আমার নাসের

প্রশান্ত গুহমজুমদার

অজাতশত্রু শব্দটা সেই কবে ইতিহাসের পাতায় পড়েছি। সর্বংসহ বাংলা রচনা বইয়ে দেখেছি। কপিলাবাস্তুর শুদ্বোধনের উত্তরপ্রজন্মের স্মিতানন বুদ্ধ প্রসঙ্গে আমরা বারবার পড়েছি, দেখেছি সে অপূর্ব মুর্তি বহু ভাবে। বন্ধুবৎসল সুজন স্বজন শিল্পী স্রষ্টা, এমন বিশেষণে ভূষিত হতে দেখেছি প্রকৃত কোন মনুষ্যজন্মকে। আর আমি শ্লাঘা বোধ করতাম এই ভাবনায় যে, এই সবের মূর্ত রূপ আমারই প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে এই সামান্য জীবনে। সে আমার বহরমপুর তথা কলকাতার নাসের হোসেন।

সাহিত্যপ্রেমে এক বিরল তাপস, পরিশ্রমে অক্লান্ত, উপরন্তু সে ব্যতিক্রমী এক শিল্পী, এক গদ্যকার, সর্বোপরি উপলব্যথিত অথচ নিরন্তর সন্ধানী এক কবি, এ যাবৎ প্রকাশিত সমস্ত কবিতার বইয়ে যার কবিতার অভিমুখ পালটে যায় বারবার। এই নাসেরকে আজ ঠিক কোন জায়গায় রাখবো আমি! বিশেষত কোনভাবেই যখন নাসেরকে এই বিচিত্র জীবনে পাবো না আমি! কেউ জানে না। ওকে আমি অনুসরণ করতাম। নানান ভাবে। ওর কথ্যভঙ্গী, ওর বিদায় নেওয়ার সাবলীল চিহ্ন, ওর শ্রম, ওর অভ্যর্থনা আমি টুকে নিতে নিতাম একান্ত খাতায়। শিয়ালদায়ে অচৈতন্য হয়ে যাওয়ার পরেও অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করার অধিকার একমাত্র ওরই ছিল। প্রভাতদার ছাদবাগানের কবিতাপাঠের পরিকল্পনা অথবা পুষ্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে নাসেরের অবদান কতখানি, জানি না, প্রভাতদা জানেন। বৌদি জানেন। আমি কেবল এই অনন্য প্রাণটিকে অনুসরণ করতে করতে এই সব ভাবতে পারি। সে স্বাধীনতা রয়েছে আমার। 

ওই তো সেই চেয়ারটা। সামনে ছোট্ট একটা টেবিল। প্রায় সাদা মাথায় মগ্ন এক মানুষ। তিনি তখন অর্জুন মিশ্র। কবিতা পাক্ষিক-এর প্রতি সংখ্যায় শেষ আকর্ষণীয় সংযোজন। তিনি লিখছেন। মাঝেমধ্যে প্রভাতদা কিংবা বৌদির সঙ্গে দু চারটি প্রাসঙ্গিক অথবা ঘরোয়া কথা। শেষ যে আলোকচিত্র দেখেছিলাম, এই রূপই দেখেছিলাম নাসেরের। স্মৃতির পাতাসব আজ আর ফিরে দেখতে মন চাইছে না। 

চারপাশে বড় কুয়াশা। কিছু দৃশ্য, কিছু আর দেখা যায় না। বিখ্যাত পটলডাঙ্গার গলির সারমেয়সব গুটিয়ে সূর্যের আলোর অপেক্ষা করছে। পথে আর কেউ নেই। নেমে আসার বিরাম নেই। ঘন হচ্ছে। সাদা কুয়াশা। একজন, একমাত্র মানুষ, ছোট্টখাট্টো এক জ্যাকেট আর মাফলারে মানুষ, হেঁটে যাচ্ছেন, সাবলীল। আমাকে আলগা গলায় শুধু বললেন, ‘বাঁ দিকে সোজা গেলেই শিয়ালদা। পারবেন তো?’ শব্দগুলোয় শিশির জড়িয়ে গেল। স্পষ্ট দেখলাম। মাথা নাড়লাম। ‘আমি এবার বাস ধরবো। রোববার বহরমপুরে স্কোয়ার ফিল্ডে দেখা হবে।‘

হাঁটতে থাকলাম। একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, কুয়াশা ক্রমে ঢেকে দিচ্ছে মানুষটাকে। আমার নাসেরকে। আমার এক প্রিয়কে। আমিও ক্রমে কুয়াশাচ্ছন্ন। এখন আর আলো চাইছি না আমি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন