২১শে ফেব্রুয়ারী, এই দিনটার কথা অনেকে জানেন, কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি জানেন না, ১৯ শে মে দিনটির কথা। এটাই লজ্জার। ২১ শে ফেব্রুয়ারীর মত আমাদের ১৯ শে মে কথাও জানতে হবে বৈকি !

সালটা ১৯৬১। সেই বছরের মে মাসটি আসামের শিলচরের বরাক উপত্যকার বাঙালিদের কাছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাস হিসেবে পরিচিত। এই সংগ্রাম ছিল মূলত অসম সরকারের চাপিয়ে দেওয়া ভাষা বিলের আগ্রাসনমূলক বিধির বিরুদ্ধে। 


১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়৷ ১৯৬০-এর ১৪ অক্টোবর তারিখে প্রস্তাবিত এই রাজ্যভাষা বিলে বলা হয়েছিল , রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়া গৃহীত হবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন ইংরেজির ব্যবহার চলছিল তেমনই চলবে যার স্থানে পরবর্তীতে হিন্দি ব্যবহৃত হবে। প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এই বিলের সঙ্গে একটি বিশেষ বিধি সংযোজন করে দেওয়া হয়েছিল। যে বিধিতে বলা হয়েছিল –

“The Bengali language shall be used for administrative and other official purposes upto and including the district level in the district of Cachar until the Mahkuma Parishads and Municipal Boards of the district in a joint meeting by a majority of not less than two-thirds of the members present and voting decide in favour of adoption of the official language for use in the district…”1


১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এই আন্দোলনে ১৯৬০ সালের ৪ জুলাইয়ের দিন রঞ্জিত বরপূজারী কটন কলেজের নিজ হোষ্টেলের ১১৩ নম্বর রুমের সম্মুখে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে মৃত্যু বরণ করেছিলেন৷ বলা হয় তাঁকে দিয়েই এই আন্দোলনের সূচনা হয়৷ উল্ল্যেখ করা যেতে পারে একমাএ কাছাড় জেলার ক্ষেত্রেই  এই আইনের প্রয়োগ হয়৷ এই ভাষা আইনের প্রতিবাদে অসমের বরাক উপত্যকায় বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে বরক উপত্যকার করিমগঞ্জ জেলায় শুরু হয় পদযাত্রা। গড়ে উঠে গণসংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯ মে তারিখে কাছাড় জেলায় সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা যখন উচ্চ রূপ নেয়, তখন প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। অন্য ৯০,০০০ বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। বেলা ২:৩৫-এ ষ্টেশন চত্বরে গুলি চালনায় ১১ জন আন্দোলনকারী শহীদ হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সে সময়কার ভাষা শহীদরা হলেন- কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, কানাইলাল নিয়োগ, হিতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুনীল কুমার, সত্যেন্দ্র দেব ও কুমুদ রঞ্জন দাস প্রমূখ এবং শতাধিক লোক আহত হয়।

এই পুরনো ইতিহাস মনে করার দরকার আছে, আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদকে বোঝার জন্য। স্বাধীনতার পর আসামে যে এনআরসি হয়েছিল, তাতে দেখা যায়, বহু এলাকায় তা কার্যকরী করা হয়নি, যেখানে যেখানে অসমিয়াভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। এমন ‘ছোট্ট’ ঘটনায় বোঝা যাবে, আধিপত্যবাদের স্বরূপ ও রাজনীতির কদর্য রূপ। আত্মবলিদান স্মরণ করা হয় এই কারণে যে তাঁরা শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করেছেন, নিরস্ত্র সংগ্রাম কিন্তু বীরের লড়াই। কোন ভাষার জন্য লড়েছিলেন তাঁরা, তা একটি নিছক তথ্যমাত্র। ঘটনা হলো, তাঁরা লড়েছিলেন মাতৃভাষার জন্য, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। এই সব বীরেদের জন্য শ্রদ্ধায় অবনত হোক আজ আমাদের মাথা যারা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজেদের প্রাণ দিয়েছেন৷
(১৯শে মে-র শহীদদের সেলাম) 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন