল। এই আক্রমণকারীদের ক্ষেত্র ছিল অসমের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়। ইংরেজ শাসনের সুত্রপাতের আগে অসম ছিল একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজ্য। উনবিংশ শতকের প্রায় তিন চতুর্থাংশ কাল ধরে অসমিয়া মানসিকতা বহিরাগত ভারতীয় মাত্রকেই বিদেশি বলে ধরে নিয়েছিল। লক্ষণীনাথ বেজবরুয়া থেকে শুরু করে জোনাকি যুগের বহু রথী-মহারথীদের চিন্তনে, লেখায় এই “বিদেশি” ধারণাটি সক্রিয় হয়েছিল। উনবিংশ শতকে অসমের কল-কারখানা, চাকরি-বাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, বৃত্তিগত সেবা ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বহিরাগত ভারতীয়দের প্রাধান্য ছিল। এর তুলনায় বরং ইংরেজদের প্রভাব অনেকটা সীমিত ছিল।
প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ শতকে অসমের ভাষা সংস্কৃতির ওপর চলা এই বিজাতীয় আপ্রাসনই ছিল অসমিয়া জাতীয় জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। ১৮৩৬ সনে অসমের স্কুল কলেজ অফিস আদালত থেকে অসমিয়া ভাষাকে অপসারিতকরে তার পরিবর্তে বাংলা ভাষার প্রচলন করা হয়। ইংরেজের এই ভাষানীতির অন্তরালে তাঁদের ওপনিবেশিক ষড়যন্ত্রই কার্যকরী হয়েছিল বলে মনে হয়। অবশ্য অসমে বাংলা ভাষা প্রচলনে কলকাতা কেন্দ্রিক ব্রিটিশ প্রশাসকদের ইন্ধন দান এবং অসমিয়া ভাষা বাংলা ভাষারই একটি স্থানীয় কথিত রূপ বলে পুরো ব্যাপারটাকে বিশ্বাস যোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে জাত্যাভিমানী বাঙালি বিষয়া শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবিরও অভাব ছিল না।
  অসমে অসমিয়াদের সংখ্যালঘু হওয়ার ভয় বা আশঙ্কা নতুন নয়। ব্রিটিশ অসম দখল করার পরে অসমে বাইরের লোকের প্রব্রজনের বিপুল স্রোত দেখে তৎকালীন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং শিক্ষিত শ্রেণি অসমিয়াদের জাতীয় অস্তিত্ব সম্পর্কে শঙ্কিত বোধ করেছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পরেও অসমিয়ারা অসমে সংখ্যাগুরু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্য, অসমে অসমিয়া রাজ্যভাষার মর্যাদা লাভ করার জন্য ১৯৬০ সনে, ১৯৭০-৭১ সনে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৮০ সন থেকে শুরু হওয়া গণ আন্দোলনের পটভূমিতেও ছিল বিদেশি প্রব্রজনের দ্বারা ত্রিপুরার মতো অসমিয়াদের অসমের মাটিতেই সংখ্যালঘু হওয়ার ভয়। এই আন্দোলনগুলির মূল লক্ষ্য ছিল অসমিয়া ভাষার প্রতিষ্ঠা করা। এই আন্দোলনে অনেক অভিবাসী মুসলমান ছাত্র-যুবকও শহীদ হয়েছিল। ১৯৮০ সনের শুরু হওয়া আন্দোলনে অসমিয়া ভাষা প্রহণ করা তথা অসমিয়া জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে মিশে যাওয়া অভিবাসী মুসলমানরাও বাংলাদেশী হিন্দুদের সঙ্গে আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হয়ে পড়ে। অসম মৌলবাদী চিন্তাধারা থেকে চিরকালই অনেকটা মুক্ত ছিল। ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ ব্যপারটা অসমে ছিল না। এখানে হিন্দু মুসলমান সমস্ত ধর্মের লোকই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে অসছিল। এমনকি ১৯৪৭ সনের আগে বঙ্গদেশ থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষে যে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল অসমে তার সামান্যতম প্রভাবও পড়েনি।
মানবতার খাতিরে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু শরনার্থীদের আশ্রয় দিতে আগ্রহী। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুদের স্রোত যদি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় তাহলে অসমিয়াদের নিজভূম অসমেই সংখ্যালঘু হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। তাই অসমিয়াদের আশঙ্কা অসমের অবস্থা তখন ত্রিপুরার মতোই হয়ে উঠতে পারে। দেশের সংবিধান অনুসারে সংখ্যাগুরুদের ভাষাই রাজ্যের ভাষা হবে।
পূর্বপাকিস্থানের সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল জাতীয় মুক্তি, বরাকের ভাষাসংগ্রাম ছিল স্বাধীন, গণতান্ত্রিক স্বদেশে অর্জিত সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের অহিংস সংগ্রাম । বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ছিল না, তা ছিল সমগ্র অসমের বিভিন্ন সংঘালঘু ভাষিক গোষ্ঠীর অধিকার আদায়েরও সংগ্রাম। শ্রীহট্টের অঙ্গছেদ ঘটিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালির জীবনের স্বপ্ন সাধের সমাধি ঘটিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম। স্বাধীনতার শুরু থেকেই বাঙালিকে বিদেশি, বহিরাগত রূপে চিহিন্ত করে অসমের প্রতি তাদের আনুগত্য নিয়ে শুধু সংশয়ই প্রকাশ করা হল না তাদের অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের প্রতিপক্ষ ও অন্তরায় বলে মনে করা হতে থাকে। অথচ ইতিহাস বলে যে আধুনিক অসমের গোড়াপত্তনে বাঙালিদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আনন্দরাম হলিরাম ঢেকিয়াল ফুকন,মণিরাম দেওয়ান, যদুরাম বরুয়া প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয় অসমিয়া মনীষীরা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী হয়ে বাংলাভাষাতে প্রবন্ধাদি লিখেছিলেন।
স্বাধীনতার পরপরই ছিন্নমূল দিশেহারা বাঙালি যখন আপন জন্মভূমি থেকে সর্বস্ব হারিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে অসমে এসে নতুন করে ঘর বাঁধতে শুরু করে ঠিক তখনই নানাভাবে আক্রমণের সম্মুখীন হয়। ১৯৪৮ সনেই বাঙালিরা গুয়াহাটিতে দাঙ্গার সম্মুখিন হয়। সরকারি রিপোর্ট মতে সেই দাঙ্গায় একজনের মৃত্যু হয়, বেশ কিছু ঘরবাড়ি লুটপাট হয় এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৯৫৪ সনে অসম বিধানসভায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্যভাষারূপে গ্রহণ করার জন্য একটি বেসরকারি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এটি পেশ করেন কংগ্রেস বিধায়ক ধরণীধর বসুমাতারি। অবশ্য কংগ্রেস সংসদীয় দলের সভায় এই প্রস্তাব সেই সময় স্থগিত রাখা হয়। প্রতিবাদে ১৯৫৪ সনের ১৯ জুন করিমগঞ্জ শহরে, অসম-ত্রিপুরা-মণিপুর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উপ্র অসমিয়া ভাষা প্রেম, অনঅসমিয়াদের উপর অত্যাচার ও নিগ্রহ, আর্থ সামাজিক ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংঘালঘুদের নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মলনের সভাপতি ছিলেন হেমেন্দ্রসাদ ঘোষ এবং প্রধান অতিথি ছিলেন অরুণ চন্দ্র গুহ।
১৯৬০ সনের ২২ এপ্রিল অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্যভাষারপে স্বীকৃতি দানের জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অসম বিধান সভার ভেতরে ও বাইরে চাপ সৃষ্টি করার জন্য রাজ্যসভা সংক্রান্ত প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অনসমিয়া জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার দাবিতে তীব্র আন্দোলনের সুত্রপাত হয়। ১৯৬১ সনের ১৫ জানুয়ারি করিমগঞ্জ শহরে শীলভদ্র যাজীর সভাপতিত্বে সম্মেলন আহান করা হয়। বরাকের পল্লিতে পল্লিতে জ্বলে উঠে বিক্ষোভের অগ্নিশিখা। মানুষ এক নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হয় | সে মন্ত্র জান দেব, জবান দেব না। অভূতপূর্ব উন্মাদনার মধ্যে ঘোষণা করা হল এঁতিহাসিক সেই দিনটি, ১৯ মে, ১৯৬১। জেলাব্যাপী অহিংস সত্যাগ্রহ শুরু হবে সেদিন থেকে। চলবে হরতাল, পিকেটিং। ১৫ মে শিলচর পুরসভার চেয়ারম্যান মহীতোষ পুরকায়স্থ একটি জরুরি সভা আহবান করলেন। সভায় পৌরোহিত্য করলেন জ্যোৎস্না চন্দ-বিখ্যাত চন্দ পরিবারের কুলবধু। ভাষা আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করার জন্য সবার কাছে আবেদন জানানো হল। এদিকে অসম সরকার ও তৈরি। সমগ্র জেলা ব্যাটেলিয়নের পর ব্যাটেলিয়ন সৈন্য দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। থানায় থানায় সশস্ত্র পুলিশরাও বিশেষভাবে তৎপর হয়ে উঠল। বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে এলেন ডিআইজি লালা বিমলেন্দু কুমার দে এবং কমিশনার বি এল সেন। রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগল মিলিটারি গাড়ি, টহলদারি সিপাহি। সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে অনেককেই যেমন রথীন সেন, নলিনী দাস,বিধু চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হল। সত্যাগ্রহীদের ভিড়ে জেলগুলি উপচে পড়ছে। ১৮ মে, বৃহস্পতিবার। কাছাড়ের কারও চোখেই সে রাতে ঘুম নেই। অবশেষে এল সেই ঐতিহাসিক বহু প্রতীক্ষিত দিনটি, ১৯ মে ১৯৬১। শুক্রবার সূর্য ওঠার অনেক আগেই সত্যাগ্রহীরা কেন্দ্রে এসে হাজির। প্রত্যেকের হাতে রয়েছে সংগ্রাম পরিষদের ইস্তাহার। দোকানপাট বন্ধ। সত্যাগ্রহীদের মুখে ধ্বনি, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ । সরকারি কাজকর্ম অচল হয়ে গেল। ছেলেদের হাত ধরে মেয়েরাও দলে দলে সত্যাপ্রহে বেরিয়ে পড়ল।
শিলচর স্টেশনে দারুণ ভিড়। প্রথম ট্রেন ছাড়ার কথা ৫টা ৪০ মিনিটে। সত্যাপ্রহীরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ কোনো ট্রেনই যেন স্টেশন ছেড়ে বেরোতে না পারে। ক্রমে স্টেশনে সত্যাগ্রহীদের সংখ্যা বেড়েই চলে। সাড়ে পাঁচটার আগেই প্রায় হাজার দুই সত্যাগ্রহী সার বেঁধে রেললাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স এবং মাদ্রাজ রেজিমেন্টের সৈন্যরা প্ল্যাটফর্ম এবং স্টেশনে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ছয়টা। পুলিশ সুপার অতুল দত্ত এবং ম্যাজিস্ট্রেট হেমন্ত মজুমদার উপস্থিত। সত্যাগ্রহীরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রেপ্তার বরণ করতে প্রস্তৃত। কিন্তু একি অভাবনীয় কাণ্ড। শান্তিপ্রিয় সত্যাগ্রহীদের উপর হঠাৎ সেনাবাহিনীর লোকেরা বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল। চলল অবর্ণনীয় অত্যাচার। ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কাউকে রেহাই দেওয়া হল না। চলল একের পর এক নির্মম আঘাত। উদ্দেশ্য একটাই সত্যাপ্রহীদের রেললাইন থেকে সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু শত অত্যাচারেও তা সম্ভব হল না। এবার শুরু হল ব্যাপক হারে লাঠিচার্জ । কিন্তু এবারও সমস্ত বিফল হল। এবার তৃতীয় চেষ্টা। কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হল। যন্ত্রণায় দম বন্ধ হয়ে আসে। তবুও সত্যাগ্রহীদের মরনপণ থেকে ফেরানো গেল না। শুরুহল অমানুষিক লাঠিচার্জ। পদাঘাতে,বুটের ঘায়ে ছিটকে পড়ছে বৃদ্ধা, তরুণী, তবুও কেউ জায়গা ছাড়ল না। এযেন বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূ্চগ্র মেদিনী। তলপেটে লাথি খেয়ে জ্ঞান হারাল গৌরী বিশ্বাস, সামনেই লুটিয়ে পড়ল সীতা দে, বয়স মাত্র আঠারো। বন্দুকের কুঁদায় তার দেহ তখন ক্ষতবিক্ষত।
দুটো পঁয়ত্রিশ নাগাদ আন্দোলন কারীদের লক্ষ্য করে ১৭ রাউণ্ড গুলি চালানো হয়, ১২ জনের দেহে গুলি লেগেছিল। নয়জনের সেদিনেই মৃত্যু হয়। দুজন পরে মারা যায়। এই ঘটনার পরে অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। সেদিন যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তারা হলেন যথাক্রমে কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য।এদের সবার স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। 
(উনিশে মে স্মরণ)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন