জীবন থেকে কবিতায় , কবিতা থেকে জীবনে ফেরা 

পর্ব- ৫ ( বসন্ত সৌরভে )

আফজল আলি 


বসন্ত মানেই , নীল দিগন্তে , ওই ফুলের আগুন লাগল , বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল । শীতের রুক্ষ্মতা জবুথবু ছেড়ে যেন নতুন করে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা। দূরে কোকিলের কণ্ঠস্বর , আর এক অজানা মনকেমন, বার্তা চলে আসে প্রকৃতির কাছে , বার্তা চলে আসে মনের কাছে নতুন ভাবে রাঙিয়ে ওঠার । যেন অলক্ষ্য রঙ লাগল শরীরে মনে। যারা কবিতা লেখে বসন্ত যেন এক অনাবিল আনন্দ, যেন নতুন করে আবার কবিতা লেখার তোড়জোড়, নতুন উদ্যোম। যেন শীতের জড়তার শেষে নিজেকেই নতুন ভাবে গড়ে তোলা , নতুন মননে , নতুন আবেগে । দূর থেকে যেন সুর ভেসে আসে , ওরে গৃহবাসী , খোল দ্বার খোল্, লাগল যে দোল । বসন্ত মানেই আমাদের আছে রবীন্দ্রনাথ, এক এবং অদ্বিতীয়ম। 

গাছের আড়ালে লুকিয়ে কোকিল ডাকছে , ওর উদাসী কণ্ঠস্বর যেন চারপাশটা নিঃসঙ্গ করে মনের বারুদে বিস্ফোরণ ঘটায় , যেন মনের ভিতর কী এক বিক্রিয়া ঘটে চলে, মনটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় দূরে দূরে কোথাও। উদাসী মনের মুকুলে তখন দানা বাঁধে মনকেমনের উঁকিঝুঁকি , হারিয়ে পুনরায় ফিরে পাবার আকুতি। কবি মন খুঁজতে থাকে , অন্বেষণে তার শব্দের দ্যুতি , মন রেঙে ওঠে , মন কাউকে চায় , মন যেন বাউলের একতারা, " যাব ব্রজের কূলে কূলে , আমরা মাখব পায়ে রাঙা ধুলি , ওরে নয়নেতে নয়ন দিয়ে রাখব তারে , না না ছেড়ে দেব না , তোমায় হৃৎমাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না " । জীবনের স্পন্দন , ভাবের স্পন্দন , প্রাণের স্পন্দন যেন আরো একটু গতি পায় জড়তা ছেড়ে। বসন্তেই তো মনে হয় মানুষের জন্য একটা মানুষ প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে না , মানুষের সম্পর্ক মানুষের জন্য। বসন্তে ভালোবাসার মানুষটিকে খোঁজে মন , বসন্তে সম্পর্ক তৈরি হয় । আবার বসন্তে বিচ্ছেদ ও ঘটতে পারে। মন প্রবল উদাসী হতে হতে বিবাগী হয়ে যায় , পৌঁছে যায় অস্তিত্ব সংকটের কিনারে , নিজের মধ্যেই নিজেকে হারিয়ে ফেলে । সম্পর্কের টানাপোড়েন হল জীবনের এক জটিল প্রবাহ । 


সম্পর্কের সাথে বসন্তের সেভাবে প্রকট যোগাযোগ না থাকলেও , মন সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় এই বসন্তেই । কেন মন মনের মতো কাউকে খুঁজতে চায় , খুঁজে পেতে চায়। একটা স্বপ্ন মনের ভিতর লালিত থাকে , বাস্তবের ছোঁয়া পেতে স্বপ্নের মোহনায় এক প্রতিনিধিত্বের দিশারী । মন সম্পর্কের খোঁজে আকুল হয়ে ওঠে । আর এই আকুলতা আরো প্রবল হয়ে ওঠে দূর কোকিলের ডাকে । বসন্ত কি আত্ম অনুসন্ধানের মাস , নিজেকে নিজের কাছে খুঁজে পাওয়া , নাকি আরো অধরা থেকে যাওয়া। নিজের সত্তা তো নিজের কাছে অধরা থাকে না। আমরা জানতে চেষ্টা করি না বা চাই না , তাই নিজের কাছে নিজেকে অস্পষ্ট, অসহায় লাগে। একজন ব্যক্তি যখন নিজেকে খুঁজতে চেষ্টা করেন তখন তার সত্তা যে সব বন্ধনে জড়িয়ে থাকে, সেই বন্ধন বা সম্পর্কের উপস্থিতি আপেক্ষিক প্রবাহের মধ্যে চলে আসে। তখন ব্যক্তির সাপেক্ষে জড়িত সম্পর্কগুলোর প্রভাব অনেকটা ভূমিকা পালন করে। যেমন একজন পরিবারের পিতা যদি হয় বা মাতা , তখন সেই পিতা বা মাতা যখন নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে নামবেন তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে । সেক্ষেত্রে তিনি বা তেনারা আর কেবলমাত্র একক নিউক্লিয়াস থাকে না। অন্যান্যদের সম্পর্কে তাঁদের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । একজন পিতা বা মাতা যেমন তাদের সন্তানদের সহ অন্যান্যদের সুরক্ষা এবং পালনের ক্ষেত্রে কীরকম ভূমিকা নিয়েছে তার সাথে জড়িয়ে থাকে তাদের আত্মানুসন্ধানের পর্ব। ঠিক তেমনি উল্টোটা। একজন মানুষ কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে এবং গুরুত্ব দিচ্ছে , পরস্পর ব্যক্তিত্ব অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এটার প্রভাব খুব। নিজের সত্তার উপস্থিতি আসলে নির্ধারণ হয় দুটি উপায়ে 

১- নিজের ব্যক্তি গুণাবলী প্রকাশের মাধ্যমে এবং তার উৎকর্ষ । 

২- অপরের দ্বারা নিজের সত্তাকে সমর্থনের মাধ্যমে। 

এক্ষেত্রে প্রথমটির অবর্তমানে দ্বিতীয়টির প্রকাশ প্রকট হতেও পারে। যেমন উপরের উদাহরণে বলা হয়েছে। আবার যদি ধরা যায় দুই জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ পরস্পরের সাথে প্রেম বা ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে আছে , সেক্ষেত্রে একে অপরকে স্বীকৃতির মাধ্যমে বা পরস্পরের আবিষ্ট হওয়ার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তি সত্তার জাগরণ হতে পারে , আত্মানুসন্ধানের পথ সুগম হয় । পরস্পর পরস্পরের আবেগ ভালোবাসা একে অপরকে উত্তরণ করে । এটা একটা পজিটিভ দিক। তাই সুন্দর সম্পর্ক আমাদের আত্ম বিকাশে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নেয়। এর উল্টোটা আবার পরস্পরের বিনাশের ক্যাটালিস্ট। 

আবার প্রথমটি প্রযোজ্য কবি বা সৃষ্টিশীল মানুষদের ক্ষেত্রে। তাঁদের সৃষ্টি যত বিকশিত হতে থাকে ততই তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণের জায়গায় পৌঁছায় এবং তাঁর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য মানুষদের সাপেক্ষে তাঁর নিজস্বতা , ব্যক্তিত্ব এবং যাকে বলা হয় আত্মানুসন্ধানের বিকাশ হয় । একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তো নিজের কাছে নিজেকেই অনুসন্ধান করেন । ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার সাথে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সম্পর্কের বীক্ষণে অথবা সমাজ ও পারিপার্শিকতার সাথে ব্যক্তি সম্পর্ক , এ সব নিয়ে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ নিজেকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখে । তখনই উঠে আসে সন্ধান বা নিজেকে খোঁজা। নিজের ভূমিকার প্রতিফলন । আর এই নিরিখে একজন কবি কবিতা লেখেন । কখনও দর্শনের বিষয়বস্তুও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন আমি কে , আমার অস্তিত্ব কী , আমার ভূমিকা কী , জীবন কী হতে চায় অথবা মৃত্যুর মধ্যে কী লুকিয়ে থাকে-- এই সব বিষয়ের মধ্যে নিজেকে স্থাপন করে আত্মানুসন্ধান হয় । তখন বোধ তৈরি হয় , কবির বোধ , যার উপর ভিত্তি করে তাঁর লেখা এগিয়ে চলে । তার প্রভাব পড়ে সামগ্রিকতায়। এটাও একরকম বন্ধন। 


তাই আত্মানুসন্ধানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বন্ধন একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখে । প্রেমে বিচ্ছেদ অথবা মাদক নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যখন কেউ কেউ জীবন পর্যন্ত শেষ করে দেয় , তখন বুঝতে হবে একজন ব্যক্তি নিজেকে জানার জন্য , বোঝার জন্য আর অপেক্ষা করতে রাজি নয় । তার নিজের কাছে নিজের সব গুরুত্ব ই শেষ হয়ে যায়। অপর বা অপর কিছুর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে নিজের অস্তিত্ব। ফলে জীবন হয়ে দাঁড়ায় আর একজনের সাপেক্ষে। ফলে একজন সরে গেলে আর একজনের অস্তিত্ব থাকে না। আত্ম হত্যার দিকে ঠেলে দেয়। এটা আত্মানুসন্ধান এবং পারস্পরিক বন্ধনের একটা নেগেটিভ দিক , যখন চিন্তা এবং চিন্তন আর কাজ করে না । হয়তো বুঝতে পারে না একে অপরকে তখন । ভালোবাসা এবং নেশার ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষের পৃথিবীটাই হয়ে ওঠে উল্টো দিকে থাকা মানুষটি অথবা নেশাদ্রব্যটি। আমি ভালোবাসাকে নেশার সাথে এক করে দিচ্ছি না যদিও। শুধু বিষয়টিকে পাশে রেখেছি মাত্র । একটা মানুষের কাছে অপরপক্ষটি যখন তার সাপেক্ষে একটা পৃথিবী হয়ে দাঁড়ায় , তখন তার সুখ দুঃখ আত্মবোধ, আত্ম অনুভব, উপস্থিতি , ভালোলাগা ভালো থাকা সবটাই ঘুরপাক খায় ওই মানুষ কেন্দ্রিক যাকে সে চাইছে কারণ সেই মানুষটি ছাড়া তার পৃথিবী অনুপস্থিত। আর তার যখন পৃথিবীটাই নেই তখন নিজেই বা কী করে থাকে । আস্তে আস্তে সে ক্রমশ একা হতে আরম্ভ করে এবং একসময় হয়তো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় পৃথিবী ছাড়ার । নিজের প্রতি মায়া বোধটাই হারিয়ে যায় । অথচ ব্যাপারটা ঠিক এমন হওয়ার ছিল না। একজন মানুষের উপস্থিতি, অস্তিত্ব কেন অন্য জনের উপর নির্ভরশীল হবে , কেন তার পৃথিবীটা ক্রমে ক্রমে উধাও হয়ে গিয়ে অন্যজনের কাছে চলে যাবে । এটার উত্তর নেই কারণ ভালোবাসা অন্ধ । ভালোবাসা অস্তিত্ব সংকট তৈরি করতে পারে । বুক যে চায় সেই মানুষটিকে যার কাছে আছে তার সব । ঠিক নেশার মতো । অথচ নেশা নয় । 


আবার উল্টো দিকে ভালোবাসা প্রচন্ড সৃষ্টিশীল করে তোলে , শক্তি সাহস জোগায়, নিজেকে চিনতে , পর্যালোচনা করতে সাহায্য করে এবং আবেগ উসকে দেয় । ফলে ভালোবাসার মানুষগুলো পরস্পরের থেকে energy পায় , চার্জ হয় । কিন্তু এই প্রক্রিয়া ততক্ষণ ই চলে যখন পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যোগসূত্র বা সম্পর্কে থাকে । এটা বৈবাহিক পর্যন্ত নাও গড়াতে পারে। কিন্তু যখন সম্পর্ক ভেঙে যায় বা হারিয়ে যায় তখনই ওই আগের সমস্যা ধরা দিতে থাকে ক্রমশ। তাই এক প্রেমের বিচ্ছেদ দ্বিতীয় প্রেমের দিকে ঠেলে দেয়, শুধুমাত্র প্রথমটিকে ভোলার জন্য অথবা ফাঁকা জায়গাটি ভরাট করার জন্য। এ সব হৃদয়ের আলো অন্ধকারের এক অদ্ভুত পর্যায়ক্রম । আমরা বুঝতে পারি , কিন্তু খুব বেশি কিছু করতে পারি না। ধাবিত হতে থাকি এমন এক দিকে যেখানে পাওয়া যাবে মনের মানুষটি। মনের মানুষ খুঁজতে খুঁজতে একটা জীবন চলে যায়, তবু হয়ে ওঠে না। এই প্রেম-রূপ মনের মানুষের সাধনায় কেউ কেউ বিরহ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ বেছে নেয় অনন্তের দিকে , ঈশ্বর প্রেমী হয়ে যায় , আবার ডুবে যেতে পারে কবিতায় গল্পে । সাধারণত কবিতার মাধ্যমেই শুরু হয় বিরহ ভোলার যাপন প্রক্রিয়া। সেই হারিয়ে যাওয়া মনের মানুষটি কখন যেন কবিতার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে কাব্যরূপে ধরা দেয়, যেন তার কাছেই আছে সেই সুগন্ধি নির্যাস। অতৃপ্তি না-পাওয়া থেকে সেই বোহেমিয়ান মানুষটি ক্রমশ ক্রমশ রূপান্তরিত হতে থাকে শব্দ সহবাসের প্রকটে। কবিতা তাকে আশ্রয় দেয় । কবিতা অনেককে আশ্রয় দেয় , ফিরিয়ে দেয় না, বিনিময়ে তার চাওয়ার কিছু থাকে না । কবিতা সেই মানুষটির সাথে যোগসূত্র তৈরি করে ফেলে , যে যোগসূত্র থেকে উদাসীন মানুষটি আর সরতে পারে না । সরে গেলেও পুনরায় ফিরে আসে । এই ফিরে আসা ছাড়া তার আর কিছু করার থাকে না, কারণ কবিতা একইসঙ্গে একটি রোগ এবং সেই রোগের ওষুধ। তবে এ রোগে শরীর ক্ষয় হয় না, উপরন্তু মনের সমৃদ্ধি হয় । মনের মানুষ খুঁজে না পাওয়া সেই মানুষটি আবার ও পেয়ে যেতে পারে কাউকে। না পেলেও তখন তার চলে যায়, কারণ তার সহবাস ভিন্ন এক ঘরানার সাথে গড়ে উঠেছে। 


বসন্ত নিয়ে আলোচনায় প্রেম আসবে না এমন কি হতে পারে। সঙ্গে কোকিল পলাশফুলের সৌরভ । তাই কবির কাছে বসন্ত যেমন রঙের , তেমনি নতুন ভাবে কবিতার ঝাঁপি খুলে নতুন উদ্যোম শুরু করার প্রয়াস। নতুন ভাবে শুরু করা যেকোনো সময় যে করা যাবে না তা বলছি না। আসলে বসন্তের ভিতরে লুকিয়ে থাকে একধরনের মালিকানা হারিয়ে ফেলার প্রবণতা, সেন অস্তিত্ব সংকট । এ সংকটে মানুষের মন দূরে দূরে কোথাও চলে যায়। সে তার অনুরূপ কিছু একটা ধরতে চায়, কেন ধরতে চাইছে , কী তার অভিপ্রায় , এ সব উত্তর সে সবটা জানে না হয়তো , তবু সে বুঝতে পারে কেন তার চায় । নাকি এই পথ চলাতেই আনন্দ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন