জীবন থেকে কবিতায় এবং কবিতা থেকে জীবনে ফেরা

পর্ব ৪

সম্পর্কের কার্যক্রম এবং কবিতা 

আফজল আলি


একটা লেখা যেখান থেকে হোক শুরু করা যায়। চায়ের দোকান বা বাসস্ট্যান্ড থেকে, বা সবজিবাজার কিংবা মিঠে রোদ্দুর। মানসিক অবস্থান থেকে ও শুরু করা যেতে পারে । অর্থাৎ যে কোনো অবস্থান-ই হল শুরুর জায়গা। আর একবার শুরু হলে তা যেকোনো দিকে বয়ে যেতেও পারে। অভিমুখ নির্দিষ্টে বা অনির্দিষ্টে। পাঠক সব সময় একটা সদর্থক সমাপ্তি পছন্দ করে , গল্পের ক্ষেত্রে মিলনান্তক বা বিয়োগান্তক যে কোনো হতে পারে। কিন্তু গদ্য লেখার ক্ষেত্রে তেমন কোনো দায়বদ্ধতা নেই , যেকোনো বিষয়কে ধরে এগিয়ে যাওয়া হতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে তো বিষয়টা আবার সম্পূর্ণ আলাদা।

শব্দের সাথে শব্দের লেগে থাকার প্রক্রিয়া দেখলেই বোঝা যায় এটি কবিতা। এখন অবশ্য কবিতা , ব্যক্তিগত গদ্য এবং গল্পের মধ্যে গুণগত ফারাকটা অনেকটা কমে গেছে। ভাষাগত দিক দিয়ে পরস্পর পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। কোনো কোনো গল্পের ভাষা বা ভাষ্য দেখলে বোঝা যাবে যেন একটা কবিতা পড়ছি । তীব্র অনুভব টানতে টানতে পার হচ্ছে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়েই হতে পারে অনেক ধরনের লেখা। এই সম্পর্কের বিষয়টা বেশ জটিল। সম্পর্কের মধ্যে নানান রসায়ন কাজ করে। উপর থেকে দেখলে ঠিক মতো ধরা সম্ভব নয়। সম্পর্কের মধ্যে থাকে উদ্বেগ , চিন্তা , ফাটল ,ধারণ করা , থাকা বা না থাকা। 


যেমন ধরা যাক সম্পর্কের কার্যক্রম : 

মনের সাথে মনের বিন্যাস এবং স্থাপনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় সম্পর্কের কার্যক্রম। যে সম্পর্কের মধ্যে কিছু না কিছু রসায়ন বা উন্মোচন বা কার্যক্রম থাকে সেই সম্পর্ক হল positive relation . একটা বাগান তৈরি করার সময় যুক্ত গাছ বা তার মালি বা পরিচর্যাকারীর মধ্যে দৈনন্দিন একটা সমন্বয় থাকে। গাছ বসানো থেকে শুরু করে বড়ো করা পর্যন্ত সামগ্রিক পরিচর্যা। এর ফলে গাছ ও মানুষের মধ্যে একপ্রকার মানসিক এবং শারীরিক মেলামেশার প্রক্রিয়া চলে । এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটা আবন্ধন তৈরি হয় এবং এই বন্ধনের মধ্যে কার্যক্রম লুকিয়ে থাকে অর্থাৎ কিছু না কিছু কাজ বা প্রত্যাশা বা যুক্ত হওয়ার সামঞ্জস্য। এই প্রক্রিয়া একে অপরকে চিনতে জানতে সাহায্য করে এবং চেনা জানার মধ্যে থাকে ভাবের আদানপ্রদান। এই ভাবের আদানপ্রদান হল জীবন্ত একটা মাধ্যম যা মানসিক এবং শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে বসে । এই প্রভাবের ফলে সম্পর্কের positive দিক সৃষ্টি হয় , সম্পর্ক এগিয়ে যেতে থাকে। একজন প্রেমিক প্রেমিকার সাথে , পিতার সাথে সন্তানের , স্বামীর সাথে স্ত্রীর , ব্যক্তির সাথে আত্মীয়র বা পারিবারিক বা ব্যক্তির বা সামাজিক, সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে positive কার্যক্রম থাকে । আয়নায় আলো পড়লে যেমন প্রতিফলন হয় , তেমনি সম্পর্কের মধ্যে কার্যক্রম যুক্ত হলে সেখান থেকে প্রবাহের প্রতিফলন হয় । রক্তের সম্পর্কের সাথে এই প্রবাহের প্রতিফলন খুব তীব্র থাকে , সেই জন্য ই বলে রক্তের সম্পর্ক শিরার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় , এবং একটা বৃহত্তর পরিসর তৈরি করে। সেই পরিসরে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা অনেক থাকে । যাকে আমরা পরিবার বলি । পরিবারের মধ্যে স্নেহ ভালোবাসা শ্রদ্ধা এসবের বন্ধন থাকে, সেখানে থাকে দৈনন্দিন কার্যক্রম। 


আবার রক্তের সম্পর্ক না হলেও বন্ধন থাকবে না এমন নয় যদি সেখানে থাকে কার্যক্রম। যেমন ধরা যাক এক প্রেমিক প্রেমিকা যুগল। এই প্রেমের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন বা অদৈনন্দিন একটা রসায়ন থাকে যেখানে মানসিক কিছু বিনিময়, ভালোবাসার উত্তাপ , কথা বিনিময় এবং পরবর্তী। এই positive কার্যক্রম তাদের মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার বা যুক্ত থাকার আবহাওয়া তৈরি করে দেয়। ইদানীং প্রযুক্তির যুগে তো এটা অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছে । স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কটাও অনেকটা এরকম এবং আরো কিছু বেশি , দায় দায়িত্ব। দায় দায়িত্ব সব সম্পর্কের মধ্যেই থাকে । সম্পর্কের এই কার্যক্রমের মধ্যে অধিকার একটা প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ যাদের মধ্যে সম্পর্কের কার্যক্রম তৈরি হয় , তাদের ভিতর পরস্পরের অধিকার-বোধ জন্ম নেয় ; এই অধিকার-বোধ আবার এককভাবেও থাকতে পারে । কোনো কৃষক যখন জমিতে চাষ করে , তখন গাছ এবং উৎপন্ন ফসলের প্রতি তাঁর একটা অধিকার-বোধ থাকে । এই সম্পর্কে অধিকার-বোধ এক তরফা হলেও , পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের কার্যক্রমে এক তরফা অধিকার প্রকট থাকে না। সেক্ষেত্রে পারস্পরিক যুক্ত। 

Positive কার্যক্রমের উপাদান অনেক কিছু হতে পারে। শিল্প সাহিত্যের মধ্যে এই কার্যক্রম যুক্ত থাকে। 


অন্য দিকে যে সম্পর্কের মধ্যে positive কার্যক্রম না থাকে , সেই সম্পর্ক বেশি দিন চলে না । অল্প কিছুদিন পর তা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে । অর্থাৎ কার্যক্রমহীন সম্পর্ক হল টেনে চলা এক প্রক্রিয়া যা অচিরেই সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায় যার বাস্তব প্রতিফলন থাকে না। কিন্তু মানসিক ভাবে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে , যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। কারণ যে সম্পর্কের মধ্যে প্রক্রিয়া বা রসায়ন না থাকে তা মৃতপ্রায়। যেমন ভেঙে যাওয়া প্রেম , অথবা দূরত্বের ব্যবধান। বাংলায় একটা প্রবচন আছে -- দূরে থাকলে পর , কাছে থাকলে আপন । এক্ষেত্রে দূর মানে কার্যক্রমহীন মানসিক দূরত্ব। কার্যক্রমযুক্ত দূরত্ব কিন্তু সমাপ্তির পথে যায় না। ছেলে প্রবাসে থাকলেও বাবা মার সাথে যুক্ত থাকে। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলেও বাবা মায়ের সাথে যুক্ত থাকে। 


Positive কার্যক্রমের উপাদান অনেক কিছু হতে পারে। সাহিত্য শিল্প সঙ্গীত, শিক্ষা, বোঝাপড়া ইত্যাদি । কবিতা বা সঙ্গীত এই দুইয়ের মধ্যে positive কার্যক্রমের উপাদান খুব শক্তিশালী। কবিতা দুজন ভিন্ন বয়সী মানুষের মধ্যে খুব দ্রুত সেতুবন্ধন করে দিতে পারে। কবিতার মধ্যে সেই রসায়ন থাকে যা সম্পর্কের মেলবন্ধন ঘটায়। কবিরা যেহেতু basically রোমান্টিক হয় , সেই জন্য দুজন মানুষ মানসিক ভাবে খুব কাছাকাছি চলে আসতে পারে , বয়সে ফারাক থাকলেও , কারণ কবিতা মিলিয়ে দেয় , বেঁধে বেঁধে থাকতে প্ররোচনা দেয় , সেতু তৈরি করে। তাই বলে কি কবিদের সাথে কবিদের দূরত্ব নেই । অবশ্য ই থাকে, সেক্ষেত্রে ইগো বা খ্যাতির নৈকট্য লাভের মোহ একটা মূল অন্তরায় । অন্যথায় মেলবন্ধন হবেই। নির্জনতা প্রিয় কবিরাও কারো নৈকট্য লাভ পছন্দ করে , সেটা অবশ্যই selective. সেই জন্যই কি কবিদের প্রেম একটা বিষয়। মেলবন্ধন স্থাপনের অর্থ বেপরোয়া অসুন্দর নয় নিশ্চয়। কারণ কবিতা itself a beauty. তাই কবিতার অন্তর্গত সম্পর্ক কুৎসিত হতে পারে না। কবিরা কখনো খুনি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। প্রেমিক/ প্রেমিকা হতে পারে , অভিভাবক হতে পারে , বন্ধু হতে পারে, সমাজ সচেতন হতে পারে , অন্তরের দিশারী হতে পারে। এই সম্পর্কের সাথে জড়িয়ে থাকে কবিতা লেখার উপাদান তথা শক্তি। সম্পর্কের মধ্যে electromagnetic force লুকিয়ে থাকে, যদি সেই সম্পর্কে কার্যক্রম থাকে। তাই কবিতা হল সম্পর্কজাত এক রসায়ন যার নিজস্ব বিভাব থাকে। তাই তো কবিতায় যাপন করতে হয় । সম্পর্কে যেমন যাপন থাকে। 


একজন তরুণ কবি কেন কবিতা লিখবেন এ বিষয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে আগে । আমিও বলেছি । আসলে একজন তরুণ কবি যে সময় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে , সেখানের মধ্যেই তার যাপন প্রয়োগ। কিন্তু তাকে উপরের সিঁড়ির দিকে দেখতে হবে । উপরের সিঁড়ি বলতে আমি পরবর্তী অঞ্চলের কথা বললাম , যে অঞ্চলে কবির জন্য অপেক্ষা করছে একটা নতুন ঘর , যে ঘরের দরজায় চাবি দিয়ে বন্ধ করা আছে , এবং চাবিটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন কবিকেই খুঁজতে হবে চাবি , তারপর খুলতে হবে দরজা। আর না পারলে তাঁকে বারান্দায় বসেই কাটাতে হবে। অর্থাৎ প্রচলিত প্রক্রিয়ার মধ্যেই তাকে অংশ নিয়ে কাটাতে হবে , তিনি দেখবেন যা তাকে আজ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। এই দেখানোর বাইরে সে অন্ধ। তাই নতুন ঘরের চাবি খুলে প্রবেশ করার বিষয়টি বেশ অভিনব। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে আগে। 


সম্পর্কের কার্যক্রমে যেমন জীবনের যোগ , তেমনি কবিতার যাপনে কবির যোগ । অন্তরের সাথে কবিতার প্রতিনিয়ত যে স্থাপন হয় , তার নিগূঢ় সমাচার হল কবিতা , কবিতার ভাষা । প্রতিটা কবিতা লেখার সময় তাই কবিকে নতুন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় , নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের অভ্যাসে , আর মস্তিষ্ক থেকে নির্গত হৃদয়যুক্ত রসায়ন, আর এইরূপ প্রতিপন্নতার ধারক হল সম্পর্কের কার্যক্রম , যার মধ্যে আনন্দ আছে , উপভোগ আছে , বিস্তার আছে , কষ্ট যে নেই তা কিন্তু নয় , তবে কষ্টের শেষে স্বর্গীয় আনন্দ আছে। সেই মোহেই তো কবিতা লেখা। একটা কবিতা লেখা সম্পূর্ণ হলে মনের ভিতর নতুন করে শক্তি সঞ্চয় হয় , নতুন আলো , নতুন দিশা , নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা , দুঃখ মুছে ফেলার উৎসাহ, হতাশা ধুয়ে ফেলার support এবং আপন অস্তিত্বের প্রমাণ। 


যেকোনো পড়াশোনার সাথেই যেমন আলো লুকিয়ে থাকে , তেমনি যেকোনো কাজের মধ্যে সেই আলোর ছাপ লুকিয়ে থাকে। তাই কাজ করলে মন ভালো থাকে। তাই পড়াশোনা মনে শক্তি জোগায় , ভিতরের শক্তি। কবিতা লিখলে নিজের সাথে নিজের সাক্ষাৎ হয় , সংযোগ হয় । তাই কবিতা কেন লিখবে তা যেমন বোঝা দরকার , তেমনি দরকার জানা , কী হয় কবিতা লিখে। ভালোবাসার কোনো লজিক থাকে না, এটা যেমন সত্য , তবু কিছু কারণ ভিতরে লুকিয়ে থাকে। যদি কেউ বলে কবিতা ভালোবেসে কবিতা লেখা , এই বক্তব্যের ভিতরে কোনো লজিক খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় , তবু মনে হয় কবিতা কেন লেখা এবং কী হয় লিখে , এর মধ্যেও লজিক , ব্যাখ্যা আছে । নিজের সাথে নিজের সম্পর্কের কার্যক্রমের জন্য কবিতা লেখা একটি উত্তম প্রক্রিয়া, তবে কবিতা অবশ্যই একটি নতুনের সন্ধান যা ব্যপ্ত হতেই থাকে। তাই বলে কি বেশির ভাগ কবি পুনরাবৃত্তি করছেন না তাঁদের লেখনী। যাঁরা করছেন তাঁরা করতেই পারেন , সেটা দেখা আমার কাজ নয় । আমার কাজ জানিয়ে দেওয়া।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন