রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়

পর্ব-৬

সংযুক্তা পাল

সমর সেন এর কবিতার বৈদগ্ধ্য নাগরিকতা কেন্দ্রিক।নগর কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণিচেতনার বিকৃতি,লালসা,সস্তা গিমিক , কৌশল,পলায়নী মনোবৃত্তি, তথাকথিত শিক্ষিত মুখের আড়ালে এক বোধহীন, আত্মসমালোচনাহীন, বিবেকহীন প্রগলভতা, তাদের সাধ ও সাধ্যের মধ্যেকার ব্যবধান অতিক্রমের অনতিক্রমণীয় প্রচেষ্টা, একইসঙ্গে মধ্যবিত্ত মনন-মেধা ও মানসিকতা—সবটাই যেন ভীষণ সাবলীল ও সরাসরি কবিতায় উপস্থাপন করেছেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে অপর এক বিখ্যাত কবি অরুণ মিত্র এর বক্তব্য–

               " আর ভিতরের দিকে তাকালে দেখি , নিজের শ্রেণি-পরিচয় তাঁকে বিক্ষুব্ধ করছিল বারবার। শহুরে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী অন্তঃসারশূন্য চরিত্র তাঁর অশ্রদ্ধা জাগায় প্রথম থেকেই এবং এই শ্রেণীর একজন বলে  তিনি নিজেকেও রেহাই দেননি কখনো।এই বিতৃষ্ণা তাঁর স্মরণকে বিচলিত করেছে একেবারে শেষপর্যন্ত।এই কারণে একটা একটা ছক দেখা দিচ্ছিল তাঁর সৃষ্টিকর্মে, এবং পুনরাবৃত্তির এক প্রবণতা। কবিতার রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে তা থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি পারছিলেন না যেন।" (অরুণ মিত্র/'কবি সমর সেন', 'অনুষ্টুপ' পুলক চন্দ সম্পাদিত, সমর সেন বিশেষ সংখ্যা)

এই প্রথম আধুনিক কবিদের প্রেম তথা নারী ভাবনার বাঁক বদল হল সমর সেন এর হাত ধরে। 'বনলতা' , 'মহাশ্বেতা', 'শাশ্বতী' এরকম নামাঙ্কিত বিশেষ কোন নারীর সন্ধান আমরা তাঁর কবিতায় পাইনা। তবে ঘুরে ফিরে উর্বশীর অনুষঙ্গ বহুবার এসেছে নাগরিক বহুধা প্রেক্ষাপটে। কোনো শাশ্বত প্রেম বা প্রেমিকার দ্বারস্থ তিনি হননি; তাঁর প্রেমের কবিতায় নারীও যেন সেই বৈকল্য-বোধির অংশ যা তাকে আশ্রয় দিতে ব্যর্থ, বিরহ-বেদনা, যান্ত্রিকতা, অপ্রাপ্তি আর শরীরী চেতনায় ধ্বস্ত তাঁর নারী।এক মেট্রোপলিটন সংস্কৃতির অলজ্জ প্রকাশমানতায় তাঁর দেখা নাগরিক প্রেম–'পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার' মত,আর নায়িকারা কেউ ফিরিঙ্গি, কেউ চীনা কেউ বা বিশেষিত 'উর্বর মেয়ে' হিসেবে।


"সমর সেনের কবিতায় অশালীন অনুষঙ্গ অথবা বিষাদ তিক্ততা , আমাদের বিবেচনায় সমসাময়িক যুগজ্বরের বিকার।অথচ নির্বিকার নন তিনি;সেই যুগ তাকে বিষন্ন করলেও তা ধৃত হয়েছে সচেতনার নিজস্ব প্রখরতায়, বিশ্লেষণবুদ্ধির মেধাবী উপস্থাপনায়।" (হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় 'সমর সেন: নিরাপত্তাহীন নাগরিকতা, বিষন্নতাবোধ ও আধুনিক বাংলা কবিতা', বিবেক ভারতী)


আধুনিক মননসঞ্জাত হিংস্রতায় 'নাগরিকা' র বাস্তব জীবন পাঁচালি; কাঠিন্যের বিষাদ জন্ম দেয় প্রগাঢ় অন্ধকারে চুবিয়ে রাখা শীতল হাহাকার–

"কালো পাথরের মতো মসৃণ শরীর,/মেয়েটি চোখ মেলল  বাইরের আকাশে-/সে চোখে নেই লীলার আভাস, নেই সমুদ্রের গভীরতা,/শুধু কিসের ক্ষুধার্ত দীপ্তি, কঠিন ইশারা,/কিসের হিংস্র হাহাকার সে চোখে।" ('নাগরিকা'/কয়েকটি কবিতা)

নারী কতকটা রক্ত, কতকটা মাংসের, অবিচ্ছিন্ন ধারায় তাই উর্বশীর মিথ কবিদের ভাবনায় নারী চেতনাকে ধারাবাহিকভাবে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। পৌরাণিক উর্বশীর

মতই মর্ত্যের উর্বশীরাও আবহমান পন্যায়নের শিকার,হতাশ্বাস, বেদনাক্লিষ্ট নারীশরীর দপদপ করতে থাকে মূল্যবোধহীনেদের জানুর নীচে।


'হে ক্লান্ত উর্বশী,/

চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষন্নমুখে/উর্বশীর মেয়েরা আসে:/কত অতৃপ্ত রাত্রির ক্ষুধিত ক্লান্তি,/কত দীর্ঘশ্বাস,/কত সবুজ সকাল তিক্ত রাত্রির মতো,/আরো কত দিন!' (উর্বশী,ঐ)


'উর্বর মেয়েরা' আসলে যেন কবির সেই শ্লেষোক্তি, যেখানে সামাজিক ব্যাধির মত তাদের গ্রাস করে নেয় শ্বাপদ ক্ষুধা, বিষন্ন রাস্তার মোড়ে অদ্ভুত আলো-আঁধারির খেলায় ঐ সব উর্বর মেয়েরাই হয়ে ওঠে নাগরিক বিলাসিতা  যা হয়তো তাদের অনিচ্ছাকৃত ভবিতব্য। সেই অনির্দেশিত ভবিতব্যে কুড়িয়ে পাওয়া সস্তার নুড়ি-পাথরের মতই মেয়েদের জীবন এক চূড়ান্ত বালখিল্যতায় পর্যবসিত হয় তাই হয়তো কবির এমন প্রশ্ন–

"হে ম্লান মেয়ে,প্রেমে কী আনন্দ পাও/কী আনন্দ পাও সন্তান ধারণে?" (মেঘদূত,ঐ)

'স্বর্গ হতে বিদায়' কবিতায় সেই সত্যই জানান দেয় যা সমালোচকের বিবৃতি অনুযায়ী–'আবার সেই উর্বশীকে নগর ,শহর এই ধূসর কলকাতায় দশ টাকায় বিক্রিত হয়ে তাড়ির নেশার আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে দেখা যায়।...যৌনলোলুপ মানুষদের  সামনে অল্প পয়সায় কেনা গণিকা –নর্তকী(উর্বশী)ধূসর মৃদু ল্যাম্পপোস্টের আলোয় নাচে।... আবার সেই উর্বশীকে দেখা যায় যে কোনো দিন,-মোটরে,বারে আর রবিবারে ডায়মন্ড হারবারে; সেখানে কয়েকটাকায় কেনা যায়,কয়েক প্রহরের সস্তা উর্বশীকে ।এই হলো কলকাতার নাগরিক জীবনের ক্ষতময় বিষাদ , অন্ধকারের ভিতরের নিকষ–অন্ধকার–

কীটসমূহের কিলিবিলি।'

"হে শহর হে ধূসর শহর!/লুব্ধ লোকের ভিড়ে যখন তুমি নাচো/দশ টাকায় কেনা কয়েক প্রহরের হে উর্বশী,/তখন শাড়ির আর তাড়ির উল্লাসে...।"('স্বর্গ হতে বিদায়'/কয়েকটি কবিতা)


ঠুনকো, তুচ্ছ, বোধহীন,মননহীন শরীর -

সর্বস্বতা, কৃত্রিমতা,

বিকারগ্রস্ততার ছবি কবিতার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে–

"কতো দিনই বা লাগে শরীর থেকে মুছে ফেলতে/আর একজনের শরীর সর্বস্ব আলিঙ্গন;/মধ্যবিত্ত আত্মার বিকৃতবিলাস ,স্যাকারিনের মতো মিষ্টি/একটি মেয়ের প্রেম।" ('চার অধ্যায়'/ঐ)


নারীর প্রেম যেন 'স্যাকারিন' অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত এক ভুলে থাকার প্রলেপ মাত্র,তাই দৈহিক ক্ষুধা মিটে গেলে তা ঝেড়ে ফেলতে সময় লাগেনা।


সমগ্র কাব্যচেতনা জুড়ে এমন কোনো নারীর সন্ধান আমরা পাইনা যে কবিকে নাগরিক বীভৎসতা,ক্লিষ্টতা , বিকৃতি থেকে মুক্তি দিতে পারে, সুস্থিত আশ্রয়ের হাতছানি সেখানে নেই।বিবর্ণ, পান্ডুর,ধূসর সমাজে রংচং মাখা শরীরসর্বস্বতার আড়ালে থেকে যাওয়া নারী শরীর যারা পণ্যসভ্যতার আক্ষরিক অন্ধকারের বাসিন্দা অথচ হৃদয় মন্থনে তাদেরও বিষের পাশাপাশি উত্থিত হতে পারে অমৃত কিন্তু সে দৃশ্যের অবকাশ কোথায়,না আছে প্রেক্ষাপট, ঈপ্সিত অভিপ্রায়,না সেই মানসিকতা; মূল্যবোধহীনতা ও মানবিক অবক্ষয়ের মজ্জাগত দুর্বলতার মধ্যেই নারীর এক অন্যতর অবস্থান চিত্রিত হয়েছে তাঁর মনন তথা কবিতায়।

শিক্ষিতের বুদ্ধিজীবিকা ভেতরের অন্তঃসারশূন্য মনুষ্যত্বের উদ্গাতা তাই প্রকৃত সৃষ্টিলব্ধ আলোর সন্ধান দিতে তারা অপারগ, 'নপুংসক' মন চক্রাকারে আবর্তিত একই ক্ষয়ীভূত সত্তা তথা অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে এবং বলা বাহুল্য পদে পদে ব্যর্থ সেই সত্তা খোঁজ শেষে যা আবিস্কার করে তা খানিকটা এরকম–


"আমাদের মুক্তি নেই, আমাদের জয়াশা নেই,/তাই ধ্বংসের ক্ষয়রোগে শিক্ষিত নপুংসক মন/সমস্ত ব্যর্থতার মূলে অবিরত খোঁজে/অতৃপ্তরতি উর্বশীর অভিশাপ।"('একটি বুদ্ধিজীবি'/গ্রহণ)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন