প্রিয় নাসেরদা , কবি নাসের হোসেন
আফজল আলি
কবি নাসের হোসেনকে নিয়ে কিছু লিখতে হবে তাঁর স্মরণে এটাই খুব কষ্টের। তাঁর আকস্মিক চলে যাওয়াটা যেমন অত্যন্ত বেদনাদায়ক , তেমনি ক্ষতি ও বটে , বাংলা কবিতার জগতে। নাসেরদার সাথে আমার যোগাযোগ এবং পরিচয় কবিতা পাক্ষিক সূত্রে , সেই 1999 সাল নাগাদ। কবি নাসের হোসেনের নাম শুনেছিলাম , কিন্তু সামনাসামনি পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। প্রভাতদার কালীঘাটের বাড়িতে গিয়ে দেখা হয়েছিল , তারপর কবিতা পাক্ষিকের অনুষ্ঠানে। কবিতা পাক্ষিক তথা প্রভাত চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ নিবিড় হওয়ার সাথে সাথে নাসেরদার সাথে ও সম্পর্ক নিবিড় হতে থাকে। কবিতা পাক্ষিক তো একটা পরিবারের মতো ছিল । কাজেই পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে সেই সম্পর্ক । প্রথম প্রথম তো একটু দূরে দূরে থাকা ছিল , কিন্তু পরে ধীরে ধীরে মানুষটাকে যখন জানতে পারলাম তখন বেশ সহজ হয়ে উঠেছিল । দেখতাম হাস্যময় এক মুখ , সৌম্য, সুন্দর, খুব কম কথা বলা একজন কবি।
কবিতা পাক্ষিকের বিভিন্ন আড্ডা বা অনুষ্ঠানে প্রারম্ভিক কথা তিনিই বলতেন। দেখা হলেই বলতাম , নাসেরদা কেমন আছেন । উত্তরে বলতেন , ওই তো , সব ভালো। তোমাদের সব ভালো তো । ঠিক এইটুকুই। তারপর আর বেশি কথা থাকত না , কিন্তু মানুষটাকে উপলব্ধি করা ছিল। পরবর্তীতে সম্পর্কটার মধ্যে কোনো দূরত্ব ছিল না। আসলে নাসেরদা এমন ই এক ব্যক্তিত্বের ছিলেন যেখানে তর্ক বিতর্ক অহং এসব ধারে কাছে ঘেঁষতে পারত না, প্রত্যেকের সাথেই তাঁর সুসম্পর্ক। প্রভাতদার পরেই কবিতা পাক্ষিকের সিংহভাগ কাজ তিনিই করতেন , কখনো ক্লান্তি ছিল না । তেমনটাই দেখতাম।নাসেরদার কবিতার প্রতি ভালোবাসা আমার প্রথম থেকেই ছিল। খুব প্রভাবিত হতাম। খুব সহজ সরল ভাষায়, গভীর অনুভব এবং পর্যবেক্ষণ, প্রজ্ঞার উন্মোচন , এইসব চিহ্ন উঠে আসত তাঁর কবিতায় । নাসেরদার লেখা পড়লেই বোঝা যায় যে এটা তাঁর signature. উত্তর আধুনিক ঘরানার কবি হয়েও , একইসঙ্গে উত্তর আধুনিকের বাইরেও সমাদৃত। সর্বত্র অনায়াস যাতায়াতের এবং গ্রহণযোগ্যতার এক সর্বজন সমাদৃত ব্যক্তিত্ব। যাঁর ছিল না কোনো শত্রু , কোনো সমালোচক। তাঁর সুন্দর লেখনীর সাথে মধুর স্বভাব মিলে মিশে আকৃষ্ট করে তুলত সবার মনে । যেমন নাসেরদার কবিতা ভাবের জগতে একপ্রকার বোধের জন্ম দেয় , তেমনি তাঁর সৌম্য চেহারা। যে কেউ আকৃষ্ট হবেন ই । খুব কম কথার মধ্যে দিয়ে , আর মৃদু হাস্যময়তায় তিনি বুঝিয়ে দিতে পারতেন অনেক কিছু। তাঁর ছিল এক গভীর দৃষ্টি। কবিতা পাক্ষিকের সমস্ত সংখ্যা এবং বইয়ের প্রুফ দেখা প্রভাতদা নির্ভর করতেন নাসেরদার উপরেই। আমি দীর্ঘ পনেরো বছর ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকার সুবাদে , কবিতা পাক্ষিক পরিবারের সিনিয়র প্রত্যেকেই দাদা বলতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম। তাই কবি নাসের হোসেন বলার থেকে নাসেরদা-ই আমার কাছে স্বাভাবিক এবং সুন্দর। যেমন প্রভাত চৌধুরীকে প্রভাতদা বলতে । সম্পর্ক আসলে মনের ভিতর থেকে গড়ে ওটা এক বন্ধন যা সহজে ছিঁড়ে যায় না। কবিতা পাক্ষিকের সাথে ও ঠিক তাই । মনের কাঠামোতে আপন ছিলেন নাসেরদা। কবি গৌরাঙ্গ মিত্র একটা কথা প্রায়ই বলতেন , নাসেরদা হলেন ঋষি , যাঁকে দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা খুব বেশি স্পর্শ করতে পারে না। বেশ অবিচল অবিচল এক ভাবমূর্তি। গৌরাঙ্গ বলতেন , আমাদের প্রভাতদা আছেন , নাসেরদা আছেন , আর কী চিন্তা। ব্যাপারটা ঠিক তাই । কবিতা লেখার পাশাপাশি নাসেরদা অর্জুন মিশ্র নাম নিয়ে কবিতা পাক্ষিক পত্রিকায় কবিতা সংবাদ লিখতেন। এবং অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। নাসেরদা ছবি ও আঁকতেন। তাঁর ছবির একক প্রদর্শনী হয়েছিল।
মিশে থাকা দৃশ্য সিরিজের কয়েকটি কবিতা পড়ি নাসেরদার।
১ : জল ও আছে
" কিরিকিরি রেখার গাছের পেছনে ও কার বাড়ি
আধো অন্ধকারে সবটা দেখা যায় না , ওখানে
হয়তো-বা ছায়া আছে , জল ও আছে , যে কারণে
সর্বত্র কীরকম একটা জলছবি-জলছবি ভাব
ফুটে উঠেছে, একপাশের ঘরে একজন কেউ বসে
সেতার বাজাচ্ছে, তাকে দেখতে না পেলেও ক্ষতি
হবে বলে মনে হয় না , কেননা তার সুর আছে
সুরের ঝংকারও আছে , সেখানেই রয়েছে যত কথা "
এই যে style এটা দেখলেই বোঝা যায় নাসেরদার লেখা। কোথাও শব্দের জটিলতা নেই , দুর্বোধ্যতা নেই , এক্কেবারে সহজ ভাবে প্রকাশ হচ্ছে। একটা গাছের পেছনে একটা বাড়ি , আর সেই বাড়ির ভিতরে কিছু দৃশ্য। এই দৃশ্যের প্রকাশের মধ্যে দিয়ে কবি যতটা বলেছেন , না-বলার মধ্যে প্রকাশ করেছেন আরো বেশি। যেন তীব্র দৃষ্টিতে তিনি দৃশ্যের ভিতরে দৃশ্যের বাইরের জগতকেই চিহ্নিত করেছেন বেশি। নাসের হোসেনের কবিতায় থাকে প্রজ্ঞার চোখ। একের পর এক পর্যবেক্ষণ উঠে আসে সেই চোখ দিয়ে, নান্দনিক ও শৈল্পিক বিভাবে পরিণত হয় কবিতা। উত্তর আধুনিক ঘরানার কবি , তাই তাঁর কবিতা দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে , একরৈখিক ছেড়ে বহু-রৈখিকে, ভাবের অসমাপ্ততা-- এই সব চিহ্ন বহন করে। পাঠকের চিন্তা চেতনে তিনি ঘটে চলা বিবরণের মাধ্যমে একপ্রকার অনুরণন তৈরি করতে সক্ষম হন এবং সেই অনুরণনে সম্মোহিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে ।
আর একটি কবিতা।
২ : সময়- বিক্ষেপ
" ওই যে ফ্লাওয়ার ভাস, তার গায়ে জড়িয়ে উঠেছে
পাতাঅলা অজানা কোনো গাছ , এবং সেই গাছের
মাথায় বসে একটা টুনটুনি-পাখি বাসা বানাচ্ছে
এবং খুব দ্রুত অ্যানিমেশনের সময়-বিক্ষেপের মধ্যেই
সে বাসাটা সম্পূর্ণ করলো , ডিম পারলো , ডিম
ফুটে বাচ্চাও বেরুলো , বাচ্চারা কী করে খাবার
চাইছে ক্রমাগত , আর বাবা ও মা দুই টুনটুনি
সমানে কোথা থেকে পোকা এনে -এনে খাওয়াচ্ছে তাদের। "
অতি সামান্য এবং সাধারণ এক দৃশ্য কীভাবে কবিতার উপাদান হয়ে ওঠে , এবং কবিতার ভাষ্য দেখলে মনে হবে কবি যেন অসাধারণ কথাগুলো বলে চলেছেন। টুনটুনি-পাখির বাসা বাঁধা , ডিম পাড়া এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া এবং বাচ্চাদের খাওয়ানো । এই সামান্য ঘটনায় যেন মনুষ্য জীবনের উপলব্ধি কাজ করছে। অতি তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে তার ভাষারূপ, এটাই তো উত্তর আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য।
দুটো কবিতাতেই বাক্যের বিন্যাস লক্ষণীয়। এক বাক্যের অসমাপ্ততা পরবর্তী বাক্যে গিয়ে পৌঁছেছে। নাসেরদার কবিতার এটিও একটি অন্যতম অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কবির চোখ যে ভিন্নতর কিছু পর্যবেক্ষণ করে এবং সেই পর্যবেক্ষণ থেকে নির্মাণ করে কবিতা , তা নাসেরদার মতো বোধ করি এত পারদর্শী কেউ নয় । তাঁর কবিতাকে পাঠক উত্তর আধুনিকতার মধ্যে রাখতে পারেন কবিতার লক্ষণ গুণাগুণ দেখে , আবার পাঠক কবিতা হিসেবেও উৎকৃষ্ট উপাদান বোধ পেয়ে যেতে পারেন। যেভাবে ইচ্ছা দেখা যেতে পারে। তাই নাসেরদার কবিতা দীক্ষিত এবং সাধারণ সব ধরনের পাঠকের কাছে সমাদৃত , বোধগম্য।
খুব কম পরিসরের মধ্যেই রাখলাম নাসেরদাকে নিয়ে কিছু লেখা। নাসেরদার প্রতিটা কবিতা থেকেই লেখা যেতে পারে অনেক কবিতা , in continuation or not , পাঠককে প্রলুব্ধ করতে পারে তাঁর কবিতা। নাসেরদার ফোনের সেই রিং টোন " আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে , এ জীবন পুণ্য করো " , যেন মনে হতো নাসেরদাই উচ্চারণ করছেন সেই সুর আর শব্দের মূর্চ্ছনা। তারপর সেই কণ্ঠস্বর , আফজল, বলো , কেমন আছো । আর শুনতে পাব না কোনো দিন। তাঁর কবিতা আমাদের কাছে রইল মনখারাপের সাথী আর মন ভালো হওয়ার প্রেক্ষিত । ভালো থাকুন নাসেরদা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন