কিছু কিছু আক্ষেপ রয়েই যায়....

সন্তোষ/দাস


   জীবনানন্দ সভাঘরে একবার অধ্যাপক মিহির চক্রবর্তী মঞ্চে উপবিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পরিচিতি ঘোষণা করার সময় বলেছিলেন - "বাংলা সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে নাসেরকে চেনেন না এরকম কেউ নেই, থাকলে হাত তুলুন।" বলাবাহুল্য, একজনও হাত তোলেননি।

   কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যে মানুষটিকে নিয়ে একাধিক কবিতা লিখেছেন। যাঁর প্রুফ-কারেকশন দক্ষতার দক্ষতার প্রশংসা করে কবি অলোকরঞ্জন লিখেছিলেন- "আমাদের যাদের / বয়সের গাছপাথর নেই, তাদের জন্য আছে / নাসের হোসেন আনাচেকানাচে।" দূরদর্শনে শরৎ কুমার মুখোপাধ্যায়-এর লাইভ সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য যে মানুষটির ডাক পড়ত। যে মানুষটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করলে তাঁর সহকারী হয়েই থাকতেন প্রখ্যাত সংবাদপাঠিকা মধুমন্তী মৈত্র। পশ্চিমবঙ্গের অজস্র পত্রিকার নামাঙ্কন করেছেন যে মানুষটি - সেই নাসের হোসেনকে নিয়ে নতুন কিছু লেখা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা মাত্র।

   'ভুবনডাঙা' ওয়েব ম্যাগাজিনের 'নাসের হোসেন'- সংখার জন্য লিখতে বসে গুলিয়ে যাচ্ছে -- কবি নাসের হোসেন, সাহিত্য সংগঠক নাসের হোসেন, শিল্পী নাসের হোসেন আর মানুষ নাসের হোসেন-এর মধ্যে কাকে আগে স্থান দেবো। গুলিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যে মানুষটিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে হাতজোড়া বুকের কাছে চেপে ধরে বলতেন- "ভালো আছো তো।" কয়েক বছর অন্তর সাক্ষাৎ হলেও যিনি সহজেই কাছে টেনে নিতে পারতেন, তিনিই তো প্রকৃত কবি। ভারি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যিনি সীমাহীন সময় হাতে রেখে ধীর লয়ে এগিয়ে যেতে পারতেন অন্তরাত্মার দিকে, তিনিই প্রকৃত শিল্পী।

   তাঁর কবিতার কথা আমি আর নতুন করে কীই বা লিখতে পারি ! তাঁর কবিতা সারা বাংলার সীমানা পেরিয়ে বহির্বঙ্গেও সাদরে এবং সসম্মানে স্বীকৃত। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসে হাসপাতালের বেডে বসে যিনি 'পরমানন্দ' কবিতা লিখতে পারেন তাঁর জীবনই কবিতা আর কবিতাই জীবন।

   নাসেরদা'র সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ 'কবিতা পাক্ষিক'-এর হাত ধরে বছর-বারো আগে। শেষ সাক্ষাৎ গতবছর কলকাতা বইমেলায়, তাও দূর থেকে। তার আগে 'কবিতাপাক্ষিক' শারদ সংখ্যা-২০১৯ প্রকাশ অনুষ্ঠানে অনেক গল্প হয়েছে। বইমেলার পরপরই তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হ'ন। প্রভাতদা'র থেকে রক্তের প্রয়োজন শুনেই কলকাতা যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নাসের হোসেনের মতো মানুষকে রক্ত দেওয়ার জন্য শতাধিক মানুষ লাইন দিয়ে থাকেন। নাসের হোসেনরা সুস্থ হয়ে ফিরেও আসেন স্বাভাবিক জীবনযাপনে। 'কবিতাপাক্ষিক'-এর জন্য প্রুফ দেখতে হবে যে ! 

   আমার সম্পাদিত 'কবিতার সরাণ' পত্রিকা প্রভাতদা'র বাড়ি থেকে সাদরে গ্রহণ করে ছবি তোলেন সোস্যাল মিডিয়ার জন্য। ঠিক ছিল 'কবিতার সরাণ'-এর পরবর্তী সংখ্যার জন্য নামাঙ্কন করে দেবেন। তার আগেই কাউকে কোনো আভাসটুকু না দিয়েই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে পারি দিলেন আনন্দলোকে। তাই আক্ষেপ রয়েই গেল ! আর আক্ষেপ রয়ে গেল - দীর্ঘ বারো বছর ধরে সম্পর্ক থাকলেও একবারের জন্য পাদুটি ছুঁয়ে প্রণাম করতে পারলাম না ! কিছু কিছু আক্ষেপ রয়েই যায়...

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন