কুশলসংবাদ': আত্মনির্ভর অভিজ্ঞতার ব্যাকরণ

সংযুক্তা পাল


সরস্বতীর তীর ছেড়ে একদিন গাঙ্গেয় তীরে পাঠ, অধ্যয়ন শুরু হল ঋষিদের শীর্ণ হতে হতে অবশেষে লুপ্তপ্রায় যে নদী; অস্তিত্ব শূন্য হবার পরও– আজও মানুষ প্রয়াগে যায় সরস্বতীর কুশল সংবাদ জানতে। গঙ্গা-যমুনার পাশাপাশি সরস্বতী কতখানি বৈদিক আর কতটা কল্পিত অর্থাৎ সরাসরি বললে আদৌ আছে কি নেই–এই রকম অজস্র থাকা এবং না থাকার দ্বান্দ্বিকতাতেই জন্ম নেয় পোস্টমর্ডানিটির থিয়োরি।

উত্তর আধুনিক মননের স্বায়ত্তশাসিত সুপার কনসাসনেস বা অতিসক্রিয়তার স্তর থেকে উদ্গত ভেষজ তরল যা বৌদ্ধিক পুষ্টি জুগিয়ে থাকে তেমনই কিছু 'আত্মনির্ভর' কুশল সংবাদ এর দেখা পাব আমরা প্রভাত চৌধুরীর 'কুশলসংবাদ' কাব্যগ্রন্থে।

বিপ্রতীপতা অথচ সেই বৈপরীত্যেরই সহাবস্থান—ক্রমাগত ঘটে চলা পরষ্পরবিরোধিতাও আসলে উত্তর আধুনিক সমাজেরই বৈশিষ্ট্য।এক নিরাকার স্থিতিশীলতাকে ভেঙে কবিতার ব্যাপ্তিও ছড়িয়ে পড়ে কেন্দ্রচ্যুত বহুরৈখিক ভাবনার দিকে। আমাদের ভিতরে প্রতিনিয়ত প্রতিপালিত আনন্দ-বিষাদ, আসক্তি ও বৈরাগ্যের মতই 'সাদাবক' এবং 'কালোকাকেদের' বিপ্রতীপ সহাবস্থানকে কবি তুলে ধরেন প্রাকৃতিক 'কুশলসংবাদ' এর নিরিখে।


'সাদাবক এবং কালোকাকেদের সহাবস্থানকে/ শান্তিপূর্ণ বলা যেতেই পারে' (১.)

কবি প্রভাত চৌধুরীর কবিতার  অন্তরে শব্দেরা শূন্যবাদী; কবিতায় দীর্ঘ স্পেস রাখা হয় যাতে পাঠকেরা সর্বভুকের মত সবটা গোগ্রাসে না গিলে খাদ্যরসিকের ন্যায় শব্দের আপাত বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেকার শৃঙ্খলাকে স্বতন্ত্র সত্তায় ও মহিমায় আবিস্কার এবং আস্বাদ করতে পারে।কবির নিজের কথাতেই 

         'একরৈখিকতা থেকে কি বহুরৈখিকতায় সরে আসবো না। আমাদের পোশাক পাল্টে যাবে,ফুডহ্যাবিট বদলে যাবে, সম্পূর্ণ যাপনক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটে যাবে।আর কবিতা পড়ে থাকবে আধুনিকতায়,তার হতে পারে না।'('বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু লৌকিক কথাবার্তা'/'নানারকম')


তাঁর কবিতায় অক্ষর স্থান বদল করে কম বরং বিন্যাসের  স্তরগুলো জমাট বেঁধে এক উন্নত বোধের পাললিক শিলায় রূপান্তরিত হয় যার রস বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় খুঁজে নিতে হয়। কাব্যগ্রন্থের ২য় 'কুশলসংবাদ' টি তাই 'সরাসরি সম্প্রচারিত' হয় 'অ্যানিমেল প্ল্যানেট চ্যানেলটি থেকে' সেখানে 'ক্রোকোডাইল' এবং তার 'ডিম' আমাদের শ্বাপদ চেতনাকে উস্কে দেয়।


'একটি ক্রোকোডাইল ডাঙায় এসে তার/ডিমগুলিকে লুকিয়ে রেখেছিল/বালিমাটির ভেতর/ডিম ফোটার পর লক্ষ করা গেল /ডিমগুলি থেকে কোনো কুমিরছানা নয়/বের হয়েছে/অনেকগুলি পুরাঘটিত বর্তমান' 


(২.)

'বালিমাটির ভেতর' থেকে অজস্র সম্ভাবনার পরিবর্তে আদিম প্রবৃত্তির ক্ষয়ীভূত অংশ ছলকে ওঠে; 'অনেকগুলি পুরাঘটিত বর্তমান' জুড়ে টের পাওয়া যায় তার নিঃশব্দ শিহরণ। পুরাতত্ত্বে জারিত বর্তমান-কেও গঠন করেন কবি অক্ষর বিন্যাসের দক্ষতায়–কারুকার্যে কারণ তিনি নিজে বিশ্বাস করেন

         ' নক্ষত্রপতন এবং ফুল-ফোটার শব্দও কবিতা হয়ে উঠতে পারে, তবে সেই শব্দকে রূপান্তরিত করতে হবে অক্ষর বিন্যাসে।'('কবিতা সম্পর্কিত একটি ছোট গদ্য'/'নানারকম')

 বস্তুত একজন যথার্থ উত্তর-আধুনিক কবির কবিতাকে টেনে নিয়ে যাবার কোনো দায় থাকে না, বরং এমন একটি জায়গায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় যেখানে কবি নিরাসক্ত-এর ভূমিকা পালন করেন; পাঠক তার স্বাধীনতায়, স্ব-মেধা ও বুদ্ধির অবস্থান অনুযায়ী চর্চা কিংবা অনুশীলনের দ্বারা কবিতার ইনার মিনিং এ পৌঁছোন। তদুপরি কবিতা যদি হয় 'কুশলসংবাদ' যে সংবাদ জীবনের আয়-ব্যায় এর সমতা রক্ষার্থে কখনো বা 'কৌশল' হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে বৈ কি! কবি জানিয়েছেন–


'কুশল' এই বিশেষ্যটি থেকে/'কৌশল' বিশেষ্যটির দূরত্ব মাত্র দুটি চান্দ্রমাস/একথা জানিয়েছিল এক ঘুম-পরি/ঘুমপরি আরো জানিয়েছিল/প্রতিটি কুশলসংবাদের ভিতর /একটি করে কৌশল আত্মগোপন করে থাকে'(৩) 


সাপের খোলস ত্যাগের মতই 'কুশল' এর আদান-প্রদানও নিজস্ব কৌশল হয়ে উঠতে পারে প্রতিদিনের চড়াই-উতরাইয়ে , 'তাদের প্রত্যেকের একটি করে নিজস্ব খোলস থাকে', কঠিন বরফে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর হৃদয়ে আরক্ত জীবন ধ্বনিত হয়ে উঠতে পারে অকস্মাৎ এবং সে হওয়া উপলব্ধি করতে সক্ষম কবিরাই কেননা 'কবি যতটা দ্যাখা শোনা এবং জানা বিষয় লেখেন, তার থেকে অনেক বেশি লেখেন না-দ্যাখা  না-শোনা এবং না-জানা বিষয়  নিয়ে।'(ঐ)

পোস্টমডার্ন কবিতা অ্যান্টি-হিউম্যানিস্ট, ব্যক্তির ঈশ্বর হয়ে ওঠার পরিপন্থী; বৈদিক আনুষ্ঠানিকতার ছন্দপতন ঘটে যে নক্ষত্রলোকে সেখান থেকেই আসে পৃথিবীর বিবর্তনের গল্প, মানুষের দৈনন্দিন যাপন কোনো ঋষি-দর্শন কে আত্মস্থ করে নয়,

' তিতির ডাকলেই যে গৃহস্থের খোকা হবে/এমন নির্দেশও তিত্তিরীয় ঋষি বলে যাননি।'(৪.)


লৌকিক উচ্চারণ 'কুশলসংবাদ' হয়ে উঠলে 

ধাতুর ক্ষমতাও কেন্দ্রীভূত হবে।আচার-উপাচার এর নিগড়ে ভাবনার অস্তিত্ব যে শূন্যতাকে কেন্দ্র করে সঞ্চরমান তাও বাধাপ্রাপ্ত। শূন্যবৃত্ত থেকে শুরু করে কবির যাত্রা মহাশূন্যের দিকে, সেখানে আচার-আনুষ্ঠানিকতা কিংবা ক্ষমতার বন্ধনে পরশপাথর হৃদয় চূর্ণ বিচূর্ণ নুড়িতে পরিনত হতে পারে, স্বয়ংসিদ্ধ এই কবি নিজের হৃদয়কে সেই পথের সন্ধান দিতে চাননা বলেই হয়তো অন্যত্র বলেছেন


'যিনি শূন্যতাকে দুভাগে ভাগ করতে পারেন/সমান দুই ভাগে,তিনিই প্রকৃত কবি'


'একজন কবি যখন কবিতা লিখছেন, তখন তিনি স্বাধীন এবং দায়বদ্ধ। স্বাধীন এবং দায়বদ্ধ কি পরষ্পরবিরোধী নয়।আদৌ নয়। কারণ 

শব্দনির্বাচনে তিনি স্বাধীন।অথচ কবিতার কাছে দায়বদ্ধ কবিতাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করা প্রসঙ্গে তিনি দায়বদ্ধ।এই দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও তিনি স্বাধীন।...'

এই আপাত পরষ্পরবিরোধিতার মধ্যে যে ফিকশন বা দ্বন্দ্ব তাই মূলত জীবন অতএব কবিতাতেও তার সৎ প্রকাশ ঘটবে এ স্বাভাবিক। উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করলাম কারণ আলোচ্য কবি উপরিউক্ত যে বিশ্বাসে স্থিত তেমনই কবিতায় 'নিপাতনে সিদ্ধ' কে 'নিয়ম' হিসেবে উল্লেখ করেছেন যদিও সূত্রটাই নিয়মহীনতার বা অনিয়মের । আমাদের অন্তর্গত ব্যাকরণ যাকে কবি চিহ্নিত করেছেন 'ব্যক্তিগত ব্যাকরণ' হিসেবে সেটি মগ্ন চৈতন্যের অতলে ডুবে থাকা 'মিষ্টিজলের হ্রদ' কে খুঁড়ে বের করে আনে অতিক্রান্ত চৈতন্যের স্তরে।


'যেকোনো কৌতূহলের ভিতরে/একটা করে 

মিষ্টিজলের হ্রদ থাকবেই/এটা জানা কথা/আর অজানা কথাটি হল /প্রতিটি 

মিষ্টিজলের হ্রদের একটি করে/ব্যক্তিগত ব্যাকরণ থাকে/সেই ব্যাকরণে একটিও নিপাতনে সিদ্ধ/নিয়মটি প্রযোজ্য নয়।'(৫.)

এইভাবেই যোগসূত্র রচিত হয় জীবনের সঙ্গে কবিতার, কবিতার সঙ্গে ব্যক্তি তথা কবিসত্তার।

'আমি নিজে অবচেতনে বিশ্বাস রাখি না। আমি বিশ্বাস করি একজন কবি সবসময় ওভার–কনসাস বা সুপার–কনসাস।কনসাসনেসের স্বাভাবিক স্তর থেকে কয়েক মিটার কিংবা কয়েকঘণ্টা এগিয়ে থাকে একজন প্রকৃত কবির চেতনার স্তর।'('কবিতা লেখার রেসিপি'/'নানারকম')


অসংখ্য মনি-রত্নখচিত কাব্যভাষায় জড়ানো আলো-আঁধারি 'কৌতূহল'–তার বিস্তার গভীর,প্রশস্ত, একাধারে 

তরলও বটে; তবেই তো পাত্রের আকার পেলে সেই স্বাদু জল তার ঘ্রাণ প্রতিটি নাসারন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয় ব্যাকরণের সূত্র মেনে; কোনো অবচেতনে ঘটে যাওয়া 'নিপাতনে সিদ্ধ নিয়ম' এর বালখিল্য অসংলগ্নতা নয়, বরং উৎসর্গীকৃত প্রতিটা বোধ যাকে উৎসর্গ করা হচ্ছে তাঁর স্নায়বিক আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে থেকে যায়।৫নং কবিতাটির  শেষ পঙক্তি তাই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে সেই 'কুশলমৈত্র এই কুশলসংবাদগুলিকে কীভাবে/গ্রহণ করে সেটাই দ্যাখার।' এই মর্মে গ্রন্থিত।

উত্তর আধুনিক কবিতা নির্দিষ্ট অর্থের বা গঠনের প্রতি মনোযোগের বিপ্রতীপে 

অবস্থান করে, সেখানেই উঠে আসে অবিনির্মাণবাদের প্রসঙ্গ যা প্রচলিত stagness কে ভাঙে শুধু নয়, পৃথক পৃথক করে কবিতার অর্থকেন্দ্রিক কাঁটাছেড়ায়  গুরুত্ব দেয় না।কারণ 'কবিতাযাপনের মধ্যে থেকে উদ্গত হয় কবিতা লেখার রেসিপি।' সেজন্যেই প্রতিটি 'কুশলসংবাদ'কে কবির পাশাপাশি আমাদেরও প্রজাপতির মতই উড্ডীয়মান ভেবে নিতে দোষ নেই।

'যখন একটি কুশলসংবাদ উড়তে শুরু/করে,তখন পাশাপাশি গুটিকয় প্রজাপতিও ওড়ে '(৬)

           'ওড়ে' এবং 'উড়তে' দুটোই ক্রিয়াপদ একটি সমাপিকা অন্যটি অসমাপিকা। দুটি ক্রিয়াপদ কে যুক্ত করে অরুণ মিত্র এর 'ওড়াউড়িতে নয়' এ ফিরে গেলেন কবি। তবে কি মানুষের আবহমানকালীন পাখি-মন কে ধরতে চেয়েছেন তিনি। পাখি=ওড়াউড়িতে নিবদ্ধ এমন দৃষ্টিভঙ্গি গতানুগতিক;পাখির যাত্রা বিশেষ থেকে নির্বিশেষে, ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকতার দিকে, অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্ব-বোধের দিকে।এমন দীর্ঘায়ত 'ওড়াউড়ি'র জন্য 'কেবলমাত্র দরকার ওড়ার বাসনা' তা পক্ষীবিশারদ 'সালিম আলি'-র স্মরণাপন্ন হয়েই কবি জানতে পেরেছেন।


প্রভাত চৌধুরীর কবিতার 

প্রতিটি পঙক্তিতে বোধাভিভূত ঐশ্বর্য ক্রিয়াশীল। ব্যঞ্জনার বলিষ্ঠতা সূক্ষ্মতাকে স্পর্শ করেছে পাহাড়চূড়ায়, চাতুরীহীন বাংলা কবিতা যেখানে জটিলতা বা বলা ভালো দুরূহতাও নিজস্ব অভিনিবেশ দাবি করে।

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির ভাষাশরীরে সময়ের চিহ্ন বহমান,তাই 'বিবাদিবাগের হোর্ডিং' পণ্যযুগের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিফলিত করে মানস-ঋতুর নানাবিধ সফল-অসফল,সংগুপ্ত কুশলসংবাদগুলি,যার কোনটি রঙিন কোনটি অপেক্ষমাণ–


'বর্ষাকালের কুশলসংবাদটি সর্বদা রঙিন বর্ষাতি ব্যবহার করে,/আর বসন্তকালের সুসংবাদটি /ফুটপাতের ওপর ফুল ফোটার জন্য অপেক্ষা করে'


অভিজ্ঞ বয়সের ধৈর্য নিয়ে কবি এবং তাঁর কবিতার সকর্মক ক্রিয়ারা কাজ করে–খাওয়া এবং খেলার মত বিপরীত কাজ, মাংসাশী ক্ষুধা ফুটবলে পদাঘাতেই সার্থকতা খোঁজে আবার বিপরীত দিক থেকে বলা যায় ব্যর্থতা ঢাকে। অতঃপর উল্লেখযোগ্য 'মাংস এবং ফুটবল/দুটিই বিশেষ্যপদ, এখনো খালি পায়েই হাঁটাচলা করে।' ভাব এবং ভাষার দারুণ ম্যারিনেশন।কবিতাও আসলে এই কবির কাছে রোজকার শব্দযাপনই বটে,প্রাত্যহিকতার থেকে আলাদা কিছু নয়।অতএব কবিতা লেখা কখনো 'রান্না', কখনো 'কৃষিকাজ' আবার কখনোবা–

'আমার কাছে লেখা এবং খেলা,একই গোত্রের, অনেককাল ধরে।ব্যাঞ্জনদুটির স্থান বদলে লেখা হয়ে যায় খেলা,আর খেলা হয়ে পড়ে লেখা।'(পোস্টমডার্ণ কবিতায় রং'/ঐ)


প্রতিটি কবিতায় শব্দ-রং এর আলোড়ন বিস্মিত করে।'খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার' যে যাপন আমাদের, সেখানে আজকের কর্পোরেট জীবনে অভ্যস্ত আবাসনের নেই বারবাড়ি,নেই বড়ো উঠোনে মাধবীলতা ফুলের গাছ,সদর দরজা আর হাট করে খোলা থাকেনা সেখানে,তাই যেকোনো 'কুশলসংবাদ' এর জন্য কুরিয়্যারের আগন্তুকের কাছে জানলা থেকে বের করে দেওয়া গৃহস্থের সুখটুকুই আশাব্যঞ্জক; জানলার পর্দায় যতই জ্ঞানবৃদ্ধ 'হলুদ' আস্কারা পাক,বহির্পৃথিবীতে যে সবুজ এখনো বেঁচে বর্তে আছে, খানিকটা প্রাণ সঞ্চয় করে সেও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, ভারাক্রান্ত ঘরগুলোকে সজীব করে দেয়; কিন্তু আগন্তুকের তা দেখা হয় না। ততক্ষণে টমটম আর চাবুক নিয়ে নতুন পৃথিবী থেকে আবার সে যাত্রা করে পুরোনো পৃথিবীর দিকে,সেই যাত্রাপথের সঙ্গী 'সহৃদ -হৃদয়সংবাদী' 'কুশলসংবাদগুলি'। একদিন সেই আগন্তুক হতে পারেন আপনি,আমি বা অন্য কেউ।


'টমটমে ওঠার আগে চাবুকটির অবস্থান/জেনে নিতে হবে/এই চাবুকটি যতক্ষণ আপনাকে সঙ্গ দেবে/কুশলসংবাদগুলিও সঙ্গে থেকে যাবে'

সমগ্র কাব্যগ্রন্থটিতে একাধিকবার ব্যাকরণের অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে।ব্যাকরণ এখানে 'সূত্র' অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিকতা ধরে নেওয়া যেতেই পারে; চাঁদ, সূর্য, নদীর যে হিসেবে ব্যাকরণ আছে,ঋতুর প্রকাশেও ব্যাকরণ প্রতিফলিত হয় সেই অর্থে মানুষের জীবনের প্রতিটি সময়, মুহূর্ত-ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ডেও ব্যাকরণ থেকে যায়।'ঘন্টা' আসলে জীবন ও ব্যাকরণের যোগসূত্রকারী সেই অংশ যা আমাদের মধ্যে অভিজ্ঞতাকে জারিত করে,'অজ্ঞতার অবস্থান এর' বদল ঘটিয়ে চোখ ফুটতে সাহায্য করে। ডোরাকাটা সময়ের নির্বিবাদ একাকিত্বে আত্মমগ্ন 'কুশলসংবাদেরা' তাই প্রাজ্ঞ; সেইজন্যেই তারা 'কখনোই বাদানুবাদে /জড়িয়ে পড়ে না, তারা ভাঙা গ্রামোফোনের মতো/সুখী গৃহকোণে শুয়ে পড়ে'(১০)


'আমার কবিতা থেকে 

মধ্যবিত্তসুলভ ধনে-জিরের গন্ধ উঠে আসে না। আমার রেসিপিতে থাকে ফ্রেসক্রিম,কাজু চারমগজবাটা–এসবে এখনো  অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি বাংলাকবিতার পাঠক।'

যে কবি নিজেই একথা বলেন তিনি তাঁর কবিতায় আবার 'একান্নবর্তী রান্নাঘর', 'বৈঠকখানা'র প্রসঙ্গ আনেন তাহলে সেও কি উত্তর আধুনিক সময় তথা মননের দ্বান্দ্বিকতা,

পরষ্পরবিরোধিতার কারণেই? 'ওভার কনসাস' কিংবা 'সুপার কনসাস' এ বিশ্বাসী কবির প্রতিটি 'কুশলসংবাদ' এর নেপথ্যে যে একান্নবর্তী রান্নাঘরটি নিভৃতে কাজ করে চলে তা কি আসলে আমাদের নিভৃত চৈতন্যের হাজার রকম মশলাপাতির হদিশ দেয়না? 'একটি ঘন্টা' যা প্যাভলভের অনুবর্তণ তত্ত্ব মেনে খাবার তৈরি হলেই জড় থেকে জীব এর ভূমিকা পালন করে যেন। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক উদ্দীপক=খাবার , ঘন্টার প্রতিক্রিয়া= 'সে নিজে নিজে বেজে ওঠে/তাকে বাজাতে হয় না,...'(১২)


ভেতরঘরের এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব (বিরোধ এবং মিলন দুই অর্থেই) কে সঙ্গে নিয়েই অন্তর্গত 'কুশলসংবাদ'টি বৈঠকখানার ভিড়ে মিশে যাবে;তখনও একলা-মনে যে খাবার তৈরি হয় তার স্বাদ-বিস্বাদের 'অল্পকথাকে/কেউ যদি গল্পকথা বলেন/কুশলসংবাদ কখনোই প্রতিবাদ করবে না।'

নিস্পৃহ ভঙ্গীতে জীবনের স্পৃহার কথা বলে চলেন কবি। সামগ্রিকতার ভিড়ে যে ছোট ছোট, টুকরো টুকরো উপাদানগুলো চোখ এড়িয়ে যায় তাদের আত্মস্থ করে কবিতায় জায়গা করে দেন। 'প্রতিটি ঝুলবারান্দার কিছু ব্যক্তিগত কুশলসংবাদ ' উপলব্ধির জন্য পরিস্থিতি থেকে 'সর্বনাম' গুলোকে গুটিয়ে পাশে রাখলেই চলবে,মূল নাম কিংবা 'বিশেষ্য' থেকেই হয়তো ব্যক্তিগত অনুভূতির পাকপ্রণালী সম্পূর্ণ হবে,তখন কুশলসংবাদগুলির ভেতর সেদ্ধ নাকি ঝোল ভরা আছে যা সাংগীতিক এবং সাংকেতিক কোন সন্ধেতে ঝুলবারান্দায় থিতু হওয়া সময় নিজেই টের পেয়ে যাবে।


'কুশলসংবাদ' কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা ওরফে 'কুশলসংবাদ'গুলি পোড় খাওয়া ভাষার, ভাঁজ খাওয়া সময়ের এক নিজস্ব আত্মকথন বললেও অত্যুক্তি হবে না;ব্যক্তিযাপনের সঙ্গে শব্দযাপনের অনিবার্য সম্বন্ধকে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন–তাদের সুচারু কোলাজ তৈরি করে ধুতরো-সাদা খামে পুরে পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্যক্তির আদলে সহচর চৈতন্যের কাছে, যাঁর আগ্রহে তথাকথিত মননধর্মীতার টোল খাওয়া সলজ্জ ন্যাকামির উর্ধ্বে এক ক্রুশবিদ্ধ যুগসত্যের সন্ধান দিয়েছেন কবি।সেই বাস্তবতায় বলা যায়  ততোধিক বিদ্ধ হয়েছি আমরা ওরফে পাঠকেরা। সর্বোপরি এও সত্য যে কবিতা কোনো তত্ত্ব নয়, যুগের ক্ষত সেখানে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়; তাত্ত্বিকতার দ্বারা নির্দিষ্ট সেই যুগ বৈশিষ্ট্য (এক্ষেত্রে উত্তর আধুনিক)কে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রও নয় ; কবিতা কোনো গাণিতিক ফর্মুলা, রাসায়নিক সমীকরণ, বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফারমেনটেশন নয়। শুধুমাত্র ভাষা,শব্দ-এর পরীক্ষামূলক, তাত্ত্বিক গঠনের দিকে কবির দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকলে তাও একমুখীনতারই নামান্তর।যে উত্তর আধুনিকতা একমুখীনতা থেকে বেরোবার কথা বলে,বহুরৈখিকতার কথা বলে, এক্ষেত্রে তা যেন স্ব-বিরোধিতার জল্পনাকেই উস্কে দেয়।বলাই বাহুল্য শিল্প তথা কবিতা যতটা জীবনের কিংবা মাটির কাছাকাছি ততটাই রসাশ্রিত তা শিল্পবোদ্ধা থেকে শিল্পরসিক এবং স্বয়ং শিল্পী-কবিরাও স্বীকার করবেন। কবিতা শুধুমাত্র আনন্দের জন্য পড়ব এ ধারণা যেমন বিগত,বিক্ষিপ্ত এবং বৈকল্যের বশীভূত 

তেমনই কবিতার মাধুর্য বা কাঠিন্য যাই হোক না কেন তার নিজস্ব কাব্যরস আছে এবং তাকে আস্বাদন করতে চাওয়ার দাবির মধ্যে পাঠকের কোনো অন্যায় নেই। তাই যেকোনো ভাঙচুর—সময়,যুগ, শব্দ, ভাষা, বোধ-এর ওপর দিয়ে চলুক না কেন হৃদয়ের উপস্থিতি একান্ত কাম্য, যে হৃদয় কবিতার অন্তরে ফল্গুর মত অন্তঃসলিলা হলেও হতে পারে কিন্তু সরস্বতীর মত যেন লুপ্ত হয়ে না যায়।


বইটি কিনতে এখানে ক্লিক করুন।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন