স্মৃতিরাই সুন্দর

অণিমা মিত্র

 স্মৃতি সততই গোলাপ। কাঁটার যন্ত্রণা এবং আমোদী। এখন এমন ঘন নিবদ্ধ মফঃস্বলী রাতে যাঁ কবিতায় ডুবে আছি, তিনি সদ্য ঘুমের ঘরে গেলেন শ্রান্তশয়ানে। তিনি কবি গৌরাঙ্গ মিত্র। তাঁর কাব্যগ্রন্থের পালকে ঠোঁট গুঁজে এখন আমি ওম নিচ্ছি বুঁদ হয়ে তাঁরই কাব্য ডানায় ভর করে।

ভাগ্যিস, ' কবিতা পাক্ষিক ' য়ের সুচারু ঠাটে প্রকাশিত ' স্মৃতিরাই সুন্দর ' আমার হাতে এলো কবি বিভাবসু-র হাত দিয়ে ' ভুবন ডাঙা 'র ইচ্ছেতে। তাইতো, এই তুরীয়ানন্দ উপভোগ করছি।

চল্লিশটি জহর-সহ কাব্যমাল্যখানি। এবার আমি আচমন করবো কবির প্রথম কবিতা দিয়ে। ' মানুষ ' কবিতায় কবি পতঙ্গ প্রজাতির দর্শনতত্ত্ব অনুভব করেছেন। আপন চেতনালব্ধ দর্শন প্রকাশ করেছেন। ' মৌমাছিরা জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য বোঝে না...বোঝে শুধু লড়াই, সংঘর্ষ, পিঁপড়েরা , বোঝে শুধু লড়াই, সংঘর্ষ। এখানেই কবি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। সওয়ালের জবাব দিচ্ছেন। তেলে- জলে নিরাপদ বিলাসী আমরা ভীরুতা- কাপুরুষতা নিয়ে আটপৌরে ' প্রিয় রমণীর জন্য ...অনুভূতিমালা 'সাহজিক ধর্মে ভাবাই যেতে পারে, ঠাকুরনগরের কবির ' অঘ্রাণের অনুভূতিমালা-কে আমাদের আলোচিত এই কবি আঁজলা ভরে পান করেছেন।

'পাখি' তে কবি বলছেন ,' উড়তে পারা না পারা বড়ো কথা নয় / পাখি হয়ে জন্মালে তবেই পাখি...

কবিগণ একপ্রকার পাখির মতোই স্বাধীন অন্তরবাসে। কবি গৌরাঙ্গ মিত্র তেমনই এক মন- বিহঙ্গ। তিনি ' পাখি ' শব্দটিতে অবসেশনে থাকতে থাকতেই উড়াল দিলেন।

'পিকাসো' কবিতাটি কবির অতি সূক্ষ্ম নিরীক্ষণসূচক। পিকাসো-র ছবি তিনি খুব কাছ থেকে লক্ষ করেছেন এবং শিল্পীর আকুল আর্তি অনুভব করেছেন। পিকাসো তাঁর ছবি আঁকা সৃষ্টিকরাম ব্যতীত কিছুই জানেন না,' তিনি গিটার বাজাতে পারতেন না/ চৌবাচ্চায় গলদাচিংড়ি চাষ জানতেন না,'...এবংবিধ কত কিছুই জানতেন না।কবি  সেটা অন্তর দিয়ে বুঝেছেন। ভাবতে ভালো লাগছে, এ কবির বিচরণক্ষেত্র কোথায় না! ললিতকলার সব ক'টি তীর্থ তিনি মানসভ্রমণ করেছেন। তাঁর বীক্ষণ দৃষ্টিতে দেখলেন, পিকাসো- আঁকা ছবি নিয়ে একটা গোটা পাবলো পিকাসো ভাস্কর্য হয়ে রইলেন তিল তিল মেধা ও প্রতিভায়। এই আমাদের কবির আন্তরভ্রমণ।


' মৌলিক দুঃখ '-তে এই কবি হয়ে ওঠেন বিষাদসিন্ধু ছেঁচা অমৃতের সন্তান। ছোট ছোট ঘটনা কবিকে আমূল নাড়া দেয়। সমাজের তৃণমূল স্তরই কবির চারণ।


এইসময় কবির দৃষ্টি ঘুরে গেলো মৃত বন্ধুর দিকে। সখ্যহারা ব্যথিত হৃদয়ে তিনি এই সারাংশ পেলেন , এই দুঃখ বিতংস কোন মৌলিক বিষয় নয়। তিনি বলেন: কত মানুষের কতরকম সমস্যা, ...চোদ্দো বছরের কিশোর- আট বছরের মেয়ে-- এদের ক্যানসার। এরপর বলেন: আমার দুঃখ কোনো মৌলিক দুঃখ নয়।'


এরপরেই কবি পৌঁছে যান এক বৌদ্ধিক বোধে শূন্যবাদী প্রশ্নে। ' ...কপিলাবস্তু থেকে বোধিবৃক্ষ--/ এই দীর্ঘ পথের দু- ধারে/ কোন মৌলিক দুঃখের দেখা পেয়ছ?


ক্ষণস্থায়ী দুঃখ- বুদ্বুদ থেকে কবির চাই নির্বাণ। তিনি জানেন,দুঃখ আসলে পার্থিব চাহিদা সঞ্জাত। তিনি এ বেদনা  নয়, চান অপার্থিব প্রেমশান্তির নির্বেদ সুখ। তিনি দেখেন,' সমুখে শান্তি পারাবার '।


কবির পরিক্রমণ এবার দেশহিতৈষণা-ব্রতে। কিছু সুপ্ত বীজ উপ্ত হ'লো এই ' কানাইদা ' তে, যাঁ বিখ্যাত লেখা-- জেলবন্দিদের আড্ডা। এই যে একটু আগের দুঃখবাদ-কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন, সে এক নিখাদ সত্য। তিনি জানেন- আনন্দম রূপম অমৃতম। কবির কাছে কানাইলাল জানা এমনই আনন্দের প্রতীক। তিনি শব্দহীন হাসি দিয়ে সবাইকে বলেন, তিনি জেলের মধ্যেই খুব সুখী, খোব পরিতৃপ্ত। সর্বত্রই খলিদ্বং ব্রহ্ম উপলব্ধি করেন। কবি গৌরাঙ্গ মিত্র-কে অভিবাদন ।


যত দেখি না , তত পড়ি কবিকে। তিনি নিজে আনখশির অপূর্ব অনুভূতির বিশ্ব-দার্শনিক কবি। তাঁর ' বিশ্বনাগরিক ' কবিতায় পাই-- ওঃ, যা ঠাণ্ডা পড়েছে এবার-- 

এবছর প্রাণান্তকর গরম, অসহ্য-- '। কী নিপুন প্রয়োগশৈলী! কাব্যরসিকগণ, সম্ভবত খেয়াল করেছেন, পংক্তিদু'টি শেষ হ'তেই পৃথিবী সম্পূর্ণ করে ফেলেছে তার বার্ষিক গতি।


তিনি বিলক্ষণ জানেন,দু'টি ঋতুই আমাদের জীবনে প্রাধান্য পায়। শীত- গ্রীষ্ম। সূর্যের চারপাশে পৃথিবী প্রদক্ষিণ বার্ষিক গতি। কেউ কেউ কেবল স্বল্প দৈর্ঘে শৈত্য ও প্রখর উষ্ণতা নিয়েই বলেন অনবরত। এখানেই পাঠক  রাজনৈতিক আগুনের সামান্য আঁচ পেলেন। বাতাবরণ তো এমনই হবে। কখনো উত্তাল, কখনো বা শীতলতম হয় পতাকাবাহকের নিয়ন্ত্রণে। এই  রাজনৈতিক তাপমান জানার মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বনাগরিক হই। আমরা হাসি কাঁদি বিশ্বের হাসি- কান্নায়। এখন ভাবি, আগে কেন কবির সংগে আলাপচারিতা জমে উঠলো না!

'চালাকি ' কবিতাটিতে আমরা কবির সগোক্তি পাই। প্রকৃতই তিনি সাদা পাতার আন্তরিক তাঁর চিরাগ হাসিতে।  কেউ তাঁকে চালাক আখ্যা দিলে, সেটা নিয়েই কবির দু'চার কথা। ' আমি নিতান্ত নাদান, চালাকি করার জন্য

মিনিমাম চালাকি বিদ্যেটি

আমার ভাঁড়ারে কোনদিন ছিল না


' তুচ্ছ ' কবিতাটি পাঠককে আকর্ষণ করবে এর দ্বন্দ্বমূলক ব্যাবহারিকতায়।

কতো কী তো আমরা দেখি। সে রকমভাবে কী নাড়া দেয় হৃদয়কে! সামান্য গুবরেপোকা বুক চিৎ করে চলে, হাতল-ভাঙা কাপ, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ছাইয়ের স্তূপ তো থাকবেই। কাপের হাতল তো ভেঙে যেতেই পারে, গুবরেপোকার চলন তো ওরকমই, আর ' বটগাছের নীচে পরিত্যক্ত' কঞ্চুক ; এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। এরপর  সারান্ডা জঙ্গলের শুকনো ঝরাপাতা-- এই বা এমন কী আহামরি!  এরপরেও যেটা ঘটে-- ভ্রমণরসিক এক কবির কবিতাগুচ্ছ অথবা সে কবির জীবন- মরণ সবটাই সাধারণ দৃষ্টিতে খুবই তুচ্ছ। প্রকৃতই কী তুচ্ছ? না তো! দেখতে গেলে, অতি তুচ্ছকে আপাতভাবে না দেখে দেখার জন্য অতিরিক্ত অন্তরদৃষ্টি চাই।

এ যেন নির্মাণ থেকে বিনির্মাণে পৌঁছনো । কবির কথায়-- ' রূপ- রস-শব্দ- গন্ধের বিনম্র নির্মাণ।' হ্যাঁ, কবি গৌরাঙ্গ মিত্র  একদম ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছেন। ' বিনম্র নির্মাণ ব্যতীত  অতি তুচ্ছতম দৃশ্যও ক্লাইম্যাক্স ছোঁতে অক্ষম। ধন্য কবির অন্তর্দৃষ্টি।

এবার পড়ুন ' ময়নাপাখিদের বাংলা '। আমরা যে কী ভাবে হ্যাংলা হচ্ছি ইংলার জন্য , তারই লজ্জাহীনতার নিদরূশন এই কবিতাটি।

শুরুতেই কবি বলছেন: টুবান সুন্দর সুন্দর সব ইংলিশ পোয়েট্রি মুখস্ত করেছে, 

তবে বাংলাকবিতা ভালোই আবৃত্তি করে,...টুবান বাংলা হরফ চেনে না, তাই আবৃত্তি -স্যার ইংরেজি অক্ষরে লিখে দিয়েছিলেন: এই হ'লো আমাদের মাতৃভাষার হাল হকিকত। বাংলাভাষার প্রতি এই যে অ-নৈতিক অনীহা, আমাদের পীড়া দেয় না--আমাদের লজ্জিত করে না। এই অ-গুণ বা বদভ্যাসটি টুবানের নয়, আমাদের নৈতিক অবনমন। আমরা আমাদের দীনতায় কুন্ঠিত নই। কর্পোরেট দুনিয়ায় নিজেদের সন্তানকে শেকড় চেনাই না, পাছে লোকে' মেঠো ' বলে। তাই রোমান হরফে রবীন্দ্রনাথ চেনাই।'Gogone garoje megh ghono barosha'। এভাবেই উদ্বাস্তু হয় মাতৃভাষা ও আমাদের সন্তানরা। অন্যদিকে ' টুবানদের ময়নাপাখিটাও সুন্দর বাংলা শিখেছে,

ও বলতে পারে-- ' খোকা ভালো আছ তো?'...ওকে ঘাঁটাঘাঁটি রেগে গিয়ে বলে-- ' ধ্যাত্তেরি '

আমরা ছুটে চলেছি গড়ানে ধাতব বস্তুটির পিছনে। পা পিছলে না যায়' মুদ্রা '। ময়নাকে শেখাই বাংলা অন্যকে চমকে দিতে। টুবানকে প্রতীচী ভাষা শেখাই পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে তাল ঠুকে চলতে।কবির করুণ আর্তি এ কবিতায় স্পষ্ট যে , দেখনদারিতে আমরা সেই কবে থেকেই মনে প্রাণে উদ্বাস্তু নিঃস্ব হয়ে বসে আছি।

' জীবন 'কে কবি কতভাবে না আস্বাদন করেছেন! এই জীবনকে তিনি ' কানামাছি ' খেলার সংগে তুলনা করেছেন। বাস্তবিক তাই। জীবন তো ভোঁ ভোঁ ই। আমাদের সম্বল এই একটি জীবন যাকে, কতো না আরামপ্রদ বিলাসে ভরিয়ে রাখতে চাই। কবি বুঝেছেন, এ জীবনের বিপ্রতীপে যে আঁধার , সে এক জ্যোতির্ময় আলো।সেই কী আত্মারাম , যে গড়ের মাঠে হাওয়া খায়; অর্থাৎ মুক্ত জ্যোতিঃ!  বায়স এক সত্যদ্রষ্টা। সে উড়ে যেতে যেতে সত্যবাণী  উচ্চারণ করে: স্মরণ- বিস্মরণ পড়ে থাকে মাঠে, মাঠের কিছু দূর দিয়ে

বয়ে যায় নদী...। 

জীবন- মরণ নয়, মরণাতীতের কিছুদূর দিয়ে

বয়ে যায় নদী...

জীবন বয়ে যায় বৈতরণী দিয়ে, সব স্মৃতি- বিস্মৃতি পড়ে থাকে।অপূর্ব দর্শন!

এবার আমাদের প্রিয় কবি এক লম্বা ইনিংক্স শুরু করেছেন লঘু ধীর লয়ে- ক্রমে বিলম্বিত হ'তে হ'তে দ্রুত লয়ে। চলে এলেন কবি মেটামরফোসিসে তাঁর ' রামধনু ' কবিতায়। রাজনৈতিক মেটিমরফোসিস। একেই কী বলে কাব্যকলাকৃৎস্ন! 

প্রথমেই তিনি ক্যারামবোর্ডকে রূপক হিসেবে দেখালেন তাঁর এই ' রামধনু ' কবিতায়। ক্যারামবোর্ড কী রাজনৈতিক ময়দান? সাদা এখানে কিসের প্রতীক? সততার? ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে ' স্টারাইকার ' আঘাত করাতে লালরক্তের ময়দানে মার খেয়ে নীল হয়ে গেলো। কী চমৎকার রূপান্তর! ' নীল ' হয়ে যাওয়া সততা ' নীলপদ্ম ' হয়ে গেলৌ। কীসের ইংগিত এই ' নীলপদ্ম '! আহা, কী রাগ! সে নাকি রামচন্দ্র ব্যতীত আর কারো পাণিগ্রহণ করবে না-- চমৎকার ইংগিত। পাঠকের জন্য আরও কিছু অপেক্ষমান। ' পাণিগ্রহণ 'য়ের সংকল্প শুনেই কী বেণিআসহকলাসহ প্রজাপতির রং নিয়ে নিজেই  সপ্তবর্ণ হয়ে যাবে।

কবি চাইছেন, তিনি নিজের পছন্দমাফিক কয়েকটি রং দিয়ে একটি রামধনু আঁকবেন এবং সে রামধনু থেকে প্রজাপতি উদ্গত হয়ে উড়ে যাবে নীলপদ্মে। এবার বুঝুন মেধাবী পাঠক, কোনো রাজনৈতিক রং নয়, প্রকৃতির রং চাই কবির। মেঘের পাটভাঙা রোদের রামধনু।স্বপ্নের আবেশ। নীলপদ্ম- প্রজাপতি- রামচন্দ্র। যেন বা এক অযোধ্যার শান্তি।সবটাই কী ইউটোপিয়া, নাকি ডিসটোপিয়া! এ কী সুখস্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন। কবি আশাবাদী। সুখের দেশের স্বপ্ন দেখছেন। হ'তেই হবে কবির স্বপ্ন সফল। তিনি যে নিজেই রামধনুটাকে আঁকার চেষ্টা করবেন। রামধনুর শরীর থেকে একটা প্রজাপতি উদ্গত হয়ে নীলপদ্মের দিকে উড়ে যাবে, এ দৃঢ় প্রত্যয় আছে কবির। ততক্ষণ কেন যে তিনি অপেক্ষা করলেন না!

কবি যে ঋতবাক্ , তা আমরা জানি। তিনি সত্যদ্রষ্টা , জানি। এ কবিতায় কবি ' স্যান্যালকাকু  নামক এক চরিত্র আনলেন। কবি- সৃষ্ট স্যান্যালকাকু কবিকে না আলোর কথা, না, সাদা-কালোর কথা বলেছেন। কবি তো জানেনই না যে,' জীবন ও মৃত্যুর মাঝে যে এক গভীর পরিখা আছে/ সেখানে যে ছ-টা কুমির আছে সেকথাও বলেননি, --

এই জীবন- মৃত্যুর মাঝখানে পরিখা না কর্মচক্র? সে তো এক পরিখাই বটে। এখানেও কী সেই মেটাফর - সিমিলি- রূপক-- উপমা নেই? আছে তো! ঐ যে ছ'টি কুমিরের উল্লেখ , ওরা কী ষষ্ট রিপু নয়!  কুমির দাঁতে চিবিয়ে খায়। ষষ্ট রিপু ও তো চিবোয়। আমাদের আত্মারামকে। কুমির মাতলা নদীর স্রোতে ভেসে আসতে পারে-- রূপক এবং রূপক। ' মাতলা নদী' অর্থাৎ কী না মাতাল জীবনপ্রবাহতে ছ-টি কুমির রূপী ষষ্ট রিপু।হ'তে পারে, কুমিরপ্রকল্প'র লোকজন  ওদের ছেড়ে রেখে এসেছে দোলপূর্ণিমা রাতে-- যখন 'জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে,'

কবির কী কোন দায় আছে বা তাগিদ তিনি অনুভব করেন, এর বেশি কিছু বোঝাবার! নেই তো! এই ' স্যান্যালকাকু ' কে? চারু স্যান্যাল! তিনি বলেছেন, তোমরা -  সব এগারো বিষয়ে ফেল... খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঐ এগারো বিষয় কী তবে ধরে নেবো, এগারোটি অ্যাজেন্ডা! তাতেই ফেল , অর্থাৎ বিফল।

এই কী সেই জাদু- বাস্তব মায়াকাঠি। জীবনের ধ্রুবলক্ষ্য -চ্যুত। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। কবির আশ্চর্য আদর্শ স্বপ্নরা কবিকে ছেড়ে একে একে চলে গেছে। কবিও তো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। জানা হ'লো না, ঐ এগারো বিষয় কি ছিলো।


কবি ' একাকিত্ব ' কবিতায় তাঁর একাকিত্ব বিশ্লেষণ করেছেন অপরূপ ঢঙে। একাকিত্ব কী ভাবে জন্ম নিলো, তারই সুলুকসন্ধানে কবি আলো বিষয়ক থিয়োরিকে প্রৌলগ করেছেন।যখন চারপাশ নিরর্থক আলোর রোশনাই-এর ঝলকে উচ্চকিত হয়, তখন প্রদীপের শান্ত মধুর আলো ম্লান লাগে। যে যৌবনমত্তা তার সৌন্দর্যের আলো-কে অকারণ ব্যয়িত করলো, সেই পরমা রূপবতী । কবি অসহায় বোধ করেন এমন অপচয়িত আলোর মধ্যে। তিনি যাচ্ঞা করেন অনুচ্চ বাতাবরণ -- মেঘলা আকাশ-- ঝিঁঝিরব পায়ের কাছে। কবি দেখলেন, ওজোন-স্তর থেকে প্রাজ্ঞ ও অভিজাত চিল জানায়: একাকিত্ব আপনাআপনি জন্মায়-- স্বয়ম্ভু-- 

একাকিত্বের সঙ্গে আকাশ,ঝিঁঝিপোকাদের 

কোন অনিবার্য সম্পর্ক নেই।...একাকিত্বের কোন থিয়োরি হয় না, কবি জানেন। তা'হলে ' আলোর থিয়োরির মতো ভেঙে খানখান হবে।' 

এই যে একাকিত্ব, এটা কবির একান্ত নিজস্ব অলঙ্কার কবিই তো একা হয়ে যেতে পারেন , কারণে , অকারণে। এই একাকিত্ব কবির সহজাত কবচ।


' স্লেজগাড়ি '


কবি তাঁর পূর্ববর্তী কবিতায় একাকিত্বের আস্বাদন গ্রহণ করেছেন। এখন তিনি স্মৃতিমেদুরতায় আবিষ্ট।এখন তিনি সুপুরিপাতার স্লেজে চড়ছেন ডাউন মেমারি লেইন ধরে। এমনই চলে কবির কথকতা নিজের সাথে।

ইচ্ছে


অন্তর- মাণিক্য- কারবারি কবি গৌরাঙ্গ মিত্র। তিনি স্ব-স্বাধীন। যখন যে শব্দের প্রেমে পড়েন, সেই শব্দের মালিকা গাঁথেন।  পক্ষহীন কবি যত্রতত্র উড়ান দেন।ডানা ছাড়াই তিনি স্বপ্নদের মতো। স্বপ্নরা হেথাহোথা  - মায় সৌরলোকে।

কবি লক্ষ করেছেন তুলোর ওড়াউড়ি। ওরাও দিব্যি কেমন উড়ছে আপন খেয়াল- খুশিতে।

কবির আহ্লাদী  ইচ্ছেদের ডানাহীন ওড়া ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে। শুধুমাত্র মন-খারাপদের উড়তে অনীহা। তাই তো!  রাজ্যের মন-খারাপ নিয়ে কী ওড়ার মন থাকে? থাকে না তো! যেমন কবি উল্লেখ করেছেন, পাষাণী অহল্যাকে।   এতটাই বিষণ্ণমনা অহল্যা অপমানে যে, ওড়ার ইচ্ছেটুকু  সে হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃতই, সমস্ত ক্রিয়াপদ সংবৃত্তিমূলে থাকে এই ইচ্ছে। বাহ্ ,কবি বাহ্।

' মহানন্দময় ' নিয়ে আমাদের বিশেষ কিছু বলার থাকে না, অর্থাৎ একটি বিষয়-কে কবি নানান শৈলীতে প্রকাশ করেও শমে আসতে পারছেন না। তৃপ্তি কই? এটাই কবির সু-দিক নির্ণয়, যেমনটি ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। তিনি  একটি বিষয়-কে গল্পে- নাটকে- এমনকি কবিতাতেও প্রকাশ করেছেন।


বরং আমরা চলি ' ব্রেইল অক্ষর ' এ। ঐ যে বললাম, কবি বড়ই অনুভূতিপ্রবণ। সেই সংগে মৃদুভাষ্যে কিছুটা ক্ষুণ্ণমনাও বটে। তিনি তাঁর ক্ষুণ্ণতা প্রকাশ করলেও প্রকৃতিগত স্মিতহাস্যে ক্ষমাসুন্দর। তাই, তিনি, চক্ষুষ্মান হয়েও যারা দৃষ্টিহীন, তাদের  চোখে আরবি-সুর্মা পড়াতে নারাজ। বরং কবি  পৃথিবীর রজনিগন্ধ দেবেন তাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে। আরও কতো যে সাধ কবির! যারা শু-শ্রবণে অনীহ, তাদের পিকধ্বনি শুনিয়ে বলবেন: এই আমাদের পৃথিবী সংগীত। কবির সর্বশেষ উপতাপ, অন্তর- কান্না তো বটেই। ' ব্রেইল হয়েই থাকতে হচ্ছে অক্ষরকে। অক্ষরের ও যে কান্না থাকে, সে অনুভব একমাত্র কবির। কেন না,চক্ষুষ্মান হয়েও এরা অক্ষর

 চেনে না। এ এক গভীর আক্ষেপ কবির।

' হাসি ' কবিতার মধ্য দিয়ে কবি'র সদা হাস্যময় চরিত্র প্রকাশ পায়। তিনি চান, এ জগতের যতকিছু আবিলতাহীন ক্ষমাসুন্দর সারল্য , তার সবটাই তিনি আস্বাদন করবেন। গোমড়ামুখো-দের প্রতি তাঁর নিদান, প্রগাঢ় প্রেমে - ভালোবাসায় জগতের এই আনন্দযজ্ঞে হাসির এতো উপাদান আছে, প্রাণভরে শ্বাসগ্রহণের মতো দরাজ হাসিতে পৃথিবীকে স্বাগত জানাও। কিন্তু গ্রামভারি-রা জঘন্য ছুঁতমার্গবোধে তিথি মেনে কেবলমাত্র দু'টি পক্ষে হাস্যবদন হন। ওটাই নাকি,' শাস্ত্রসম্মত এবং স্বাস্থসম্মতও।' এ কবিতাতেও কবি স্যাটায়ার প্রয়োগ করেছেন। এ কবি হাস্যমুখে শাসন করেন, ন্যায়-অন্যায় বোধ নিয়ে। হায়, আরও কিছুদিন তিনি থাকলে , বোধহয় সবটা না হ'লেও কিয়দংশ সবুজ হ'তে পারতো আমাদের বাসভূমি।


' ভুল '

কবির 'ছোলা ' তো একটি প্রপ। ছোলা-কে অবলম্বন করে তিনি মূল বিষয়ে এগিয়ে চলেন। " ছোলাগিছ উপড়ে নিয়ে কাঁচা ছোলা খেতে খেতে ভুলে গিয়েছি/...রাজনীতি-নিরপেক্ষ এক জিরাফ, অপেক্ষা করতে করতে...ঘাসের বস্তায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। " লুকোচুরি খেলতে গিয়ে  কবিও ঘুমিয়ে খড়ের গাদায়। তাঁ বালক বয়সের নর্মসাথি সুমি তার হতাশা ধুয়ে ফেলে ইছামতী'র ঘোলাজলে। এ কোন্ লুকোচুরি'র ইংগিত দিলেন কবি! হ্যাঁ, আমরা লুকোচুরি খেলি, নিজের সংগে কম, অন্যের সংগেই বেশি। নিজেকে সরিয়ে রাখতে , মজা করে; অথবা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে। সুমিও তেমন স্বচ্ছজল পায় না হাত ধুয়ে ফেলতে। জল তো সততার পবিত্রতার প্রতীক।  সুমির হাত ধোয়ার  জল কিন্তু ঘোলাটে। এই আমাদের সুমির নিয়তি। 

এভাবেই ভুলতে ভুলতে কখন যে জীবনপ্রবাহ মরানদী হয়-- সেখানে গরু--গিড়ি অনায়াসে পার হয়। এর কী অর্থ? কবি কী বলতে চাইলেন যে,সময়-কে অবহেলা করতে করতে এ জীবন-নদীও প্রাণহীন হয়ে যায়।

এবার আমরা চলে আসছি ' মাল ' কবিতার কাছে আমাদেল এ কবির পরিক্রমণ   রাজনীতি-মেধা থেকে গার্হস্থ্য-মেধা-প্রেম-মেধা তথা মনোবিক্ষেপ- মেধানীতি সর্বত্র। তিনি রবীন্দ্রনাথ-কে চেনেন তাঁর সর্বকালীন সেরা সাহিত্য দিয়ে। আইনস্টাইন-কে চেনেন তাঁর রেলাটিভিটি দিয়ে। পিকাসো-কে তাঁর শিল্প-কর্মে। কবিকে এই প্রথম দেখি, তিনি অপভাষা প্রয়োগ  করলেন।...বিপ্লবেশ্বর, কলির কেষ্ট হে, / তোমার মতো মালকে চিনব না।/ আমি মাল চিনি, / পয়মাল চিনি,/ শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভান্ডার চিনি,/ শ্রীমতী কমলাদেবী চিনি...। তিনি এই প্রথম ' মাল ' এই কুবাক্য-টি ঘৃণায় হতাশায় হাতিয়ার করলেন।এবং লক্ষণীয়, ক্রোনোলজিক্যালি'শ্রীহরি ' ' শ্রীমতী 'প্রয়োগের মাধ্যমে কবির এক ধ্রুপদী কাব্যিক শৈলীর পরিচয় পাই। কবি তাঁর যাপন অভিজ্ঞতায় জীবনের হদ্দমুদ্দ দেখে নিয়েছেন। তিনি ' মাল ' চেনেন, ' পয়মাল 'ও চেনেন।বলছেন--' হাড়- মাস- মজ্জায় তোমাকেও চিনি।'/ বিপ্লবেশ্বর হয়েছ তুমি/ যদিও তুমি বিপ্লবেও নেই, ঈশ্বরেও নেই।' এখানেই কবির মাস্টার স্ট্রোক। মুখে বিপ্লব প্রচার, সামাজিক কৌলীন্য হেতু; বাস্তবে বিপ্লব থেকে যোজন দৃরত্বে এবং ঈশ্বরেও আস্থা নেই। এটাই আমাদের প্রকৃত সামাজিক চালচিত্র। এই কবিতাতে আমরা প্রথম  কবির প্রত্যক্ষ শ্লেষ দেখি।

এবার  আমরা কবির ' কথা '- য় দেখবো , কবি বলতে চাইলেন। কথাই তো প্রতিবাদের ঝড়।সমবেত গর্জন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সমাজ-সমতটে জনসমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়লে কবি সতর্কীকরণ বার্তা পাঠিলেন। ' হেলমেট ' এখানে একটি নিরোধক শব্দ। আমরা যারা অসমতল পথ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকি-- শিখে নিয়ে জানি, কি ভাবে মাথা বাঁচিয়ে চলতে হয় বিপদ-সংকুল  সমাজ থেকে। নির্লিপ্ত আবরণ মধ্যে সুরক্ষা- কবচ নিয়ে বলি: আমরা নিরপেক্ষ। ইদানিং একটা কথা মিডিয়া দৌলতে খুব চিবুচ্ছি। "  আমি সাতেও নেই, পাঁচেও নেই ।" সেই বিজ্ঞাপিত মৃদু হাস্যমুখ। ' মা বদ ।' যা বলার, কলম বলবে। আমাদের প্রতিনিধি হোক কলম। দেশে দেশে যত বিপ্লব হয়েছে, তার পথ-প্রদর্শক এই কলম। লেখায় জনমত তৈরি হ'লে আসবে বিপ্লব।অতএব, কথা নয়, জঙ্গলের- জনপদের- হিতোপদেশের- নিরাময়হীন ব্যাধির-- সব কথা বলবে , জনগণ নয়, কলম।


' স্বপ্ন ' কবিতা কবির জিরেন- ভূমি। অনেকটা পথ হেঁটেছেন কবি তাঁর মননভূমিতে।এবার খানিক রিলিফ  দিচ্ছেন ভাবনাকে।এ যেন রাগ- ভিত্তিক সংগীতের পর একটি লঘু সংগীত পরিবেশন। কবি এখন আয়েস চান, বরং বলা ভালো, মেধার বিরাম চাইছেন। এবার তিনি প্রকৃতি- সঙ্গ করবেন। তিনি দেখতে পাচ্ছেন, দোপাটি-পাপড়ি তাঁকে দেখে নির্মল হাসছে-- ময়না তার দুষ্টু-মিষ্টি শিস্ দিয়ে কবিকে খেলার সাথী করেছে। আজ কবির সারাদিন নিসর্গ উপভোগ।প্রজাপতি তার রং-বাহরি পাখা কবির জন্যই মেলে দিয়েছে। অনেকটা কঙ্করময় পথ হেঁটে তিনি ক্লান্ত। কবিকে তাই স্নিগ্ধ করছে মৃদু-মন্দ মোলাম পরি। কবি জানলেন, এমন অনঘ স্বপ্নে কেউ আবিল হয় না, কারো অ-হিত হয় না। কবি তাই এমন ঘুমে স্বপ্ন দেখতে পারেন। ঘুমোন কবি, নিটোল স্বপ্নে থাকুন ঘুমের দেশে।

' দুঃখ ও ট্রাম ' এ দেখি,  স্বপ্নের আবেশ- পোশাক ছেড়ে  কবি এখন ট্রাম- রাস্তায়। আপাত পাঠে এটি একটি লঘু কবিতা। তাই কী! পাঠক, ' ট্রাম ' শব্দটিকেএকটু চাপ দিয়ে পড়ুন। বুঝবেন, এই শব্দটি অন্য মাত্রা এনে দিচ্ছে। ট্রাম-কে আমরা কোন অর্থে ধরবো?  রথ! দুঃখ ও ট্রাম কী অদ্ভুত না! দুঃখ এলে ট্রামও এসে গেলো। একটি নয়, চারটে। সুখবিলাস নামক কবিকে হয়তো নিয়ে যাবার জন্য। কোথা নিয়ে যাবে দুঃখ ও ট্রাম! সুখবিলাস কী তা জানে? কে এই সুখবিলাস? সে কী আমাদের কবি নিজেই!   আর এই যে দুঃখ বনাম ট্রাম? এতক্ষণে বোধগম্য হইলো। ট্রাম আয়েস- বিলাসের প্রতিভূ  । রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা  করা কষ্টের প্রতীক।সত্যিই তো , কষ্ট ও আরাম একসাথে এলে কবি তখন কী করেন!


' অন্ধকার ' এ - কবি গাঢ়তম  অমা  চাইছেন। অমার ভিতরে আনকোরা শব্দ খুঁজছেন। জড়িমা মাখানো কবির পা। তিনি নিঃশঙ্ক নন শব্দ সন্ধানে।

' তন্দ্রাচ্ছন্ন পা দুটো কি পৌঁছোতে পারবে/ আনকোরা কোনো শব্দের কাছে? কবির পা কেন তন্দ্রাচ্ছন্ন? তিনি ভাবন- জগৎ থেকে বেপাড়ায়! শব্দহীন কোন মানভূমে রয়েছেন? এমত সব প্রশ্ন-চিন্তা ঘোরাফেরা করছে কবি-কে ঘিরে। ' সহজে ভুলে যাওয়া যায় এমন কিছু সাফল্য। / ' সহজে ভুলে যাওয়া যায় এমন কিছু বিফলতা।' এক্কেবারে নিতান্ত মৃল্যহীন স্মরণহীন  কালযাপন কবির। এ'এক অদ্ভুত আঁধার ' কবির কাছে। ভীষণ অসহায় কবির হৃদয়। তিনি বলেন ,' এক আঁজলা অন্ধকার জামার পকেটে লুকিয়ে ফেলতে পারছি না। সেই যে কৃষ্ণগর্ভ, যেখানে ঈশ্বরকণা থাকে, সেখানে কবি ডুবে আছেন-- তবু তিনি অনঘ শব্দ খুঁজে পেলেন না।কোন একটিও ঘনাবৃত অন্ধকার কবির আশ্রয়-দেওয়াল নেই। এ এক অসহনীয় অন্ধকার সময়ে  কবি বসবাস করছেন। শুধু কী কবি! আমরা নই!

' আধ হর্সপাওয়ার-অলা ঘোড়া '


কবির এ নিছক বিরতি। তপোবনে। এমনতর রিলিফ কবিকে কিছুটা হাল্কা করে। তপোবনে কবি পান-- রাবণ সীতা হরণ করে এইখানে লুকিয়ে রেখেছেন-- নেতাজি সুভাষ এখানে আত্মগোপন করে ছিলেন। সবটাই স্মৃতি হাতড়ে। স্বতঃই বোঝা যায়, কবি- হৃদয় নেহাত রোম্যান্টিসিজম চায় না।তার চাই আত্মশুদ্ধি-- বিশ্বচেতনা। কবি নিজের ভাবনার কাছে দ্বিবিধাগ্রস্ত। তিনি বলেন: এ- মুহূর্তে তুই যদি পাশে থাকতিস/ ভালোই হয়েছে তুই পাশে নেই,

কেন না, কবির এই পথ চলার অ-সমতল- সমতল পরিভ্রমণ একান্ত কবিরই।


' স্মৃতারাই সুন্দর ' 

।এবার আমরা কবির সংগে কবিতা পরিক্রমণে কাব্যগ্রন্থটির মলাট- কবিতায় পৌঁছে গেছি। এবার আমরা কবিকে পেলাম নিখাদ রোম্যান্টিসিজম ভূমিতে , যেখানে সবুজ তৃণ সূর্যাস্ত শেষে বিবর্ণ-  তামাটে হলুদ বর্ণ। দন্তরুচি -- এখন রুচিহীন। মুখমণ্ডল মানচিত্র। এমন শ্রীহীন প্রেমকে কবি ফিরে দেখতে চান না। তিনি চাইছেন, তাঁর সজীব সবুজ তারুণ্য মাখা প্রেম স্মৃতিতেই থাক। অদ্ব্যর্থক ভাবে আমরা সুন্দরের অনুরাগী। প্রচার রাখি-- বাইরের সৌন্দর্য নয়, আন্তরসৌন্দর্য প্রধান। সর্বৈব মিথ্যে।বিশেষতঃ যৌবনের মাধ্বী সৌন্দর্য অনিবার্য আকর্ষণ। সে রং ফিকে হয় ঋতুবদলের সাথে। ওই যে কবি বলৈন: যদি সামনে এসে দাঁড়াস কখনো, / তোকে কেমন দেখব, কাকলি?...তার চেয়ে এই  ভালো, দেখতে চাই না তোকে মুখোমুখি, স্মৃতিরাই সুন্দর,...রূপের সোনার স্মৃতি বেঁচে থাক কবির ভাবনায়।


' ডাকবাক্সে না ফেলা চিঠি '


প্রত্যেক কবির না হোক, অন্তত বেশ কিছু কবির একটি সঙ্গোপন নায়িকা-নাম থাকে।একটি অর্থপূর্ণ নামসহ। এ কবির কাল্পনিক কাব্য-নায়িকা ' কাকলি '। পূর্ববর্তী কবিতার রেশ কাটেনি। তিনি ' ডাকবাক্সে না ফেলা চিঠি ' তে " তেপান্তরের মাঠের এই ধারে আমি/ আর ওই প্রান্তে তুই...তুই যদি সামনে এসে দাঁড়াতিস কাকলি/ কেমন দেখতাম তোকে?/ আমির এই ডায়াবেটিক ক্যাটারাক্ট চোখ/ বড়ই ঝাপসা দেখতো তোকে, / তোর সুখ- দুঃখের জাবেদা-খাতা/ ঠিকমতো পড়তে পারত না। একদম ঠিক। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে দূরের প্রেমিক চাইবেই না, তার ফেলে আসা প্রেষ্ঠ্যা তাকে, যৌবনের সব খোয়ানো মানুষটাকে দেখুক। কেই বা চায়, শূন্য ভাঁড়ার দেখতে অথবা দেখাতে! যে যায় চলে, সে আসুক কল্পনা- বাহনে। অস্বীকারের কোন বাহানা চলে না। সেই না ব্যবহারের যৌবন অহং তো থাকবেই। এটাই রসায়ন। ট্যাবুহীন কবি, চমৎকার!


এরই অনুষঙ্গে আমরা চলে আসি ' প্রত্যাখ্যান ' কবিতায়। কবির আপনমনে স্বগোতোক্তি। তিনি দেখেন, খুব যে নিবিষ্ট ভাবে, তা নয়; আপন আলাপচারিতায় একা এবং একা দেখেন। দীর্ঘদেহী বৃক্ষ ঝুঁকে পড়েছে প্রণাম ভঙ্গিতে। ছায়া পড়েছিলো রাস্তায়। অন্ধকারও যেন কবির কাছে নিরেট গ্র্যানিট পাথর এবং যে অঞ্চলে কবি থাকেন, সেখানকার রেল লাইন ধরে অপসৃয়মান ট্রেন। সবটাই প্রায়িক। এইসব প্রত্যহিক কড়চার মধ্যেও কবি  চার বর্ণমালা লুকিয়ে রেখেছেন সযত্নে,' ভালোবাসি '। আহা, কী অফুরান আহ্লাদি মৃদু উচ্চারণ! বিপ্রতীপে কবির জন্য না আখরে প্রত্যাখ্যান। এই বিলাস- বিরহ কবির অনাস্বাদিত স্বাদ।

' ভো- কাট্টা '


দুই অমলিন প্রতীকী বস্তুর উপমা গ্রহণ করেছেন কবি। এক: নীল ঘুড়ি। অন্যটি শিশুর সরল হাসি। কবি কি বোঝাতে চেয়েছেন? কিসের ইংগিত ছিলো ঐ ' ভো-কাট্টা 'য়! 

' সারাদিন ধরে নীল ঘুড়িটা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে,/ ডানা ছাড়াই যে হাসি উড়ে গিয়ে ঘুড়িটাকে ছুঁয়ে দিয়ে/ অমল কৌতুকে বলেছে: ' ভো কাট্টা ' ,  সেই হাসি তো অবাধ স্বাধীনতা চাইবেই অন্তিম উড়ানের জন্য। 

' আরো নীল , গাঢ় নীল অখণ্ড আকাশ,'

কী বললেন কবি! বললেন: ...সেই হাসি ফিরে আসবে/ সবুজ মাটির কাছে, ঠাঁই নেবে আমার শূন্য বুকের ভিতরে,  

সত্যিই কী কবি-রা তৃতীয় নয়নের অধিকারী! আমাদের কবি কী দেখতে পেয়েছিলেন দূর অজানা ভূমির ধূসর সংকেত! 

কবির স্বগতোক্তি: আমাদের কোন দুঃখ নেই, পরিপার্শ্ব জুড়ে/ কোন বিষাদ- বিষণ্ণতা নেই, / আমাদের বুকের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে হাসি- ভরা/ নীল মহাকাশ।'

ভারি অদ্ভুত তো! হায় কবি, বড় অসময়ে  এ-সব বুঝতে হ'লো আপনাকে!


' হাতি ' একটি রসঘন লেখা। হয়তো বা রিলিফ। সামান্য বিরতি যেমন থাকে সব ধ্রুপদি কলায়। এও তেমনি  কবির রসিক খেয়াল এই ' হাতি ' সৃষ্টিতে। 'ফজলিতর' ও তেমনি একটি বিরতি - সুলভ কবিতা।

এবার আমরা চলে আসবো ' ধর্মসম্মত ' তে। একটি রূপক- ধর্মী কবিতা এবং কিছুটা বিদ্রূপাত্মকও বটে। আমরা প্রত্যেকেই গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেতে নিরাপদ বোধ করি। এ এক- প্রকার  ঝক্কিহীন মসৃণ জীবন। ' হ্যাঁ তে ' হ্যাঁ ' মেলানোয় স্বস্তিবোধ করি। আমাদের যূথবদ্ধতা শুধুই তরতরিয়ে চলার খাতিরে। কবির কথায়: বাজি রেখে বলতে পারি ধর্মপরায়ণ

অসংখ্য, অগণ্য মানুষেরা সন্ধ্যের পর/ একত্রিত হবে, 

বোতলের ছিপি খুলবে, গ্লাসে ঠোঁট রেখে দেবে ধর্মসম্মত চুমুক।

এই আমাদের মনুষ্য-চরিত্র। ভিড়ে নিরাপদ হই। একলা হওয়ায় অনিশ্চিয়তা।অপূর্ব!


এবার দেখবো, ' স্বপ্ন ' কবিতায় কবি এক স্বতন্ত্র মনস্ক ব্যক্তি। তিনি জানেন, এ পার্থিব সমাজে, আমরা যারা সাতে বা পাঁচে থাকি না; তারা  অনেক কিছু দেখেও দেখি না। জেগেও ঘুমের ভান করি। শমিত- স্নিগ্ধ কবি তাঁর প্রকৃতি-জাত চিরপরিচিত মৃদু হাস্যে বোঝাতে চাইছেন , আমাদের এই জেগে ঘুমনো চোখে অতি গভীর কালো রঞ্জন। আশাবাদী কবির প্রত্যয়, এই অর্ধ-জাগৃতি চোখে কিছু তো ভাবনা আসবেই। কারণ, সবাক প্রাণ ভাবনা-রহিত কদাচ নয়। কবির অন্তর্গত প্রত্যয় বলে: এইসব মুদিত চোখ অন্যভাবে  বাঁচার কথা বলে। এই আমাদের পুনরুত্থান। অলস প্রাণকে জঙ্গম করতে এমন প্রেম, এমন স্থৈর্য  কবি গৌরাঙ্গ মিত্র'র পক্ষেই সম্ভব।

' নদী '


 এই নদী কবির স্মৃতিপটে নানান ছবির প্যানোরামা। আমরা তো কতই আকছার দেখি, মেঠো পথের দৃশ্য! ক'জনই বা  এমন দৃশ্য-মালিকা গ্রন্থন কৃৎকৌশল জানি! আপাত হেটো কথা, মেঠো কথা; তবুও তো আমাদের ক্যালাইডোস্কোপে সে-সব ছবি ভেসে ওঠে স্মৃতি-জলপ্রবাহে। একদম চেনা ছবি। সেই রবীন্দ্রনাথ-কে একঝলক ফ্ল্যাশব্যাকে, ' ঘাটে বসি মাটি ঢেলা লইয়া কুড়ায়ে/ দিদি মাজিতেছে ঘটি ঘুরায়ে ঘুরায়ে।' নিত্যই তো কত কীই না দেখি, গাঁয়ের পথে যেতে। কিছুটা ঈশপের নীতিকথাও কবির স্মৃতির আলপথে এসে পড়ে। পথ-দাবি-তে দু'টি অজ'র মতো আমরাও গুঁতোই অন্যকে এবং তলিয়ে যাই। ' একদা পথের দাবিতে গুঁতোগুঁতি করে ঈশপের রাখালের দুটি আস্ত ছাগল জলে পড়ে গিয়েছিল এবং অচিরে তলিয়ে গিয়েছিল, ...' রাজার ব্যাটার সঙ্গে এক জলপরি স্রোতের উজান পথে...

এবম্বিধ কত না বর্ণনা! জগদীশ বোসের প্রশ্নকেও কবি তাঁর কবিতায় স্থান দেন: ' নদী , তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?/ নদী ঢোঁক গিলল, ...: তাহা তো বলিতে পারি না, এমন কঠিন প্রশ্নের উত্তর পিতৃদেবেরও জানা নাই...।

নদী তো জল-- জলই তো প্রাণ-- প্রেম এবং সবশেষে ছলনাপ্রিয় নারী। সে এ জল রূপী প্রপঞ্চময়ী কোথা থেকে আসে-- দেবা না জানন্তি: কুত্রাপি মনুষ্যা।


' প্রাতঃভ্রমণ '


কবির নানান উপলব্ধি এ জগৎ নিয়ে। তিনি আকন্ঠ ডুবে থাকেন নিসর্গ-প্রেমে। হরিৎ-রা ' সুপ্রভাত ' জানায় প্রাতর্ভ্রামণিক কবিকে। পতত্রিরা তাদের নগরকীর্তনে। আহা, কী অবাধ সঞ্চরণ স্বাধীন ডানায়। আমরা বুঝি শিশির ভেজা ঘাসের বুকে কিছু সময়ের হাঁটা। অহো বিহান! এমন আদিগন্ত বিস্তার পাখির ডানায়-- অনঘ বিচরণ! কবিকে যে টেনে নিয়ে গেলো কত সহজেই!

' বন্ধু ' কবিতায় ধীর এবং ঋজু, অথচ বন্ধুবৎ কবি আছেন অজাতশত্রু হয়ে। পাঠক খুব সহজেই আকর্ষিত হয়। হয়ে পড়ে এমনতর কাব্যভাষ্যে। "আমার বন্ধুর বন্ধু আমার বন্ধু/ আমার  শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু...প্রকৃতপক্ষে আমার কোন বন্ধু নেই

ভাবুন কাণ্ডখানা--- কী বিশাল দর্শন রাখা আছে এই মনস্তত্ত্ব ভিতরে! বিশ্বটাই কবির ' সখা-সমিতি'। কিন্তু যে আক্ষরিক অর্থ ' বন্ধু ' শব্দটি বহন করে, সেভাবে কবির কোন বন্ধু নেই। বন্ধু হওয়া কী এতটাই সুলভ! মন, সে কেবল নিজেই নিজের বন্ধু। এই নাম-বাচক শব্দটি খুব পাটোয়ারি। ভীষণ গোছানো নিস্পৃহ স্বভাবের। কবির ভিন্ন গোত্রের মনের গতি সেই ইছামতী। ইছামতী , না ইচ্ছামতী? তাই তো! কবির মন তো ইছামতীই। সবাইকে নিজের করেও আপনমনে বয়ে চলা। ঠিক আমাদের কবি গৌরাঙ্গ মিত্র। তিনি দু'হাতে বেড় দিয়ে সবাইকে আপন করেও বয়ে চলেছেন নিরুদ্দেশ যাত্রায় সাঁতার কেটে।


' পুরনো মদ ' কে পাঠক কিভাবে নেবেন? রাজনীতি গন্ধমাখা দ্রাক্ষা বয়াম। অতীত থেকে বর্তমানে সেই তো আগ্রাসী পেশা নানান রূপে একই উদ্দেশ্যে। ওই যে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন,'রাজা আসে যায় রাজা বদলায়/ নীল জামা গায় লাল জামা গায় '। এও তেমন। ' নতুন বোতলে পুরনো মদ--' কবি এও বলছেন-- কেউ কেউ ইংরেজিতে বলতেন: Old wine in a new  bottle./ না হলে উপনিবেশ- উত্তর-শরীরে ঠিকমতো বল পেতেন না।

সংস্কার তো কেবল বহিরঙ্গে-- অন্তরঙ্গে নীলরক্তের মৌরুসীপাট্টা। কবি বলতে চান, এ না হ'লে শরীরে তেমন জোশ আসে না।  এ'  সবের জন্য কবি নিজেকেই দায়ী করছেন। তাঁর ভিতরে এক অস্থিরতা খেলা করে। তিনি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন না তাঁর কাব্য-কথা নিয়ে। বলেন,' আমার কবিতাগুলো নতুনও না, পুরনোও না,...

অর্থাৎ চিরকালীন কবিতা। অবশ্যই। কবি তো মন এবং মনের দর্শন নিয়ে চিন্তাকুল। সেই চিন্তার ফসল আবহমানের কাব্য-কথা হয়ে ঝরে পড়ছে এই কাব্য-গ্রন্থটিতে।' একই জায়গায় স্থির ধ্রুবতারা, শুধু শিরোনাম বদলানো,...

তিনি বলছেন,' পুরনো মদ নতুন ওনারশিপ ফ্লাটে,...

সেই আমাদের লহু- পল নিয়ে 'অসূয়া , মুগ্ধতা, দ্বেষ,পাট- করা পরিচ্ছদ। 

চমৎকার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। বিচারের নিক্তি ওজনে নিরপেক্ষ চুলচরা ঋতভাষণ।বাহ্, কবি, বাহ্।

' রাম- রহিম কথা '


কবি এই কবিতাটি তাঁর আরেক বন্ধু রহিম রাজা-কে উৎসর্গ করেছেন।ইদানিং আমাদের দেশে যে সাম্প্রদায়িক হাওয়া-মোরগের পাখসাট, তারই ইংগিত দিয়েছেন কবি এ কবিতায়। অ-হিন্দুদের প্রতি যে অন্যায়-অবিচার চলছে, সে প্রেক্ষিতেই কবি আক্ষেপ করছেন তাঁর উষ্মাসহ। 

তাই তো! ' রহিম রাজা হতে গিয়ে রাজত্ব হারাল/ সেই সঙ্গে রাজকন্যাও...

ভাবুন, নিশ্চয়ই প্যানোরামা হয়ে চলে আসছে আমাদের ভারতের রাজনৈতিক পটচিত্র।  অপূর্ব স্যাটায়ার-- চোদ্দো বছরের বনবাসের ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট/ পলিব্যাগে পুরে ফেলে দিতে পারত/ ইএম বাইপাসের ধারে, ...

"গুপীযন্ত্র"- বীরভূম থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকা-এর সম্পাদক রহিম রাজা।কিন্তু এখানে কে এই রহিম! কবির কবি-বন্ধু রহিম রাজা, নাকি, তিনি নিজেই! ওই যে বলছেন, সব খুইয়ে ' হাতে রইল গুপিযন্ত্র আর/ কবিতা- ভরতি এক অখণ্ড আকাশ।'

ভাবা যায় না। হাতে কি রইলো? না, বাউলের গুবগুবি। কী থাকে আর বাউলের! ঐ একটি একতারা। ভাবুন, একটি তারে বাঁধা গুপিযন্ত্র। আহা, কী গোপন যন্ত্রটি  কবির হাতে!   আছে কবিতা ভরা এক সম্পূর্ণ আকাশ। ইনিই তো প্রকৃত বাউল কবি। বাউল না হ'লে কবি হওয়া যায় না-- কবিরাই বাউল হন।


 ' সার্থকতা '


কবির অষ্টাচত্বারিংশৎ পদবিক্ষেপে পরিক্রমণ সমাপ্ত।এই নাতিদীর্ঘ স্মৃতিকথন-এ আমরা -পাঠকগণও কবি-সঙ্গ করেছি। শুনেছি তাঁর পলকাটা স্মৃতিকথন। আমাদেরও পরিক্রমণ শেষ। 

তিনি বললেন,' তোমার সার্থকতা এই---/ তুমি জন্মেছ নানা রঙে আঁকা পৃথিবীতে...পঞ্চভূতের রসায়নে গাছ হয়ে বেড়ে উঠেছো,/ একদিন পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে।...সার্থকতা ও বিফলতার মাঝে কোনো গগনচুম্বী পাঁচিল নেই, / রহস্যময় কোনো নো-ম্যান'স ল্যান্ড নেই।

কবি শেষ করলেন এই কথাটি ব'লে--' তবু ব্যক্তিগত ডায়রিতে বিফলতার গল্প লিখো না।'

চোখ কী ভিজে আসছে না, কবিতা-পাঠকের! পাঠক একাধারে যেমন অভিভূত, অন্যদিকে বুকের বাঁ পাশে ব্যথার চিনচিনে যন্ত্রণা। কী গদ্য-শ্লোকই না তিনি প্রয়োগ করলেন! ফিরে দেখি সেই পংক্তিগুচ্ছ: তোমার সার্থকতা এই-- তুমি জন্মেছ নানা রঙে আঁকা পৃথিবীতে...তবু ব্যক্তিগত ডায়রিতে বিফলতার গল্প লিখো না।

কবি নিজেকে সার্থক মনে করেন নানান রংয়ের পৃথিবীতে জন্মেছেন ব'লে। কবির ভিতরের বিফলতার ক্রন্দন নিজের বুকপকেটে রেখেছেন। 

আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কবিকে হারিয়ে। আমাদের যন্ত্রণা তাঁকে হারাবার ,আর , এ কবিকে ফিরে না পাওয়ার কষ্ট; যিনি এতটাই মরমী, এতটাই স্পর্শকাতর। তিনি কী আঘাত পাননি? পেয়েছেন তো! সেসব মনে না রেখে, ভুলে গিয়ে বর্ণিল এ জগৎকে উপভোগ করেছেন সমস্ত সত্তা দিয়ে। প্রাণ স্পন্দন অনুভব করেছেন প্রাণায়াম ভঙ্গিতে। তিনি যে ঔপনিষদিক-ভাবনা-জারিত কবি! প্রণাম কবি - অ-শেষ প্রণাম। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন