কবি গৌরাঙ্গ মিত্র স্মরণে:

আফজল আলি 

খবরটা শুনে অব্দি মনটা খুব অস্থির। কবি গৌরাঙ্গ মিত্র আর নেই । কবিতা পাক্ষিকের সম্পাদক মন্ডলীর অন্যতম সদস্য কবি গৌরাঙ্গ মিত্র। নয়ের দশকের কবি , সেই প্রথম থেকেই উত্তর আধুনিক ঘরানার সাথে যুক্ত। কবিতা পাক্ষিক সূত্রেই গৌরাঙ্গ মিত্রর সাথে আমার পরিচয়। কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা হাতে এলেই দেখতাম বিভিন্ন সংখ্যায় গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ হয়েছে কবি গৌরাঙ্গ মিত্রর এবং পাশাপাশি আমার লেখাও । তখন থেকেই mark করতাম তরুণটিকে। পরবর্তীতে কবিতা পাক্ষিক এর অনুষ্ঠানে সামনাসামনি দেখা। সৌম্য দর্শন এক যুবক, ফর্সা , অতি বিনয়ী ব্যবহার। দেখলাম আমার সাথে ক্রমশ মনের মিল হতে লাগল। দুজনে পাশাপাশি কবিতা , সেই দেখে গৌরাঙ্গ মিত্রর ও বেশ কৌতূহল ছিল যে কে এই আফজল আলি। যাই হোক পরস্পর পরস্পরকে দেখা হল । দেখা থেকে ক্রমেই ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব।

সেই যে বন্ধুত্ব শুরু তা ছিল জীবনভর। যে কোনো পরিস্থিতিতে আমাদের বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি , হয়তো যোগাযোগ কমেছে কখনো কখনো। কবি গৌরাঙ্গ মিত্র এবং আমি একই সঙ্গে কবিতা পাক্ষিক সম্মান পেয়েছি , একইসঙ্গে কবিতা পাক্ষিক সম্পাদক মন্ডলীতে এসেছি এবং একইসঙ্গে সমিধ সাহিত্য সম্মান পেয়েছি। ফলে পারস্পরিক এই যে coincidents এটাও বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়ার একটা দিক। সেই 1999 থেকে কবিতার মাধ্যমে জানা বা তার ও আগে । আমাদের মধ্যে পরস্পর পরস্পরকে তুই বলার সম্পর্ক ছিল। যদিও কবি গৌরাঙ্গ মিত্র আমার থেকে বয়সে বেশ সিনিয়র ছিল , তবু । তখন আমরা প্রভাতদার নেতৃত্বে post modernism এর mid fielder. সে কী উন্মাদনা। নানান আঙ্গিকে কবিতা লিখতে হবে , শব্দকে নানান ভাবে ব্যবহার করতে হবে, সাহস দেখাতে হবে লেখাতে -- এই সব মাথায় ঘুরত। প্রভাতদার সাহচর্য ই এই ভাবে সাহসী হতে এগিয়ে দিয়ে ছিল আমাদের। একদিন কবিতা পাক্ষিক এ ' জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ : বিজ্ঞাপন ' বলে একটি কবিতা পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। কী সাহসী লেখা। সেই 2000 সালেও যে ওরকম ভাবা যেতে পারে তা ছিল অনেকের কাছে কল্পনার বাইরে। কিন্তু কবি গৌরাঙ্গ মিত্র ভেবেছিল । অবশ্যই প্রভাতদার support তো বটেই । কবিতা পাক্ষিকের সম্পাদক মন্ডলীতে দুজনে একসঙ্গে আসার পর সে কী আনন্দ ছিল । লেখা সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত দুঃখ আনন্দ ফোনে শেয়ার করতই আমার সঙ্গে। একদিন ফোনে বলল , এরপর আমরা পরস্পরকে তুই বলব। সেই থেকে চলছে তুই সম্মোধন। সবসময় বলত , আফজল , তুই আমার best friend. ফোনে চলত ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা, নানান বিষয়ে। 


কবি গৌরাঙ্গ মিত্র লেখনীর নানান দিকে যেতে পারত। এ যাবত প্রায় পনেরোটি কাব্যগ্রন্থ , একটি কবিতা সমগ্র , একটি ছোট গল্প সমগ্র ( ভদ্রলোকের গল্প ) , ভ্রমণের উপর প্রায় চারটি বই , এবং রবীন্দ্রনাথের বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে ধারাবাহিক গদ্য লিখেছে কবিতা পাক্ষিকে যা আদপে একটি গল্পের মতো । এছাড়া নাসের হোসেনের সাথে যুগ্মভাবে ছড়ার বই , ইষ্টিকুটুম বেড়ালছানা। সব সময় খুব positive ভাবনায় থাকতে অভ্যস্ত ছিল কবি এবং প্রাণ চঞ্চল । ভদ্রলোকের গল্পের যে সংকলন তাতে একশোটির মতো ছোট ছোট গল্প আছে । জীবনের প্রত্যেক দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যে গল্প লেখা যায় এবং খুব কম কথায় তা দেখাতে পেরেছে কবি গৌরাঙ্গ মিত্র। কবিতার ক্ষেত্রেও তার ভাষা ছিল অত্যন্ত smart এবং ঝরঝরে। নানান তথ্য সমৃদ্ধ কবিতা হল কবি গৌরাঙ্গ মিত্রর। যেকোনো কবিতা পড়লে যেমন নতুন কিছু তথ্য পাওয়া যাবে , সেই সঙ্গে পাওয়া যাবে নতুন কিছু মেসেজ বা বার্তা যা আমাদের প্রজ্ঞা এবং মননে সঞ্চারিত হয় । Satire ধর্মী কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কবিতাকে নিয়ে যেতে থাকে , কোথায় সামান্যতম মেদ বা অতিকথন থাকে না ওর লেখায় । খুব তীক্ষ্ম এবং স্পষ্টভাবে বক্তব্য পেশ করতে থাকে কবিতায় । গৌরাঙ্গর যেকোনো একটা কবিতা পড়লেই বোঝা যায় যে তার signature বহন করে চলেছে। সাধারণ বিষয়কে দারুণ ফুটিয়ে তুলতে পারত সে , তার কবিতার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো পাওয়া তা হল প্রাণ। ঝরঝরে smart শব্দের মধ্যেও প্রাণ থাকত দারুণ , এটা কিছুতেই অস্বীকার করার নয়। হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনা ছিল গৌরাঙ্গর , এবং সেই হোমিওপ্যাথি সংক্রান্ত অনেক টার্ম নিয়ে কবিতা লিখেছে । শুধু হোমিওপ্যাথি কেন , যে কোনো বিষয়ের terminology দিয়েই কবিতা লেখা আছে তার । এ বিষয়ে সম্ভবত একটা কাব্যগ্রন্থ ও আছে । কবিতা পাক্ষিকে প্রকাশ হয়েছিল কোনো এক পুজো সংখ্যায়। যেহেতু গৌরাঙ্গ ছিল উত্তর আধুনিকতার mid fielder , তাই ওর কবিতায় multi-dimensionality , হেঁয়ালি যে থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কবিতার মধ্যে জটিলতা থাকে না একদম। বয়সের উপলব্ধির সাথে সাথে কবিতার ঘনত্ব বেড়েছে , তৈরি হয়েছে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় গমন। ভ্রমণ সাহিত্য তথা ভ্রমণকারীদের সহযোগি সাহিত্য লেখার জন্য তাকে দেখেছি নানান জায়গায় গিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে । সে রাজস্থান থেকে আরম্ভ করে কাশ্মীর , কন্যাকুমারী সব জায়গায়। 

ওর একটা কবিতা। কবিতার নাম ' দোষ '


" যে বিপন্ন তাকেই দোষ দাও,

যে ক্ষত বিক্ষত তাকেই আহত করো ,

যে লজ্জায় মরে যাচ্ছে তাকে ই লজ্জা দাও

যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তাকে হকচকিয়ে দাও --

জানি এইসব কাজে তুমি পটু ,

তোমার জ্ঞানের ক্ষেত্রফল-পরিসীমা 

আমার জানা হয়ে গেছে ,

তোমার সিলেবাসের মতো মুখের ছবি

ডিজিটাল ক্যামেরায় ধরা আছে । " 


আমি আগেই বলেছি গৌরাঙ্গর কবিতা অত্যন্ত satire ধর্মী। স্বচ্ছ , ঝরঝরে। এবং সমাজের ক্ষেত্রে , মানুষের জন্য একটা বার্তা । উপরের কবিতাটা পড়লে মনে হয় গৌরাঙ্গর অনেক কবিতা পড়া হয়ে গেল । শব্দগত , ভাবগত বা ভাষাগত জটিলতা নেই একদম । এটাই ওর বৈশিষ্ট্য। 


খুব বিনয়ী স্বভাবের কবি কখনো কাউকে আঘাত দিয়েছেন বলে মনে হয়নি। রেলে চাকরি করত , কিন্তু পরে পরে শরীর নিয়ে সমস্যাটা বেড়েই যাচ্ছিল। হাই সুগারের জন্য চোখের দৃষ্টি কমে গিয়েছিল , সেই সঙ্গে শরীর ভাঙছিল দ্রুত। গত শীতেও বেশ খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিল , নার্সিং হোমে ভর্তি। তারপর তো অনেকবার কথা হয়েছে। কিন্তু কখনো বোঝা যায়নি এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে। কবিতা পাক্ষিকের যে কোনো অনুষ্ঠানে বা আড্ডায় বা কখনো পটলডাঙা , যেখানেই দেখা হোক না কেন , আলাদা একান্ত কথা কিছুক্ষণ হবেই । ব্যক্তিগত খোঁজ খবর নেওয়া থেকে লেখালেখির খবর । 


তখন post modernism নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন point এ কবিতা পাক্ষিক এর আলোচনা সভা আয়োজন করা হতো । প্রতিটা সভাতেই হাজির থাকত প্রভাতদার একান্ত অনুগামী তথা সম্পাদক মন্ডলীর অন্যতম সদস্য কবি গৌরাঙ্গ মিত্র। আমাদের প্রথম আলাপ সেই রকমই এক অনুষ্ঠানে যা বর্ধমানে হয়েছিল। সেই থেকে আমৃত্যু ছিল বন্ধুত্ব। আসলে এমন বিনয়ী স্বভাবের ভালো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হওয়াটাও একটা আলাদা মাত্রা। আর এ সবের মূল কারিগর তো ছিলেন প্রভাত চৌধুরী। প্রভাতদার জন্য ই পেয়েছিলাম গৌরাঙ্গর মতো একজন ভালো মানুষকে। এরকম আরো অনেকের সাথেই ছিল ঘনিষ্ঠতা । কিন্তু গৌরাঙ্গ মিত্রর মতো কাছের বন্ধু কি ছিল কেউ। 


নাসেরদার চলে যাওয়ার পর , গৌরাঙ্গর যাওয়াটা বড়ো একটা ধাক্কা কবিতা পাক্ষিক তথা সামগ্রিক কবিতা জগতে। তবে কবির তো মৃত্যু হয় না। কবি বেঁচে থাকেন আমাদের অন্তরে, তাঁর লেখনীতে। কবি গৌরাঙ্গ মিত্র ও বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। ওঁর সহধর্মিণী রীতাকে জানাই সমবেদনা, ঈশ্বর ওকে সামলে ওঠার ক্ষমতা দিন । 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন