নাসেরদাকে যেমন দেখেছি

 চন্দ্রদীপা সেনশর্মা

'নিশ্চিত-শূন্যে লাফ দিয়েছি দিগন্তবিস্তারী'--নাসের হোসেন


নাসেরদা চলে গেছেন নিশ্চিত-শূন্যে প্রায় দুমাস।

অনেকেই লিখেছেন এখনও লিখছেন তাঁকে নিয়ে।

কেউ বলছেন অনিন্দ্যসুন্দর, কেউ বলছেন মসিহা

কেউ বা সান্তাক্লস কিংবা ঈশ্বরের থেকে বড়ো।

ঈশ্বর শব্দের অস্তি নাস্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব চিরন্তন। নাগেশ

কুক্কুনুড়ের 'ডোর' সিনেমার দুতিনটি সংলাপ

আমার খুব পছন্দের। "বিধবা দিদিশাশুড়ি

নাত-বউকে বলছেন: 'নাত-বউ যেন তার বন্ধুকে

ক্ষমা করে দেয় এবং নিজের স্বামীর হত্যা যে বন্ধুর

স্বামীর দ্বারা অনিচ্ছাকৃত ভাবে হয়ে গেছে এই

বয়ানে সই করে দেয়।' ক্ষুব্ধ নাত-বউ উত্তর দিচ্ছে:

'ম্যায় ইনসান হুঁ, ফরিস্তা নহীঁ।' ঠোঁটে হালকা হাসি

ঝুলিয়ে শাশুড়ি বলছেন: 'ইনসান হো ইসলিয়ে,

ফরিস্তো কো কাঁহা মওকা মিলতা হ্যায় মাফ করনে

কা?'" নাসের হোসেন তেমন একজন যিনি ঈশ্বরের

মতো অনুশীলিত 'ডোর'-এ বাঁধা পড়েননি--'ইনসান'

হতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর সব 'ডোর' (বিশ্বাস

বন্ধুত্ব সম্পর্ক কাজকর্ম) মুক্ত এবং মুক্তি। এবং

তাঁর সারল্য। তিনিই লিখতে পারেন:

শিশু

--------

শিশু সেই আয়না

মানুষ

নিজের মুখ দেখে


দুহাজার চার সালে কবি শম্ভু রক্ষিতের জন্য রবীন

মণ্ডলের সহযোগিতায়, কালীকৃষ্ণ গুহর উদ্যোগে

এগিয়ে এলেন কয়েকজন শিল্পী, তাঁদের আঁকা

ছবি নিয়ে চিত্র প্রদর্শনী। বাবার সঙ্গে আমি

উপস্থিত। ওখানেই বাবা আলাপ করিয়ে দিলেন

নাসেরদার সঙ্গে। বললেন, কবি নাসের হোসেন, 

তুমি পড়েছ ওঁর কবিতা। কবিতা পাক্ষিকে বহু

আগে তোমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল ওঁর

জন্য। আমি মাথা নাড়লাম। ওঁদের গল্প শুরু হল।

নাসেরদা বললেন, তুমি ছবি দেখেছ? দ্যাখো।

ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছি। যদিও এ বিষয়ে আমি

অজ্ঞ। একটি ছবির সামনে আলোকজেঠুর

সঙ্গে দেখা, আলোক সরকার। ছবি দেখে দুজনে

বসলাম। জেঠু বললেন, তুমি বাড়ি ফিরবে তো?

আজ অজয়বাবু আর নাসেরের কথা শেষ হবে

বলে মনে হচ্ছে না। আমাকে একজন নিয়ে

এসেছেন গাড়িতে। জায়গা আছে, ফিরতে পারো

বাবাকে বলে। জেঠু হাসলেন।


আলোকজেঠুর সঙ্গে ফেরা হল না। কবি নারায়ণ

মুখোপাধ্যায় এলেন, তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল।

কীভাবে কোথায় তিনি আমার মতো সামান্য

মানুষের লেখা পড়েছিলেন কে জানে। তিনি

আমাকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। নাসেরদা

মাথা নাড়লেন, ভাবখানা এই, শোনো ওঁর কথা।

আমি আর অজয়দা আর একটু আড্ডা দিই।

প্রায় ঘণ্টাখানেক আমরা কথা বললাম। তিনি

আমার নারায়ণকাকু হয়ে গেলেন। আড্ডা কিন্তু

চলছে ওদিকে। ফেরার পথে বাবা বলেছিলেন,

নাসেরের মতো সহজ হও। আমি বলেছিলাম,

মানুষ এত সুন্দর হন কী করে? বাবা বলেছিলেন,

নাসের ভিতর থেকেও সুন্দর, যেমন অমলিন মুখশ্রী

তেমন অমলিন স্বভাব।


দুহাজার চারে আমার একফর্মার দ্বিতীয় কবিতার

বই প্রকাশিত হয় কবিতা পাক্ষিক থেকে এবং

কবিতা পাক্ষিক বইমেলা সংখ্যায় একটি কবিতাও।

বাবার সূত্রেই কবিতা পাক্ষিকের সঙ্গে আমি জুড়ে

গেলাম। আমরা তখন পাটনা প্রবাসী দেবেশের

কর্মসূত্রে। ছুটিতে কলকাতায় এলে পত্রপত্রিকা

বাবার সংগ্ৰহ থেকেই পড়তাম। কবিতা পাক্ষিক

থাকত, নাসেরদার কবিতাও। দুহাজার চার-এ

পাটনা থেকে ফিরে ওইদিনই বাবার প্রথম স্ট্রোক

বা সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়। পরেরবছর দ্বিতীয়

স্ট্রোক। দুহাজার ছয় সালে নভেম্বরে থার্ড স্ট্রোক

এবং তাতেই বাবা দুহাজার সাতের জানুয়ারিতে

চলে গেলেন। আমার তৃতীয় কবিতার বইয়ের প্রুফ

দেখা অসমাপ্ত থেকে গেল। শম্ভুকাকু (রক্ষিত)

নিজের প্রয়াসে সেটি প্রকাশ করলেন। আমি

পুনরায় লেখা ছেড়ে দিলাম।


                                   ২

দুহাজার আঠারো সালে কলকাতায় ফিরে বাবার

বইয়ের খোঁজ করতে করতে তাঁর বন্ধুদেরও খুঁজে

চলেছি। বইমেলা ২০১৯, হঠাৎ করে পেয়ে যাই

কবি কালীকৃষ্ণ গুহকে, তিনি বাবার অনুজ বন্ধু

হলেও আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ সেদিনই।

কবিতা পাক্ষিক স্টলে প্রভাত চৌধুরীর খোঁজ করি,

শুনেছি তিনিও অসুস্থ ছিলেন। চোখ খুঁজছিল

নাসেরদাকেও। দেবেশ বলল, চিনতে পারবে?

বললাম, নাসের হোসেন প্রভাত চৌধুরীকে একবার

দেখলেই মনে থাকে। প্রভাতকাকুকে অন্নপূর্ণার

ছোটঘরে দেখেছি এবং বাবার মৃত্যুর পর ২০০৭

বইমেলায় তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করেছি,

তিনি অজয়দার প্রশংসা করে খুব আদরে আমাকে

পটলডাঙ্গায় ডেকেছিলেন, যাওয়া হয়নি।


স্টলে একজন ভদ্রমহিলা বই গোছাচ্ছেন।

প্রভাতকাকু এলেন, পরিচয় দিলাম বাবার নাম

বললাম। তিনি জড়িয়ে ধরলেন, ওই ভদ্রমহিলার

দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যূথিকা দ্যাখো দ্যাখো

অজয়দার মেয়ে, আমাদের কলেজস্ট্রিটে ঘর ছিল

না, অজয়দার জন্য অন্নপূর্ণার ঘরে বসতাম। তাঁর

আমন্ত্রণে পটলডাঙ্গায় এবং 'সমিধ' পত্রিকার

অনুষ্ঠানে এবং আবার নাসের হোসেন। দেখলাম

বয়স বেড়েছে চুল পেকেছে কিন্তু একইরকম

সৌম্য ভদ্র। তিনি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছেন।

নাসেরদা নাম ঘোষণা করছেন কবিতা পড়বে

চন্দ্রদীপা, ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

জীবনে ওই প্রথম স্টেজে কবিতা পড়া। উঠতে

গিয়ে নাসেরদার প্রশ্রয়সুলভ হাসিটি পেয়ে গেলাম।

পড়লাম, নামতে গিয়ে ছোট্ট করে কানে এল,

ভালো। হ্যাঁ এই সেই মানুষ, যিনি অবলীলায় এমন

উৎসাহ দিতে পারেন।


এরপর অন্যান্য অনুষ্ঠানে এবং কবিতা পাক্ষিক

পটলডাঙ্গা দপ্তরে বারংবার দেখা। নাসেরদা

বাবাকে নিয়ে কিছু লিখুন, একটা সংকলন বের

করব। অজয়দার পাঁচটা গল্প থাকলে দিয়ো।

জেরক্স নিয়ে গেলাম। বললেন, আজ অনেককিছু

আছে, ভুলে যাব। বহরমপুর থেকে ফিরি। এই

দুবছরে আর দেওয়া হল না। প্রভাত চৌধুরী ৭৫,

জন্মদিনের অনুষ্ঠান। নাসেরদা বললেন, তোমাকে

শেষ পর্বটুকু সঞ্চালনা করতে হবে। আমি আছি,

চিন্তার কিছু নেই। এখানে বলি এই সঞ্চালনা

প্রায় ঘণ্টা দু-তিনেক নাসেরদা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে

অনায়াসে করে যেতেন, খুব কম বসতেন, ওই

দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন। নাসেরদা কিন্তু

ভিতরে ভিতরে অসুস্থ ছিলেন। না কাউকে বুঝতে

দেননি। আরো আরো আবদার, নাসেরদা, চন্দন

দাস মহাপৃথিবীর জন্য লেখা দিতে বলেছেন। --বেশ

বেশ দেব, শম্ভুদা কেমন আছেন? একদিন দিয়েও

দিলেন দুটো কবিতা। মুক্তোর মতো হাতের লেখা।

'হাঁটছি' কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন: '...আমি

হাঁটছি প্রান্তরে উপত্যকায়/ মরুভূমিতে সমুদ্রের

উপরে, হ্যাঁ ঠিক তাই, মোটেই/ ভুল শোনোনি

তোমরা, আমি এখন সমুদ্রের উপর/ দিয়ে

হাঁটছি...'           

                                

                                  ৩

আমরা যখন যা চেয়েছি, পেতেই চেয়েছি, কিছু

দিতে হবে এমন কথা মাথায় আসেনি। নাসের

হোসেন ছিলেন, তাঁর ভাষাতেই 'যেন-বা' কল্পতরু!

অজয় দাশগুপ্ত (বাবা) কাব্য সংগ্ৰহ প্রকাশ

অনুষ্ঠানের জন্য একদিন আগে ফিরে এলেন

বহরমপুর থেকে। প্রায় আড়াইঘণ্টার অনুষ্ঠান,

মহাবোধি সোসাইটি হলে, নাসের হোসেনের সুচারু

সঞ্চালনায় সম্পন্ন হল। কতবার বসতে চেয়ার

এগিয়ে দিলাম, দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু হয়তো

বসলেন, তারপরই উঠে পড়লেন। আমাকে বলে

দিয়েছিলেন, তুমি লিখে দেবে কীভাবে শুরু হবে।

পরপর কী কী করতে হবে। দিয়েছিলাম। ওঁকে

ছাড়া ওই কাজ অসম্ভব ছিল। কাব্য সংগ্রহের

বিভাব কবিতাটি পড়ার কথা ছিল তাঁর। কী নিষ্ঠায়

অন্যের বক্তব্যের সময় একবার চোখ বুলিয়ে

নিলেন কবিতাটিতে। বলার কথা ছিল বাবাকে

নিয়ে, সময় ছিল না, শুধু পড়লেন। গলা, উচ্চারণ,

শ্রদ্ধা, কবিতাবোধে সে ছিল অনবদ্য পাঠ।


আমার অণুকবিতার বই প্রকাশিত হবে বইমেলায়,

তার আগে নাসেরদার প্রশ্রয়ে নয়টি অণুকবিতা

প্রকাশিত হল কবিতা পাক্ষিকে। প্রভাতকাকুকে

নাসেরদাই রাজি করান। কলকাতা বইমেলা

২০২০ আমার বই, 'মন্থর মুহূর্তগুলি'র আনুষ্ঠানিক

প্রকাশ করলেন একত্রে কালীকৃষ্ণ গুহ প্রভাত

চৌধুরী যূথিকা চৌধুরী মুরারি সিংহ নাসের হোসেন

এবং শুভদীপ সেনশর্মা। বইমেলায় একদিন

স্টলের বাইরে নাসেরদা হাত নেড়ে ডাকলেন।

বললেন, চন্দ্রদীপা, অজয়দার কাব্য সংগ্ৰহ

পড়লাম। চতুর্দশপদী পড়া ছিল (কবিতা

পাক্ষিকের বই), আবার পড়লাম, মেঘদূতম্

অনুবাদও, কী ভালো লাগল। তুমি খুব ভালো কাজ

করেছ, অজয়দার গল্প সংকলন প্রকাশ কর। তিনি

মুখে শান্ত হাসি ঝুলিয়ে প্রত্যেকের কথা ভেবে

গিয়েছেন আজীবন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর

তাঁকে নিয়ে লেখা একটি কবিতার অংশ তুলে দিই:

'আমাদের যাদের/ বয়সের গাছপাথর নেই, তাদের

জন্য আছে/ নাসের হোসেন আনাচেকানাচে।/

আমাদের হাতের/ লেখা যতই ক্ষুদ্রাকার হয়ে

আসছে সান্ত্বনা এই ভেবে/ নাসের হোসেন প্রেস

কপিটা তৈরি করে দেবে।'


বইমেলার শেষদিন আমাদের সঙ্গে ফিরছেন

নাসেরদা মুর্শিদ আলীদা। দেবেশ আমার আর

মুর্শিদদার থেকে বার বার পিছিয়ে পড়ছেন

নাসেরদা। সেদিন মনে হচ্ছিল নাসেরদা সুস্থ না,

স্টলে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ঠিক আছি।

হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল ঠিক নেই। আবারও

জিজ্ঞেস করলাম। একই উত্তর, কিন্তু হাঁপাচ্ছিলেন।

দুদিন পরে অসুস্থ নাসেরদা হাসপাতালে ভর্তি

হলেন। হাসপাতালে তাঁকে একবার দেখতে

গিয়েছিলাম। জানতাম খুব কঠিন অসুখে পড়েছেন

তিনি। তাঁকে দেখে বিশেষ চিন্তিত মনে হল না,

সামান্য ফ্যাকাশে, খাতাকলম আছে, হাসপাতালের

বিছানায় বসে চলছে লেখালেখি। ওইসময় দেবেশ

গেছে দু একদিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিন। এটুকুই তাঁর

জন্য আমাদের পাশে থাকা।


২০২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, জটিল অসুখ,

চিকিৎসাও বেশ জটিল। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে

উঠছিলেন। মার্চ থেকে করোনাআবহে লকডাউন।

নাসেরদাকে ফোন করলেই, ভালো আছো তো?

ভালো থেকো। আমাদের চিন্তামুক্ত করে গেছেন,

খোঁজ নিয়েছেন জার্মানপ্রবাসী আমাদের মেয়ের।

একটু সুস্থ হয়ে পটলডাঙ্গায় এলেন লকডাউন

মিটলে। শারদীয় কবিতা পাক্ষিক প্রকাশিত হল।

এই কারণে প্রভাত চৌধুরী বলে থাকেন, আমার

কাছে নাসের আর কবিতা পাক্ষিক সমার্থক। হঠাৎ

৮ ডিসেম্বর ডায়রিয়া নিয়ে নাসেরদা হাসপাতালে

ভর্তি হলেন। ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৬২ বছর বয়সে তিনি

আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। পটলডাঙ্গায় যে

চেয়ারে বসে তিনি কবিতা পাক্ষিকের যাবতীয়

কাজ করতেন, চলে গেলেন সেটি শূন্য করে দিয়ে।

'চেয়ারে দীর্ঘদিন কেউ বসেছিল, এখন সে নেই...'

   --নাসের হোসেন


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন