তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য সম্পাদিত পত্রিকা- 'অমিতা' ২০১৭ সালের ১৯শে মে শহিদদের উদ্দেশ্যে সম্মান দিয়ে প্রকাশ করেন। আমার জানা নেই যে মুর্শিদাবাদের অন্য কোন পত্রিকা এই শহিদদের এতোখানি সম্মান জানিয়েছেন কিনা। সেই পত্রিকাটি থেকে একটি প্রবন্ধ এখানে রাখা হল... 

চোখের জল লোহা হয়ে ঝরুক 
বরাক উপত্যাকার কোনো এক ভাষা সংগ্রামী

১৯৬১-র ১৯শে মে অকুতোভয়ে বাংলায় কথা বলা বাঙালি হয়ে বেঁচে থাকার উষ্ণতায় দিনযাপনে আত্মপরিচয়ের অস্তিত্বের উচ্চারণ প্রবহমান রাখতে একাদশ শহিদের আত্মত্যাগ আমরা ভুলে গেছি, ভুলে গেছি আসামের বরাক উপত্যকায় দেশভাগের পর থেকেই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি ও বাংলাভাষার প্রতি উপেক্ষা অবমাননা শোষণ বঞ্চনা, কারণ বাঙালির একমাত্র অপরাধ – বাঙালি হয়ে সে তার ভাষা ও সংস্কৃতি বিক্রি করে পদলেহনের দাসখত মেনে নেয়নি। তাই তো সে সময়ে বরাক উপত্যকার ছাত্র-শিক্ষক-সাহিত্যিক-শিল্পী সংবাদপত্রসেবী-সাংস্কৃতিক কর্মী-ব্যবহারজীবী-চিকিৎসক এককথায় আপামর বাঙালি জনসাধারণ দৃঢ় আপসহীন সংগ্রামী হয়ে উঠেছিলেন, আত্মবলিদানের সংকল্পে মুখর সে এক দিন – উনিশে মে।

দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল জুড়ে উগ্ৰ অসমীয়া জাতীয়তাবাদ আওয়াজ তুলেছে 'খিলঞ্জিয়া’ অর্থাৎ ভূমিপুত্র নয় এই অজুহাত তুলে বাঙালি চাষির মাঠের ফসল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে হাতির দল দিয়ে বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানদের অসমিয়া জাতিও ভাষাপরিচয় গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে অর্থাৎ সন্ত্রাসের রাজত্ব বঙাল খেদাও অভিযান। ১৯৬০-এর ৪ঠা জুলাই সকাল থেকে ৬ই জুলাই-এর সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসন ও কুড়ি হাজার হামলাবাজ গ্রাম থেকে গ্রামে পশুর হিংস্রতায় ঝাপিয়ে পড়ল। প্রায় দু-হাজার পরিবার এই নৃশংস হিংস্র হত্যাকাণ্ডের শিকার হল। ১৫ই আগস্ট কাছাড় জেলার সর্বত্র ও কলকাতায় আসাম-হাঙ্গামার প্রতিবাদে শোকদিবস উদ্যাপন করা হল।

ইতিমধ্যেই অনসমিয়া ভাষাভাষীদের উপেক্ষা করে গৃহীত হয়ে গেল আসাম রাজ্য ভাষা বিল, যেখানে অসমিয়া ভাষাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হল। এবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। সব অনসমিয়া দলমত-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের কল্যাণকামী সব শ্রেণির জনগণ যোগ দিল ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ করিমগঞ্জ টাউনব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে। এই সম্মেলনে বাংলাভাষাকে অন্যতম রাজভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করা হল। তা না হলে ঠিক হল ১৩৬৮-এর ১লা বৈশাখ থেকে শুরু হবে অসহযোগ আন্দোলন। আওয়াজ উঠল – আমরা আমাদের ভাষা ও কৃষ্টিকে অন্যের উপর চাপাতে চাই না, তেমন অন্য ভাষা ও কৃষ্টিকে আমাদের উপর চাপাতে দেব না। আজ বাঙালি বলে আমাদের চাকরির অধিকার শিক্ষার অধিকার আর্থিক উন্নতির অধিকার এক কথায় মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিচ্ছ এটা কোনোরকমভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

১৩৬৮-এর ১লা বৈশাখ উচ্চারিত হল – জান দেব জবান দেব না।

প্রকৃতির কী মর্মান্তিক পরিহাস – সেবারই আবার রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ আর সেবারই বরাক উপত্যকার বাঙালিকে বাংলাভাষা সংস্কৃতি রক্ষায় লড়াইয়ে রাস্তায় নামতে হল ৷ এদিকে আসামের সরকার বরাকবাসীর অহিংস আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দিতে সি.আর.পি.এফ., আসাম রাইফেল্স, বর্ডার ট্রুপস্ আসাম ব্যাটালিয়ান এবং আসাম পুলিশ বাহিনী জোর কদমে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিয়ে নিল। ওদিকে মানুষ গর্জে উঠল –

যত আন মিলিটারি স্টেনগান

মাভৈঃ
মায়ের চরণে মোরা দিব বলিদান সংগ্রাম চলছে, চলবে সংগ্রাম।

আন্দোলনের পীঠস্থান করিমগঞ্জেই প্রথম অহিংস আন্দোলনের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। এদিন ছিল স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার শেষ দিন। পরীক্ষা শেষে হল থেকে বেরিয়েই শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ সর্বত্র ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার মিছিলে সামিল হল। তারা সারা ভারতের ছাত্র সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল যে – বশ্যতার শেকলে নয় বিচারহীন বিধানে কঠিন কানমলায় নয় মর্যাদার সাথে মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েই একমাত্র মীমাংসা সম্ভব। সেই সময় ‘ভগনীয়া’ (উদ্বাস্তু), পাকিস্তানি, বহিরাগত, বিদেশি বাঙাল এসব বিশ্লেষণে অসম্মানে অভ্যস্ত বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা ও চাকুরিজীবী, তীব্র মানসিক চাপে ভুগছিলেন। ১৮ই মে রাত ১২টায় গণসংগ্রাম পরিষদে হামলে পড়ল পুলিশ, গ্রেপ্তার করল সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সংগঠক কোষাধ্যক্ষকে।

১৯শে মে ভোর ৪টেয় করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে অচল অনড় নিরস্ত্র অহিংস শিশু নারী-বৃদ্ধ সমেত অহিংস সত্যাগ্রহীদের উপর শুরু হল লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস, বুটের লাথি, বন্দুকের বাঁটের আঘাত। পাথারকান্দিতে বাঙালি মণিপুরি মাড়োয়ারি হিন্দুস্থানি নানান ভাষাভাষী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিলেন। এদিকে করিমগঞ্জ স্টেশনে রেললাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে ভাষা -মাতার রক্ষায় জান কবুল হাজার হাজার সন্তান সন্ততিকে হঠাতে না পেরে হঠাৎই কোনো সতর্কবার্তা না দিয়ে আসাম রাইফেলস্রে সেনাবাহিনী বেলা ২টো বেজে ৩৫ মিনিটের সময় ঝাকে ঝাকে গুলি ছুড়তে শুরু করল। বুকে বুলেট নিয়ে ভাষামায়ের কোলে নিজের প্রাণ অঞ্জলি দিলেন কুমারী কমলা ভট্টাচার্য, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ, কুমুদ দাস, সুনীল সরকার, শচীন্দ্রমোহন পাল, কানাইলাল নিয়োগী, সুকোমল পুরকায়স্থ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব। সবকটা গুলি বুক আর মাথা লক্ষ্য করেই ছোড়া হয়েছিল। মনে হচ্ছিল বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে তেজি জোয়ানদের আক্রমণ। না কোনোও অ্যাম্বুলেন্স বা চিকিৎসক আসাম প্রশাসন পুলিশ বা সেনাদের তরফ থেকে সেখানে ছিল না। রবীন্দ্রশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের ভাষাকে স্তব্ধ করে দিতে এ পৈশাচিক তাণ্ডবের খবর আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, রেডিও পিকিং, রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত হল। রাজ্যপালের পাঠানো শোকবার্তা যখন শহিদদের পরিবারের কাছে পাঠান হল তখন তারা তা চিতার জ্বলন্ত আগুনেই ছুড়ে দিলেন ৷ শোকতপ্ত বনফুল লিখলেন

মাতৃভাষার মান বাঁচাতে তোমরা যাঁরা প্রাণ দিয়েছো বীর তোমরা যাঁরা বুঝিয়ে দিলে প্রাণের চেয়ে মানটা বহু বড়ো প্রণাম লহ, শোকাচ্ছন্ন এ বঙ্গ কবির, ওরে অসাড় বঙ্গবাসী, ওদের লাগি অর্ঘ্য কর জড়ো।

ঘরের চালে জ্বলছে আগুন, অপমানে যাচ্ছে মরে সতী গুন্ডা তাদের নিচ্ছে টেনে দিনের আলোয় চুলের ঝুঁটি ধরে, এই বিপদে ঝাপিয়ে পড়ে প্রাণ দিয়েছ তোমরা মহারথী আমরা তখন সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছি দূরেতে চুপ করে।

স্বাধীনতার নামে যখন সারা দেশে চলছে জুয়াচুরি লিঙ্গুইজম নিন্দা করে লিডারিজম জাগছে দিকে দিকে তোমরা তখন জীবন দিয়ে ভেঙে দিলে সকল জারিজুরি রক্ত রঙে এঁকে দিলে স্বাধীনতার মর্মকথাটিকে।

প্রমাণ করে দিয়ে গেলে মৃতের দেশে তোমরা ছিলে জিতা প্রমাণ করে দিয়ে গেলে তোমাদেরই সত্যি ছিল প্রাণ প্রাণের আগুন দিয়ে বন্ধু জ্বেলে দিলে অত্যাচারীর চিতা। প্রমাণ করে দিয়ে গেলে বাংলামায়ের তোমরা সুসন্তান।

রত্নগর্ভা মা তোমাদের, ধন্য তাঁরা বহু পুণ্যবতী তোমরা তাঁদের অঙ্ক-শোভা বক্ষমণি নিঃশংক বীর অন্ধকারের দেশে আজি ফুটিয়ে দিলে কী অপূর্ব জ্যোতি বেসুরোদের হট্টগোলে গেয়ে গেলে কী সুর গম্ভীর।
(উনিশে মে, প্রণাম লহ; বনফুল)


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন