নাসের হোসেন -এর সহজ কবিতা

রুদ্র কিংশুক

নাসের হোসেনের কবিতার বিপুল সম্ভার। তিনি প্রতিদিনের অনুভবকে কবিতার শরীরে ধারণ করেন।  তাঁর কবিতা যেন তাঁর যাপনের এক গূঢ় দিনলিপি।  প্রতিদিন আমাদের জীবনে কত দৃশ্যের জন্ম হয়, বোধের উদ্ভব হয়। এই ইথার তরঙ্গে তারা হারিয়েও যায়। কিন্তু নাসের হোসেন সেই মৌহূর্তিক অনুভব ও ভিজনগুলিকে কবিতায় ধরে রাখেন। জীবনের সঙ্গে তাঁর এক কাব্যিক বোঝাপড়া আছে, একটা সৌন্দর্যলোকের ডায়ালগ আছে। সে সবের প্রকাশই তাঁর কবিতা। জীবনকে তিনি সহজ আলোর অভীপ্সা-প্রবণ করে তুলতে চেয়েছেন। 

নাসের হোসেনের কবিতা সহজ। সহজের ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল তাঁর কবিতা। সহজ যথার্থ সরল অথবা জটিলের বিপরীত নয়। সহজের কোনো অর্থ নেই, কারণ সহজের অর্থ নিষ্কাশন করলে সহজ তার স্বধর্ম হারায়। স্ফটিক ভাঙলে স্বচ্ছতা হারায়, সহজকে ভাঙলে সহজ হারিয়ে যায়।  তাই সহজকে নিতে হয়, জীবনে ধারণ করতে হয় যাপনের স্বাভাবিকতায়। নাসের হোসেনের কবিতায় আছে এমনই সহজের ফুটে ওঠা, যেমন করে রক্তকরবীর ডাল রঞ্জিত হয়, আমের ডাল গন্ধমেদুর হয়ে ওঠে  বসন্তের উপস্থিতিতে।


কবির দেখা দ্রষ্টার দেখা। উদ্দালকের জল-মৃত্তিকা-শস্যঘ্রাণের অনুভব-ঋদ্ধ কবিতা, কবির উচ্চারণ।  একটি কবিতায় নাসের লিখছেন:

 

জল তো জলের ভিতর ডুবে থাকে,  জল কি জলেরও

গভীরে  যেতে চায়...।

কবি এখানে  নির্মাণ করেছেন এক অপূর্ব চিহ্নকল্প। 'চিহ্নকল্প' শব্দটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে চিত্রকল্প বা ইমেজারি-র পরিবর্ত হিসাবে।  গভীর  এবং বহুদিশা-র ইঙ্গিত বোঝাতেই এই নির্মাণ।  যে ঘটনা প্রতিদিন আমাদের চারদিকে ঘটছে,  তার দৃশ্যরূপ নাসের আমাদের দেখালেন সহজের ভঙ্গিমাহীন নতুনত্বে।


সহজের সাধনা গ্রহণক্ষম বোধের উদবর্তন। চেতনার সম্প্রসারণ এবং সম্প্রসারিত চেতনার দিকে অক্ষরের জায়মানতাকে উৎসাহিত করা। আরো একটি কবিতায় নাসের লিখছেন :


ছোট্ট বাঘ, তুমি চলো, আমি তোমার পাশে আছি

অরণ্যের ডালপালার মধ্য দিয়ে উঠে আসছে চাঁদ

আকাশ ভরে আছে আদিম সুষমায়, ছোট্ট বাঘ

তোমার নরম নরম থাবা ফেলে চলে এসো আমার সঙ্গে...

...স্নান সেরে ছোট্ট বাঘ এসো নাচি

আগুনের চারপাশে...। 


সহজের এই চর্যা চিন্তাচেতনার এক অভেদ পরিসর অনুসন্ধান ও উদযাপন।  হননোদ্যত পৃথিবীতে এই উদযাপন প্রকৃতভাবেই অভিনব অথচ প্রাকৃত। নাসের হোসেনের কবিতা এই অনুভবে পরিকীর্ণ হয়ে আছে।  'অরূপের বিমূর্ততার মধ্যে সুগভীর শূন্যতা'। কিন্তু এই শূন্যতা কিছুতেই নঞর্থক হাহাকার বা ভয়েড (void)  নয়। তাঁর কবিতার শূন্যতা আমাদের চালনা করে এক সম্মিলিত ও সামগ্রিক হয়ে ওঠার চেতনার দিকে।


নাসের হোসেন জীবন-দার্শনিক। তাঁর দর্শন জীবন নিরপেক্ষ নয়, আবার তাঁর জীবনচর্চা দার্শনিকতার আলোমন্ডিত। জীবনচর্চার এই প্রজ্ঞা খুব সহজভাবে  নাসের হোসেনের কবিতায়, যেমন জলের গভীরে জল। তাঁর দার্শনিকতা কবিতাকে ভারক্রান্ত করে না, যদিও   তা কবিতার ভারকেন্দ্রে থাকে। তাই তাঁর কবিতাপাঠে আমরা গুরুগম্ভীর এক দার্শনিককে পাই না, আমরা পাই এক জীবন-রসিককে যাঁর অবলোকনের আছে এক দার্শনিকের প্রজ্ঞা ও অনুসন্ধিৎসা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন