রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়

পর্ব-৪

সংযুক্তা পাল 

সুধীন্দ্রনাথ কাব্যে 'হায় গর্বান্বিতা' বলে যে নারীকে সম্বোধন করেন অধরা, দুর্লভ সে নারী কবির কাছে দেবীর ন্যায় অথচ তার মানবী অস্তিত্ব কবির কাছে আকাঙ্ক্ষিত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তন্বী'তে 'মানবী' কবিতার সূত্র ধরেই এই পর্যালোচনার ভিতর প্রবেশ করা যায়।


'দেবী ভেবেছিনু আমি যে তোমারে,/না-ও যদি তুমি দেবতা হও,/মানবী হয়েই থাকো চিরকাল,/প্রণয়িনী হয়ে হৃদয়ে রও।আজি যদি দেখি তব পদমূলে /ভক্তি-অশ্রু-নিষিক্ত ফুলে/পূজিতে না পারি, তবুও তুমি তো/আমার হেলাল যোগ্য নও।/বেদি ছেড়ে আজ নেমে এসো বুকে,/পূজা ছেড়ে আজ প্রণয় লও।।'('মানবী'/তন্বী)


রাবীন্দ্রিক প্রেমাদর্শের ন্যায় সুধীন্দ্রনাথের প্রেমও সেই ভাবনায় দীক্ষিত হলেও খানিকটা স্বতন্ত্র ধারায় তিনি 'পূজা' কেই সরাসরি 'প্রেম' বললেন না বরং আকাঙ্ক্ষিত নারীকে পূজার পরিবর্তে প্রেম গ্রহণের দাবি জানালেন।এ নারীকে লাভ যেন স্বর্গ জয়ের অধিকার–'আমার উদ্বেল মর্মে ভরে দেয় স্বর্গবিজিগীষা?' আদিমতার অন্ধকারে মানুষ যা কামনা করে এ নারীর কাছে কবি তা চাননি, বরং চেয়েছেন অমৃত-ভালোবাসা।


'প্রাক্তন তিমিরে করে অহরহ যার অন্বেষণ,/তুমি সে-স্বৈরিণী নও,হে দাক্ষিণ্যময়ী।।/অমৃতের উদাত্ত মাভৈ/নিবিদ আহ্বানে যার প্রতিধ্বনি তোলে অবিরত,'('কস্মৈ দেবায়'/অর্কেস্ট্রা)

সুধীন্দ্রনাথ নিজেই একাধিকবার রবীন্দ্রঋণ স্বীকার করেছেন তাঁর সৃষ্টির ক্ষেত্রে। তাঁর নারীও রাবীন্দ্রিক নারীদের মতই অধরা জগতের বাসিনী-

'জনমে জনমে,মরণে মরণে,

মনে হয় যেন তোমারে চিনি।

ও শরমার্ত অরূপ আনন্দ

দেখেছি কোথায়,হে 

                            বিদেশিনী?'

এই পঙক্তি যেন মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গান 'আমি চিনিগো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী'

এক অখন্ড আত্মোপলব্ধি বা আত্মবোধের কারণেই তিনি নিজের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন 'আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল,আলোর দিকে উঠছি;'

অথচ এই আত্মবোধের ওপর নির্ভর করেই অন্ধকার থেকে বিশুদ্ধ চৈতন্যকে আলোর দিকে নিয়ে যাবার প্রত্যয়ে সুধীন্দ্রনাথের নারীচেতনাতেও মিশে আছে তাঁর নিজস্ব প্রাতিস্বিকতা,অনিত্যতার দর্শনবোধ–

'নিমেষের আত্মবোধ,নিমেষের অধৈর্য অবল,/অখন্ড-নির্বাণ ভরা রমনীর তড়িৎ চুম্বন।।'('হৈমন্তী')

অভিজ্ঞতা যখন প্রেরণা হয়ে ওঠে তখনই কবি রমনীর চুম্বনেও আবিস্কার করেন নির্বাণের মন্ত্র। কিন্তু বারবার এই অখন্ডতাকে,এই অধরা ব্যাপ্তিকে ধরতে চেয়েছেন; নারী,প্রেম তথা জীবনের সামগ্রিকতাকে মিলিয়েছেন একসাথে কিন্তু তাকে অধরা করে রেখে দিতে চাননি। আয়ত্তে আনতে চাওয়া অথচ আয়ত্তে না আসা এই তীব্র দ্বান্দ্বিকতার যন্ত্রণার চিহ্ন তাঁর কবিতাগুলিতে বহমান, তাঁর প্রেম তথা নারী ভাবনাও এই যন্ত্রণার দ্বারা পুষ্ট।

'কোনও দিন পারিবে না অর্গলিতে সে- স্বর্গের দ্বার,/ইন্দ্রত্বের ধ্রুব অধিকার/তোমার প্রেমের স্মৃতি রচিয়াছি মোর লাগি যেথা,/অয়ি মহাশ্বেতা।।'('মহাশ্বেতা')


তাঁর সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্য এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করব।

"তাঁর বিষয়ে অনেকেই বলে থাকেন যে তিনি বাংলা কবিতায় 'ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক'।এই কথার প্রতিবাদ ক'রে আমি এই মুহূর্তেই বলতে চাই যে সুধীন্দ্রনাথ মর্মে-মর্মে রোমান্টিক কবি, এবং একজন শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক।এর প্রমাণস্বরূপ আমি দুটিমাত্র বিষয় উল্লেখ করবো:প্রথমত, তাঁর প্রেমের কবিতায় আবেগের তীব্রতা,বাসনা ও বেদনার অলজ্জিত ও ব্যক্তিগত চীৎকার–যার তুলনা আবহমান বাংলা সাহিত্যে আমরা খুঁজে পাবোনা,না বৈষ্ণব কবিতায়,না রবীন্দ্রনাথে,না তাঁর সমকালীন কোনো কবিতে। দ্বিতীয়ত, ভগবানের অভাবে তাঁর যন্ত্রণাবোধ –এটিও একটি খাঁটি রোমান্টিক লক্ষণ। তিনি ভগবানের অভাব কবিতা দিয়ে মেটাতে চাননি, জনগণ বা ইতিহাস দিয়েও না:তাই, তিনি নিজেকে জড়বাদী ব'লে থাকলেও,তাঁর কবিতা আমাদের ব'লে দেয় যে তাঁর তৃষ্ণা ছিলো সেই সনাতন অমৃতেরই জন্য।"

বলা বাহুল্য অমৃতের প্রতি তাঁর এই তৃষ্ণা নারীর প্রতিও অভিব্যক্ত হয়েছে।

কবি তাঁর কল্পনার বা স্বপ্নের প্রেয়সীকে একাধিক নামে সম্বোধন করেছেন 'অর্কেস্ট্রা' কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও স্বর্গের প্রসঙ্গ এসেছে; স্বর্গ বলতে মর্ত্যের মানুষের কাছে এমন এক অমরাবতী বোঝায় যার রূপ-রস-লাবণ্য-মাধুরী এমনকি সাহচর্য সবই অধরা,সেই স্বর্গেই যার বাস এমন দেবী রূপ মানবী কবির আকাঙ্ক্ষায় অনিমেষ রূপে পর্যবসিত।তাই তিনি বলছেন–


'ক্ষমা? ক্ষমা?কেন চাও ক্ষমা?/নিরুপমা,/আমি তো তোমার ' পরে করিনি নির্মাণ/অভ্রভেদী স্বর্গের সোপান;/স্থাপিনি অটল আস্থা বিদায়ের দিব্য অঙ্গীকারে;/ভাবিনি তোমারে,/নিষ্ঠার প্রস্তরমূর্তি, অমানুষ, স্থবির, নিষ্প্রাণ;/ভুলিনি তো তুমি মুগ্ধ নিমেষের দান।।'('মার্জনা')

কবির কল্পলোকের এই নারী কোথাও সেই eternal truth বা অখন্ড জীবনবোধের এক সামগ্রিক সত্যস্বরূপ। তাই তাঁর নারীভাবনার যাবতীয় পার্সপেক্টিভ এসে কেন্দ্রীভূত হয় 'শাশ্বতী' নামক কবিতায়। শাশ্বত <শাশ্বতী এই 'নাম' যেন কবির ভেতরের অনশ্বরতার সেই ইতিবাচক বোধকে খুঁড়ে আনে; নাস্তিবাদী, ক্ষণবাদী অস্তিত্বে বিশ্বাসী এমন ধারণা সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিশেষিত হলেও বহুক্ষেত্রেই অনিত্যতা, অনশ্বরতার খন্ড খন্ড অভিজ্ঞতার উপাদানে গড়ে ওঠা এক অখন্ড প্রেরণার কথাই তিনি স্বীকার করেছেন।

            এতক্ষণ ধরে সুধীন্দ্রনাথের নারীচেতনা প্রসঙ্গে যে রূপকল্প বা ভাবকল্প নির্মিত হয়েছে 'শাশ্বতী' তে এসেও সেই 'অমরাবতী', 'অধরা' এই অনুষঙ্গগুলো পাচ্ছি–

'মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ'রে;/একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা/প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।।'('শাশ্বতী')

এবং প্রকৃত প্রেম যে সত্তার মহত্তর প্রকাশ তাই তা সীমাবদ্ধ নয়, জাগতিক ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়া কিংবা লেন-দেনের হিসেবে নারীকেও তিনি এতটা তুচ্ছ করে দেখেননি। ভালোবাসার নারীর প্রতি তাঁর অনুভূতিও শাশ্বত।তাই তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি –

' কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।/স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে/আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা:/সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে/আমি ভুলিব না,আমি কভু ভুলিব না।।'('শাশ্বতী')

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন