সকালের আলোর মতো পরিশুদ্ধ
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
তাঁর মুখোমুখি কোনোদিনও হই নি। তাঁর সঙ্গে কথা বলার নামমাত্র অভিজ্ঞতাও আমার নেই। তিনি আমাকে চিনতেন কিনা জানি না। তবে আমি তাঁকে কবি হিসাবে ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর কবিতা নিয়মিত পড়তাম। বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু কথা হয় নি। আমি শুধু দূর থেকে তাঁকে দেখেছি। তাঁর অসাধারণ কবিতা পাঠ শুনেছি। আমি যখনই তাঁকে দেখেছি তখনই আমার মনে হতো উনি যেন একটা মগ্নতার মধ্যে আছেন। তাই তাঁকে আর বিরক্ত করতে চাই নি। সেই কারণে কথা বলাও হয় নি।
একটা মানুষকে দেখলে হৃদয় কতটা প্রশান্তিতে ভরে উঠতে পারে তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিলেন আমার জীবনে। অনেক সময়ই তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছে তিনি যেন আমাদের এই পৃথিবীর অনুপযুক্ত একজন মানুষ। তাঁর জন্য আরও একটা উন্নত পৃথিবীর প্রয়োজন ছিল। হ্যাঁ, আমি কবি গৌরাঙ্গ মিত্রের কথা বলছি। যাঁকে দেখে আমার সাক্ষাৎ কবিতা বলে মনে হতো।
গৌরাঙ্গ মিত্রের কবিতা আমার কাছে যেন এক দর্শন। পৃথিবীর মানুষকে তিনি এত কাছ থেকে দেখেছেন যার ফলে তার কবিতার মধ্যে ধরা পড়েছে এক পর্যবেক্ষণ, যেখান থেকে আমরা পেয়ে যেতে পারি তাঁর পৃথিবী পরিভ্রমণের এক অমোঘ দিনলিপি।
অন্যের কথা শোনার জন্যে নিজের কথা বলার লোভকে সংবরণ করতে হয়। তাছাড়া অন্যে কথা বলার সময় নিজে কথা বললে কিছু শুনতেও পাওয়া যায় না। শুধু কি এইটুকুই ? পর্যবেক্ষণ তখনই সঠিক হয় যখন পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তিটি নিজে আগে থেকেই অন্যের দোষ ধরে বসে নেই। তাহলে তার পর্যবেক্ষণটি হয়ে যায় একপেশে। সেদিক থেকে পর্যবেক্ষণের জন্যে গৌরাঙ্গ মিত্র একজন আদর্শ ব্যক্তি -----
"জীবন মানে বহুবচন গন্ধ -ভরা প্রবল প্রত্যয় ।
টানটান দাঁড়াও , দশ মাইল দূরের দেওদারের
চোখে চোখ রাখো , গাছ থেকে হাত নেড়ে
একদল পরি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে ..."
আবার কখনও বলছেন -----
"নদীতীরে এক টিলার উপরে উঠে বলো :
জলের আরেক নাম জীবন , আঃ জীবন
নদী আনন্দ পাবে , হড়কা বান তুলে দু -পারে
বিছিয়ে দেবে জলজ ভালোবাসা ..."
কবি আমাদের হাত ধরে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যান যেখান থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায়। এতদিন পর্যন্ত যা সত্যি বলে জেনে এসেছি তা যেন মুহূর্তে বদলে যায় ------
"মৃত্যু বিলাপ করে না কখনো ।
কিছু মানুষ ভুল কান্না কাঁদে ,
মাছেরা ছটফট করে জলজ বিষাদে ,
গাছের পাতা সারারাত ভেজে করুণ কুয়াশায় ----
গাছের পাতারা আসলে সবুজ বিষাদ । "
গৌরাঙ্গ মিত্রের কবিতা মানে এমন এক কাব্য পরিক্রমা যে পরিক্রমার শেষে আমরা অনেক বেশি মানবিক হয়ে উঠি। পথ চলতে গেলে এমন কিছু ভুল সিদ্ধান্ত যেখান থেকে আমাদের অন্য পথে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। গৌরাঙ্গের কবিতা আমাদের হাত ধরে সঠিক পথে এসে দাঁড় করিয়ে দেয় ------
"গন্ধহীন বলে পৃথিবীটাকে খারিজ করার আগে
শিউলি গাছের কাছে যাও ,
ঝুটা সব উচ্চারণ থেকে
কানদুটো বাঁচাবার আগে বুঝে নাও
আসন্ন স্বর্গ পুড়িয়ে ফেলবে না তো
বাতাসের অক্সিজেন । "
গৌরাঙ্গ মিত্রের কবিতার মধ্যে আলো লুকিয়ে থাকে। সচেতন পাঠক চলতে চলতে সেই আলোর সন্ধান পেয়ে যান। কখনও সে আলো সরাসরি, আবার কখনও সে আলো প্রচ্ছন্ন হয়ে কবিতার গভীরে নিমজ্জিত থাকে ; যে আলোর স্পর্শে আমরা সকালের মতো পরিশুদ্ধ হয়ে উঠি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন