স্মৃতিপাতায় - 
কবি নাসের হোসেন  

নিখিলকুমার সরকার

সেসময় ভেতরে বাহিরে অবিন্যস্ত আমি, দিগভ্রান্ত পথের আলোয় আমার অস্থির ছায়া। হাঁটছি...  আমি কি কারও সাক্ষাৎ পেতে চাইছি?  জানি না, নিজেকে ভুলেছি যে! হঠাৎই দেখি, আমার ভাঙাচোরা ছায়া অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে নাসের। 


নিখিলদা, কী হলো? আমি তো বিস্ময়ে রুদ্ধবাক! অনুভব করলাম,আমি যেন এই আনন্দময় সত্তার কাছেই পৌঁছোতে চাইছিলাম। মুখোমুখি নাসের আবারও --- কী হয়েছে বলো। বললাম, আমার অন্তর্লোকে ঝড় বয়ে যাওয়ার কথা, অবিচ্ছেদ্য ডালপালা ভেঙে যাওয়ার বিষাদ-আলেখ্য।

হাসিমুখ নাসের আমাকে নিয়ে গেল পথের পাশের নির্জনতায়। অগোছালো আমাকে অনিরুদ্ধ শব্দের মায়াবী রূপকথায় গোছগাছ করে দিয়ে বলল, বৃক্ষকে তো ঝড়ের মুখোমুখি হতেই হয়... সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করবে না... বিষাদ ভুলে কবিতামগ্ন থাকো, সব ক্ষত নিরাময় হয়ে যাবে... কবিতাপাক্ষিক -এ তোমার কবিতাটি খুব ভালো লাগল...  নাসেরের এমত হৃদমথিত নিবিড় স্পর্শে আত্মবিস্মৃত আমি নিজেকে ফিরে পেলাম। এমনই ছিল নাসেরের সঙ্গে  আমার সম্পর্ক। কেবল আমার সঙ্গে নয়, সবার সঙ্গেই তার  ' সম্পর্ক ' 

ছিল এমনই।   ছিল বলেই, আমরা সকলেই নাসের-মায়ায় আচ্ছন্ন ছিলাম। নাসের নেই যেমন চিরন্তন সত্য, নাসের আছে, তাও অমোঘ  সত্য। আমাদের যাপিত ভুবনডাঙায় তার বহুমাত্রায় উচ্চারিত যোগবন্দিশগুলি থেকে যাবে বহমান। 



কবি কেমনতর মানুষ --- ভাসমান এই কৌতূহলের ভেতর কবিদের দ্বৈতসত্তার ইঙ্গিত নিহিত। আর এই কৌতূহলী একসময় জেনে যায় , কবি নাসের হোসেন আর মানুষ নাসের হোসেন দ্বৈত নয়, অদ্বৈত সত্তার মূর্ত প্রতীক। তার জীবনচর্যায় কোথাও কোনও ভেদচিহ্নের অস্তিত্ব নেই, প্রবেশ নিষিদ্ধ কোনও আত্মপরিসর। তাঁর শরীরীভাষ্যে অথবা স্ফূর্ত উচ্চারণে রজ কিংবা তমোগুণের কোনও প্রতিভাস নেই। তবে রহস্যময়তা আছে। তার সেই রহস্যযাপনও ছিল অনিন্দ্য নান্দনিকতা-মথিত, তা যে জানে সে জানে। তার মনোজগৎ এক অনন্য দর্শন-এর লীলাভূমি। যে দর্শন-সঞ্জাত মুক্তচেতনা তাকে যেমন সবার থেকে আলাদা করেছে তেমনই একইভাবে সবার সঙ্গে যুক্ত করেছে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বপ্রাণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার চির-অভিপ্রায়ই ছিল তার কবিতার অভিমুখ এবং অস্তিত্বযাপনের সাধ ও

 সাধনা। আমি কবিতার মতো তার মগ্ন-উচ্চারণ শুনেছি --- " আমি  নবীন প্রজন্মের সবাইকে আমার আত্মজন মনে করি। অপত্যসম তাদের স্নেহ করি, ভালোবাসি, প্রশ্রয় দিই। তাদের প্রতি সর্বদা আমার শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ... তাহলে আমি তো বিবাহিতই... তাছাড়া সবসময় আমি বিবাহিতদের পক্ষেই 

থাকি  ... " এমত অচিন্তনীয় আত্মবীক্ষা তথা জীবনদর্শন যার সে  সবার আপনজন, আত্মীয় হয়ে উঠবে, সেটাই তো স্বাভাবিক । 


" একটি ছিদ্রিত মানুষের সঙ্গে দেখা হল --- তার সারা শরীরে ছিদ্র /মুখময় ছিদ্র, হাতে ছিদ্র --- কী বলব তবু তাকে বড়ো চেনা মনে হল /মনে হল একে আমি ভালোবাসি, জড়িয়ে ধরলাম আষ্টেপৃষ্ঠে /আর তারপর দেখি তার  গায়ে কোনও ছিদ্র নেই " --- এই হচ্ছে কবি নাসের হোসেন যে অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে প্রতিটি সম্পর্ক গড়ে তোলে। আবার কখনো কৃষ্ণগহ্বরের পাতালটানে নিমজ্জিতপ্রায় সম্পর্কগুলি  পরম মমতায় টেনে তুলে আনে জাদুবাস্তবতায় ---  

" কিন্তু আমাদের সন্তানরা কোথায়  --- রাহুল সুজাতা /অন্ধকার গহ্বর থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে আসছে তাদের /হাত পা মাথা, শিশুর অবয়ব /ওদের নিয়ে এবার পাড়ি দেব সুন্দর স্বাস্থ্যকর কোনো 

পৃথিবীতে  " / শেষ অবধি সেই সুন্দর পৃথিবীতেই তার মহাপ্রস্থান ঘটেছে। আমাদের জন্য রেখে গেছে তার সমূহ বৈভব। কীভাবে আপন হতে বাহির হয়ে সকল প্রাণের সঙ্গে মিলিত হত্যা হবে তার অলোকসামান্য দিশা। 


ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু নাসের হোসেনকে আমার চলার পথে সহপথিকরূপে পেয়েছিলাম। আনন্দ-বিষাদ, সমস্যা-সংকুল দিনাতিপাত, দ্বিধাদন্দ্ব-জর্জর কবিতাযাপন --- সব 

অবস্থাতেই নাসের আমার সঙ্গে একাত্ম থেকেছে  --- এ আমার জীবনে পরম প্রাপ্তি, রয়ে গেল স্মৃতিপাতায় । 


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন