তোমাকে খুব মিস করছি, গৌরাঙ্গ

মুরারি সিংহ 

গত ২৬ জানুয়ারি ২০২১, পটলডাঙা গেলাম। প্রায় এগারো মাস পর। ২০২০ বইমেলা শেষ করে ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের বাড়ি গেছিলাম। মার্চে শুরু হল  লকডাউন। আর কলকাতা আসা হয়ে ওঠেনি। আর থাকতে পারলাম না। এতদিনের বাধা-বিপত্তি ও বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করে শেষে চলেই এলাম। আর কলকাতা আসা মানেই অবশ্য গন্তব্য ৪৯ পটলডাঙা স্ট্রিট। কবিতাপাক্ষিকের দপ্তর। 

সেদিন প্রভাতদার সঙ্গে আলাপচারিতার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই ছিল নাসের ও গৌরাঙ্গের কথা। সদ্য প্রয়াত আমাদের দুই আত্মজন। দপ্তরে ঢুকেই অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম নাসেরের শূন্য চেয়ারটার দিকে; প্রভাতদা বললেন, ওই চেয়ার আর কাউকে বসতে দিই না। বসার ঘরের আলমারির গায়ে ‘আমাদের নাসের হোসেন’ এবং ‘আমাদের গৌরাঙ্গ মিত্র’ বই দুটির মলাট। সেখানে জ্বল জ্বল করছে দুই প্রিয় সুহৃদের মুখ। দু-জনেই যেন বলতে চাইছে “এই তো আমারাও আছি, আজকের আড্ডায়”।

 সময় চলে যাচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে। প্রিয়জন হারানোর ব্যথার তীব্রতা একটু একটু কমে আসছে। মনের মধ্যে বেশি করে জেগে উঠছে একসঙ্গে কাটানো কত না অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অমূল্য সব স্মৃতি। প্রভাতদা বললেন-‘দুজনের ফটো দুটো এবার বাঁধিয়ে রাখতে হবে”। 

মনে হল, সত্যি, দুই নিকট-জন বড়ো তাড়াতাড়ি ফটোফ্রেমে বন্দি হয়ে গেল।   

গৌরাঙ্গর শারীরিক উপস্থিতিও খুব মিস করলাম। মিস করলাম দু-হাত জড়িয়ে ধরে মিহি স্বরে তার সেই কুশল জিজ্ঞাসা।  

গৌরাঙ্গর কথা আর আলাদা করে কী বলব, আমাদের কবিতাপাক্ষিকের কবিদের যৌথ পরিবারে বেশির ভাগটাই তো পারিবারিক অ্যালবাম। দেখা হলেই গৌরাঙ্গর হাসি হাসি মুখ, কুশল-বিনিময়, তারপর অনর্গল আড্ডা, গল্প— এসব স্মৃতির গভীরে মণি-মুক্তোর মতো গাঁথা হয়ে আছে। গৌরাঙ্গর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। নানা কবির নানা কবিতার লাইন গড়গড় করে মুখস্থ বলে যেত, সঙ্গে অসাধারণ বিশ্লেষণ। আমাদের কবিতাপাক্ষিকের রুফটপে আয়োজিত কবিতা-পাঠাএর আসরেও তার পরিচয় পেয়েছি। অবাক হয়ে দেখতাম, মুগ্ধ হতাম এবং উপলব্ধি করার চেষ্টা করতাম কবিতার এবং কবিদের প্রতি একজন মানুষের কত গভীর অনুরাগ, কী আন্তরিক নিষ্ঠা। সত্যি কথা বলতে কী গৌরাঙ্গ মিত্র ছিল কবিতার মধ্যেই আকণ্ঠ নিমজ্জিত অসাধারণ মানুষ। কবিতা লিখতে আসা নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়েও ছিল তার অফুরন্ত আগ্রহ; প্রাণখোলা এবং উদার তার দৃষ্টিভঙ্গি; যে-কারণে তার গুণমুগ্ধের সংখ্যাও অনেক বেশি। 

কবিতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অনুরাগ থেকেই একদিন লিখতে এসেছিলাম, কবিতা লেখার সূত্রেই পারস্পরিক আলাপ এবং আত্মীয়তা। কবিতাপাক্ষিকের আড্ডায় বা যে-কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলেই কথায় কথায় কবিতারই আলোচনা। খুব সচেতনভাবেই যে যার নিজের মতো করে বাংলা কবিতায় একটা স্বতন্ত্র্ পরিসর নির্মাণের চেষ্টা করে গেছি। জানি না, ভাবীকাল এইসব লেখালিখি আদৌ মনে রাখবে কিনা বা কীভাবে এবং কতটা মনে রাখবে। এসব নিয়ে চিন্তা করে কোনোদিনই মাথা ভারী করিনি। কারণ সেসবে আমাদের কিছু যায় আসে না। লেখার আনন্দে লিখে গেছি, নিজেদের লেখাকে উপভোগ করেছি। একে অন্যের সঙ্গ ও সান্নিধ্যকে উপভোগ করেছি। কবিতা লিখেই নিজেদের বেঁচে-থাকাটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছি প্রাণবন্তভাবে, যতটা পেরেছি ছড়িয়ে দিয়েছি অন্যদের মধ্যেও। বিশাল পৃথিবীর ক্ষুদ্র এক কোণে কবিতা নিয়ে আলাপ-আলাচনা করে একসঙ্গে কত না স্মরণীয় মুহূর্ত কাটিয়েছি। কবিতা লেখার সূত্রেই কত জনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, আত্মীয়তা হয়েছে। পরিবার ও পরিজন-বেষ্টিত  জগতের বাইরেও নিজেদের পরিচিতিকে অনেকটা বাড়িয়ে নিতে পেরেছি। আমি তো মনে করি একজন সাহিত্যকর্মীর কাছে এটাও কিছু কম পাওয়া নয়। পার্থিব কোনো কিছুর বিনিময়ে এসবের দাম নির্ধারণ করা অসম্ভব। 

১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, অনেক দিন পর কবিতাপাক্ষিকের নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। তার সম্পদকপমণ্ডলীতে বেশ কিছু নতুন নাম সংযুক্ত হয়েছে, বাদ গেছে শুধু দুটো নাম। নাসের হোসেন আর গৌরাঙ্গ মিত্র। বুকের ভেতর কোথায় যেন খোঁচা লাগল, শুরু হল রক্তক্ষরণ। ভাবলাম, বাকিটা জীবন এই বেদনাময় স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন