লেগেছে পলাশ রেণু
ছবি ও লেখা - বিপ্লব দত্ত
শীতের শেষ আর বসন্তের শুরু । রঙবাহারি ফুলের সমারোহ শীতেই। ফুল আর তার রঙের ঘ্রাণ মনুষ্য জীবনের এক অনাবিল আনন্দধারা। ঝরাপাতা যেমন আমাদের মনকে নিঃসঙ্গ করে আর ফুল নেই তো প্রেমহীন এক নিরলস জীবন। তামাটে পাতাগুলো মনের গভীরে ক্ষতের সৃষ্টি। ফিবছর বসন্ত আসে আর মনে হয় - বসন্ত যেন শেষ না হয়। শরীরমনের আঙিনায় সর্বদা কামনা - আমি যেন বসন্তের রূপ নিয়ে আজীবন থাকি। কিন্তু প্রকৃতি? নিজের সৃষ্টি মানুষের মনকে রাঙিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়। বলে -"তোমরা সুখে থেকো গো। আসছে আমার বিদায়বেলা"। পাতা তামাটে হতে হতে ঝরে পরে। মানুষ শুকনো পাতা সরিয়ে আগুন জ্বালায়। পাতাহীন গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। গাছের রং কালচে তাম্রবর্ণ। কেও ফিরেও তাকায় না। অস্বাভাবিক এক যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে তীব্র দহনে একসময় আসে বৃষ্টি। তারপরেই সবুজ পাতার আনন্দে হাওয়ায় দোল খায়। মৃত গাছ জীবিত হয়। পাখিরা আসে। বাসা বাঁধে। কিচিরমিচির আওয়াজে নতুন প্রাণ আবার সুস্থ জীবনের এক নতুনের জাগরণ। যে জাগরণে সে ভাবে -"আবার আনন্দে মাতিয়ে দেব মানুষকে। সাজবে সবাই বসন্তে। পরবে মালা গলায় বাসন্তী রঙের শাড়িতে। সুখ আমার তাতেই"।
পলাশের পাশেই ফাগুনবউ। এই ফাগুনে তার শরীর সোনালী রঙের ফুলে ভরে ওঠে। একরাশ ফুল ঝরে মাটিতে। কেও ভুলেও কুড়োই না। পা মাড়িয়ে একেবারে পলাশের কাছে। দিনরাত ভাবে আমি সুন্দরী আর আমার উজ্বলতা কি মানুষকে টানে না? ঠিক তাই। কথা হয় পলাশের সঙ্গে। তার হৃদযন্ত্রনা এক মজে যাওয়া নদীর মতো। পলাশের কাহিনী সর্বকালের আর সবসময়ের যা ফাগুনবউকে রক্তাক্ত করে তোলে। ভাবে -"পলাশ আর আমি যদি অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে থাকতাম? মানুষ ছিঁড়ুক পলাশফুল, আমি থাকি আলো করে"। কিন্তু হবে কি করে? মানুষ গাছ লাগায় দূরত্ব মেপে। ঝড়ঝাপটায় কখনোসখনো পলাশকে ছুঁলেও আবার সেই একই জায়গায়। যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই প্রকৃতিমাফিক। প্রতি বছর ফাগুনবউয়ের যন্ত্রনামাস। ফুল শেষ যন্ত্রণাও লোপাট। স্মরণাপন্ন উত্তাল ঝড়ের। সেদিনের ঝড় আর তার দাপটে উলটপালট। মানুষের ঘরবাড়ি আর হাহাকারে উথালপাথাল স্বপ্ন। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফাগুনবউ আছড়ে পরে পলাশ গাছে। ডাল ভাঙে দুজনের। কিছুটা পাশের শিকড় উপড়ে যন্ত্রণার শিকার। ঝড় থামে। ফাগুনবউ এখন আলিঙ্গনে আবদ্ধ।
অনেকদিনের আকাক্ষার ফসল এই ঝড়। ঝড় থামে আবার শুরু হয় দিনরাত্রি। জড়ানো গাছ আর তাদের কথা যেন শেষ হয় না। আবার নতুন পাতা শুরু। আনন্দে পলাশ। আনন্দে ফাগুনবউ। শীতের রাতে তাদের কষ্ট নেই। পরস্পরের দৈহিক সম্পর্কে তারা শীতার্ত নয়। গাছে মুকুল ধরে। আসে বসন্ত। ফাগুনবউয়ের ফুলরং পলাশকে আরও আকৃষ্ট করে তোলে। মানুষ হলুদ ফুল ছোয় না। পলাশের নেশায় গাছে ওঠে। ভাঙে ফাগুনবউয়ের ডাল। ঝরে পরে হলুদ ফুল। পলাশ ছেঁড়ে আর তার রেণু ছড়িয়ে পরে ফাগুনবউয়ের বাকলে। এ পাওয়া যেন এক অলিখিত স্বপ্নের আবরণ। একসময় পলাশ আর ফাগুনবউ ফুলপাতাহীন। তা হোক। এখন ফুলরেণু বাকল ভেদ করে তার প্রতিটি শিরাউপশিরায়। দুই পাতাহীন উলঙ্গ জড়ানো দেহ যাদের শরীরে আজ শুধুই শিহরণ। ফুলহীন পলাশ কাঁদে। রাত বাড়ে আর ফাগুনবউয়ের পলাশ রেণু ক্রমশ উজ্জ্বল আলোয় ভাসিয়ে দেয়। কালচে তামাটে পলাশের দেহ দেখা যায় না। এ যেন অন্তহীন আলোর ঝর্ণা। প্রাণের ঝর্ণা। সময়ের ঝর্ণা। আর যে ঝর্ণায় সুখ আছে অনন্ত প্রেমের।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন