স্ফুলিঙ্গ

সমীরণ কুণ্ডু

অর্থাৎ ক্রমনির্দেশে নেপথ্যচারণ খানিক সরিয়াছে। বিশেষ বিশেষ্য পদে মস্তক নত করিয়া ভাবিতেছি। মনুষ্য বর্ণের সমাপ্তি হইলে ফিরিয়া আসার প্রমাণ নাই। ভস্মের ন্যায় আঁধার ; ঋণ সমীপেষু লক্ষ্য-অলক্ষ্য চিহ্নহীন অবয়বে ধরাশায়ী। তাঁহারই কর্মছাপ মর্মস্পর্শী ; যতটুকু বহিয়া বেড়ায় --- নগর কীর্ত্তনে সাময়িক স্মৃতি কুয়াশা জড়াইয়া অদৃশ্য পথে স্বজনেরে বিদ্ধ করে। উহা সম্প্রতি নিবিড় সম্বন্ধযুক্ত অধিকাংশই কবি গৌরাঙ্গ মিত্র-য়ের অধীনে বিচরণ করিতো। ক্রীড়ার জন্মলগ্ন বনাম মৃত্যু --- অনিবার্যসূচক জানিয়াও বর্ণমালা শুধু কবিরই প্রাপ্য --- মূল্যবান জাতক --- কালসর্বস্ব।   

পরিচয়ের সন্ধিক্ষণ সন্ধ্যাকালীন কোনো কবিঘরে। স্মৃতি বলিতেছে --- কবি পঙ্কজ মণ্ডলের ছিলো। গৌরাঙ্গ --- সৌম্য ও দীর্ঘদেহী। কণ্ঠ মার্জিত, ধীর এবং শান্ত। কবিতা পাঠে মগ্ন ওই প্রতিভূকে সজ্জন ভাবা স্বাভাবিক। ভিন্ন সময়ে পরবর্তীতে বহুবার নিকট হইতে দেখিয়াছি। আতিথেয়তায় মুগ্ধ না হইয়া কেহ থাকিতে পারিবেন না। নিরীহ স্বভাবের এমন ভদ্র মানুষ নাগরিক জীবনে বিরল।  


কবি গৌরাঙ্গ মিত্রকে লইয়া আমার যাত্রাপথ দীর্ঘদিনের। ফলত পূর্বালাপ সম্বন্ধীয় বিষয়ান্তর ও কাব্যচর্চা বহুচর্চিত। চারিত্রিক গুণাবলীর মধ্যে নিরহংকারী মানবটি প্রচার বিমুখ তো বটেই ; আপন কর্মে একনিষ্ঠ। মুহূর্তের ভগ্নাংশগুলি কোমল ; বড়ো বেশী আকর্ষণীয়। একাত্ম ভঙ্গিমাটি নির্মল শুদ্ধাচারী বলিয়া সতত প্রণম্য। নাদ্য সঞ্চারণ অনায়াসে মোহনামুখী। তিনি পাঠক ; তুলিয়া লইতেন জ্ঞান। উঁহারে শ্রদ্ধা দেখাইয়া হৃদয় তৃপ্ত হয়। বাক্যবিনিময়ে মেধাব্যাপ্তি ঘটে। কখনও ক্রোধ দেখি নাই, বিরূপ মন্তব্য শুনি নাই, বিরক্তির প্রশ্নই উঠিবে না --- মহান পুরুষ, সম্ভ্রম করিবার মতো প্রিয় দ্রুতই আত্মজন হইয়া উঠিয়াছিলেন আমার এবং আমার মতো নতুন প্রজন্মের। প্রত্যেকেরে সহজেই আপন করিয়া লইবার সহজাত ক্ষমতা ছিলো কবির।  


একটি জাগ্রত ছায়ার উপবেশন লক্ষ্য করিবার মতো। জলযানটি ' কবিতা পাক্ষিক'। দুইজন নাবিক শীর্ষস্থানে বসিয়া গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করিতেছিলেন। মধ্যমণি কবি প্রভাত চৌধুরী উত্তল অংশে হৃৎযন্ত্রের সামিল। বর্তমানে নাসের হোসেন ও গৌরাঙ্গ মিত্র-য়ের অভাবে প্রচণ্ড শূন্যতার সৃষ্টি হইলো। বিকল্পের অস্তিত্ব মানিয়া লইলে যন্ত্রটি যেহেতু স্পন্দন জারি রাখিয়াছে জলযান চলিবে নতুন প্রজন্মের হাল ধারণে। বলিবার মতো যাহা --- কবি গৌরাঙ্গ মিত্র ও কবি নাসের হোসেনের প্রয়াণ বিশ্বস্ত সৈনিকদ্বয়ের চলিয়া যাওয়াকে মানিয়া লওয়া কঠিন। বোধকরি অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের স্রোত ব্যাখ্যা করাও জটিল। আমি ভাগ্যবান এই উজ্জ্বল ত্রয়ীর স্পর্শ পাইয়াছি --- কবিতা না লিখিলে সম্ভব হইতো না। 


প্রশ্ন উঠিতে পারে কবি হিসাবে গৌরাঙ্গ মিত্র কতোখানি প্রাসঙ্গিক। এমতাবস্থায় কবিকে লইয়া সুদূরপ্রসারী আলোচনা চলিতে পারে। অন্যত্র অবশ্যই তাহা উচ্চারিত হইবে। এক্ষণে কিঞ্চিৎ নমুনা প্রকাশে গৌরাঙ্গ মিত্র রাখিয়া গিয়াছেন অজস্র চিত্ররূপ ও বিবেক ধ্বনি। উহার বহুবিধ উপস্থাপনা, নান্দনিক বিষয় ব্যবহার, নাগরিক জীবনবোধ, আয়োজিত সব বিচিত্র কল্পঢঙ, স্বর ও সুরের বাঁধন --- কবিতার নিরিখে যা স্বতন্ত্র। গদ্য সঞ্চারণে --- ভ্রমণকাহিনী সমেত অন্যান্য রেখাগুলি প্রাঞ্জল ও সুচারু শব্দ বিন্যাসে কুশলী। মৌখিক কথ্যভাব লেখনীতেও জোরালো ভাসিয়া ওঠে। অমায়িক সেই আবেদন কবিকে পুনর্পাঠে আগ্রহ জাগায়। এ হেন কবির মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি করিলো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁহার ক্রমাগত নিরীক্ষণ পরবর্তী প্রজন্মের নিকট আদর্শরূপে বিবেচিত হইবে।    


কবি ' উড়ন্ত ঋষ্যমেঘ ', আত্ম বিশ্লেষণকারী --- কথা চালান করেন জ্ঞানে ও অবচেতনে। প্রচুর কবিতা লিখিয়াছেন। স্বতন্ত্র ভাষ্য ' নো ম্যানস্ ল্যান্ড '-য়ে আছড়াইয়া পড়িয়াছে। সেইখানে দৃষ্টি ও ভাবনার জগতে বিষয়ান্তর দেখিতে পাই মুহুর্মুহু। মেধাদৃপ্ত বাকপটুতায় স্বকীয় উজ্জ্বল বর্ণনার ছবি প্রচার বিমুখ, অাত্মমগ্ন। আমি পাঠকালীন একান্তে আকৃষ্ট হই কবির প্রতি। গৌরাঙ্গ মিত্র-য়ের কাব্য দর্শন ও নির্মাণ আমার ভালো লাগে।  


ব্যক্তি গৌরাঙ্গ মিত্র কালপুরুষসম। স্মৃতির কুটীরে চিরন্তন যাওয়া আাসা চলিতে থাকিবে। কিছুদিন হইলো প্রয়াত হইয়াছেন। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁহার সহিত নিভৃতে বরং সময় অতিবাহিত করি? প্রণম্য কবির স্পর্শে সুশিক্ষায় বর্ধ্বিত হইয়াছি ইহা সৌভাগ্যের। তিনি শিক্ষক রূপে বাঁচিয়া থাকিবেন। কালের প্রবাহে সকলের বিদায় স্থির। যাত্রাপথে উঁহার সান্নিধ্য পরম প্রাপ্তির বিষয় হইয়া রহিলো। কবির অমরত্ব ও জীবনের সার্থকতা বলিতে সরল সত্যটুকু হৃদয়ের অস্থিরতা দমন করে। আদর্শবান এই কবিকে অনুসরণ করিয়া চলিলেই প্রকৃত সম্মান প্রদান করা হইবে বলিয়া আমার ধারণা। সর্বশেষে যাহা না বলিলে আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থাকিতো --- কবি গৌরাঙ্গ মিত্রকে আমি বহুদিন ধরিয়া চিনিলেও সখ্য শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব হইয়াছিলো কবি বিভাবসুর সহযোগিতায়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন