মানুষের কবি নাসের হোসেন

প্রভাত চৌধুরী

এইমাত্র কবিতানগর-এ নাসের হোসেন সম্পর্কিত একটি লেখা শেষ করলাম। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করলাম ভুবনডাঙা-র জন্য আরেকটি লেখা। এই বিরতিহীনভাবে একটি লেখা শেষ করেই অপর একটি লেখা শুরু করতে বাধ্য হলাম , এর জন্য আমি নাসেরকেই দায়ী করছি। ভেবেছিলাম আমার মৃত্যুর পর যাবতীয় দায়িত্ব থাকবে নাসের -এর। নাসের সেই কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত এটা আমি বিশ্বাস করতাম। এখনো বিশ্বাস করি। নাসের থাকলে আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারতাম।পরিবর্তে এ কী পরিহাস !

এই প্রথম নাসের আমার কথা অমান্য করল। আমাকে বসিয়ে রেখে নাসের কোথায় যে গেল সেই ঠিকানা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কোথায় পাওয়া যাবে নাসের -কে। জানি না বললে ভুল বলা হবে। বলতে হবে নাসের -এর সন্ধান পাওয়া যাবে নাসের -এর কবিতায় , গদ্যরচনায়, সংবাদপরিবেশনায়।


আমি কবি নাসের হোসেন -কে শিরোনামে চিহ্নিত করেছি : মানুষের কবি । এখন এই মানুষের কাছে পৌঁছবার জন্য কবিতাটির কাছে যেতে হবে।

পড়া যাক ' মানুষ , এই ' কবিতাটি :

' যাও , দেখা যাক কতদূর যেতে পার , মানুষের কাছে ফিরে আসতে হয়/ মানুষকেই , শুধু মানুষের কাছেই নয় ,আরো অনেক কিছুর কাছে / অনেক কিছু নিয়েই তো মানুষ , এই গাছপালা পাহাড় সমুদ্র/ বাড়িঘর, এই ছেলে-মেয়ে জমি-খামার অফিস-ব্যবসা,সবই মানুষের '

তার অর্থ হল , মানুষ কখনো বিচ্ছিন্ন কোনো প্রাণী নয়।যাবতীয়- র অংশ মাত্র। যাপনের অংশ মাত্র।

এই বোধ-ই নাসের-কে  অনন্য করে তুলেছে।


নাসের চেয়েছিল :

' আর এই অনেক কিছু বোঝার জন্য

 বেঁচে / থাকা দরকার দীর্ঘকাল, এবং চিরদিন, সুতরাং/ মৃত্যু নয়, শুধু মৃত্যু থাক আমাদের সচেতন করার /জন্য যে একটা সীমারেখা আছে জীবনের, তাই, / সমস্ত কাজ সেরে নিতে হবে সুচারুভাবে, ভালোবাসায় '

সমস্ত কাজ সরে ফেলা , এবং উল্লেখ্য সেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে সুচারুভাবে তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। সম্ভবত এটিই সর্বশেষ উদাহরণ।


নাসের-এর অসুস্থতার কথা আমরা সকলেই জানতাম। কিন্তু এই আমরা-র মধ্যে নাসের নেই , কারণ নাসের বিশ্বাস করত সে অসুস্থ নয়। আমাকে প্রতি মুহূর্তে চিন্তা করতে বারণ করত। বলত আমি সুস্থ হয়ে গেছি। ডাক্তারবাবু বলেছেন আমি এখন অনেকদিন বাইরে থাকতে পারব। এই ' বাইরে ' শব্দটির অর্থ হাসপাতালের বাইরে।

তো এই বাইরে থাকার মধ্যে পরপর দু-দিন কপা দপ্তরে এসেছিল প্রধানত দু-টি কারণে ।

প্রথম কারণ : কবিতাপাক্ষিকের জমা প্রুফ দেখা।

দ্বিতীয় কারণ : সে যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে এটা প্রমাণ করা। আর প্রমাণ করতে সক্ষম হলেই আমাকে চিন্তামুক্ত রাখা যাবে।

গত ডিসেম্বরের ৪ এবং ৫ , এই দুদিন পরপর এসেছিল। আগেও বলেছিলাম। আবার বললাম।

৫ ডিসেম্বর সব কাজ শেষ হবার পর হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি। আমি বললাম : কফিহাউসের চারপাশের জন্য কবিতা নিয়ে এসো পরদিন।

নাসের দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল : কাগজ দিন।

কাগজ দিলাম। নাসের লিখে দিল।

আমি কিন্তু কয়েকবার বলেছিলাম, তাড়াহুড়ো নেই। পরের দিন দিলেও হবে। 

আসলে নাসের চেয়েছিল আমি যেন চিন্তামুক্ত থাকি। 

এই দুনিয়াতে নাসের এবং আমি , মাত্র এই দু-জনের কবিতালেখার জন্য কোনো প্রস্তুতি লাগে না। এইটে প্রমাণ করা যে সুস্থতার জন্য জরুরি এটা নাসের মনে করেছিল সেদিন।

' সমস্ত কাজ সেরে নিতে হবে , সুচারুভাবে , ভালোবাসায় ' এই পঙ্ ক্তিটির মান্যতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে তৎপর ছিল নাসের।

স্কেচঃ-বিপ্লব দত্ত

আমার সম্পাদনায় ৫ এপ্রিল ২০১৮ প্রকাশিত হয়েছিল ' আমাদের নাসের হোসেন ' শীর্ষক পরিবার-তন্ত্রের বইটি।

বইটির উৎসর্গ-পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল :

 

আমি আমার চোখের উপরে বসিয়ে নিয়েছি

             আরো দুটি চোখ , পাথরের


এই পঙ্ ক্তিটি সংগ্রহ করেছিলাম নাসেরের কবিতা থেকেই।

এটি একটি স্বীকারোক্তি ,

এটি একটি আপ্তবাক্য , 

এই বাক্যটিকে এক অর্থে ঋষিবাক্যও বলা যেতে পারে। আবার একে প্রমাদশূন্য বাণী রূপে গ্রহণ করলাম আমি।

নাসেরের সৃষ্টির মধ্যে এই ধরনের বাণী কয়েক হাজার। আমি চেষ্টা করছি সেরকম কয়েকটি বাণী-কে ,ঋষিবাক্য বা আপ্তবাক্য-কে আপনাদের অবগতির জন্য পেশ করছি :

১ ॥ বৃক্ষের পাশে দাঁড়িয়ে আছে পা, চতুর্দিকে

      ঝরে যাচ্ছে বৃষ্টি , অবিশ্রাম ...

অবগুণ্ঠন ॥ অপারেশন থিয়েটার

২ ॥ ভালোবাসার মূল্যবোধ বোঝবার জন্য

                                            ঝুঁকে পড়ি

       সমুদ্রের গাঢ় নীল স্পর্শ করে আমায়

        কিছু সিগাল উড়ে যায়

কল্পনা ও অন্ধকার॥ ডানা 

৩ ॥ তোমার ক্ষুধার পাশেই সর্বক্ষণ অবস্থান করে আছে একজন ওভারকোট ----

ওভারকোট ॥ জামার ভুবন 

৪ ॥  চলো কৃষ্ণগহ্বরে একগোছা সাদা ফুল

                                        গুঁজে দিয়ে আসি

ফুলদানি॥ কৃষ্ণগহ্বর ॥ দ্বিতীয় পর্বের বিভাবকবিতা


যে ৪টি বাণী আমি উদ্ধৃত করলাম , সবগুলিই নাসেরের প্রথম দিকের লেখা। পুস্তকাকারে প্রকাশকাল জেনে রাখুন :

অপারেশন থিয়েটার ॥ জুলাই ১৯৯০

ডানা ॥ মার্চ ১৯৯৪

জামার ভুবন ॥  মে ১৯৯৪

কৃষ্ণগহ্বর ॥ জানুয়ারি ১৯৯৫


মাত্র চারটি বই , তাও প্রথমদিকের , একটি করে লাইন  দিয়ে কোনো কবিকে চেনানো যায় না।

যাঁরা নাসের-কে চেনেন না। যাঁদের কাছে নাসের অপরিচিত। তাঁরা পড়তে থাকুন এই মহান কবির কবিতা গ্রন্থগুলি তাহলেই অন্তত কবির কিছুটা সান্নিধ্য পেতে পারেন... 


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন