ফালগুনী রায় : বাংলা কবিতার কিংবদন্তিপুরুষ

সুবিমল বসাক লিখিত

ফালগুনী রায় । সে হতে চেয়েছিল ফালগুনী রায় । কবি ফালগুনী রায় । নিজের আইডেনটিটিকে জোরদার করার প্রথম ধাপ: নাম। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর এই পৃথিবীর ধুলো, রোদ, বৃষ্টি, বায়ু-দূষণময় এই জগতে নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে ছিল সে । মৃত্যু ৩১ মে ১৯৮১। পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচে থাকা বাস্তবিকই কঠিন। জীবিত থাকলে ফালগুনীর বয়স আমাদের সমান হতো। হয়তো রেখে যেত আরো কিছু কবিতা/গদ্য/প্রবন্ধ । হয়তো এই কারণে যে পরবর্তী সময়ে মেধা ও অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতা-জাত বোধ তাকে কোথায় ঠেলে নিয়ে যেত জানা নেই। কবি হিসাবে তার পরিণতি, মৃত্যু সময়াবধি, যা দেখেছি, অস্বাভাবিক ছিল না । শহিদ নয়; আত্মহনন ছিল তার অভীপ্সা।

জেব্রা দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রথম কবিতা প্রকাশের কালানুক্রমে, তার কবি জীবন মাত্র ১৩ বছর। এই ১৩ বছরে সে রেখে গেছে কিছু কবিতা, চিত্রনাট্য, গল্প, সমালোচনা --- যা থেকে বাছাই করে প্রকাশ করা হয়েছিল নষ্ট আত্মার টেলিভিসন , বাসুদেব দাশগুপ্তের প্রকাশনায় --- ছোট, সাজসজ্জাহীন, আটপৌরে, ১৬ পৃষ্ঠা, হাফ ক্রাউনে, চটি --- এই কবিতা-পুস্তক। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৩ সনে প্রকাশিত ।




১৯৬৪-৬৫এর ভয়ঙ্কর অবস্হায়। হাংরি জেনারেশানের মামলা কোর্টে --- কেসের ডেট, অ্যডজোর্ন, অ্যাপিল, হীয়ারিং, সাক্ষি-ফরিয়াদি, দালাল-ফড়ে, পুলিশ-ফেউ, উকিল-পেঙ্গুইন, সোয়াল-জবাব, কাঠগড়া-আসামী-সরকারপক্ষ --- এসব মুদ্রার এক পিঠ; অপর পিঠে সাহিত্যিক ও সাহিত্য-নির্ণায়কদের ভ্রুকুটি, তৎপরতা, খুরপি হাতে সমূলে উপড়ে ফেলার সদিচ্ছা। আমরা তখন দিন-রাত ধিকৃত ও নিন্দিত। উপহাস, অবহেলা, উপেক্ষা, ব্যঙ্গোক্তি, অপমান, কটুক্তির কালো পালক আমাদের মাথায় গজিয়ে উঠছে। এইরকম অবস্হায় , প্রতিকূল পরিবেশ, তেল বা ঘামের ব্যবহার ছাড়া, হঠাৎ বল্গাহীন, উন্মত্ত, মেঘকৃষ্ণ আকাশের তলে, বেমক্কা ফসফরাসের মত জ্বলে উঠেছিল জেব্রা। মলয় আর আমি গোপনে ছাপিয়ে আনতাম  বহরমপুর থেকে, এই কারণে যে, কলকাতার প্রেসে-প্রেসে টাউটদের উঁকি-ঝুঁকি ও ভ্রুকুটি বেড়ে গিয়েছিল। জেব্রা প্রথম সংখ্যা বার হবার পর, একদিন, তখন বিকেল, ফালগুনী এসে হাজির আমার আস্তানায় যেহেতু যোগাযোগের ঠিকানা ঐ । আস্তানা বলতে ১০ বাই ১০ চৌকো ঘর, দোকান বাইরের দিকে বলে, প্রবেশ-প্রস্হানের সুবিধে ছিল বাধাহীন --- যা ছিল আমার জ্যাঠামশায়ের ।রাতের আশ্রয় ব্যতীত অন্য সব দরকারি-অপ্রয়োজনীয় সারতে হতো বাইরে ।



ফালগুনী ১৯, শীর্ণ, মাঝখানে সিঁথি-কাটা ঘন কেশ , ভাঙা গাল, গাল জুড়ে ঘন শ্মশ্রু, উপচে বেরুনো কন্ঠা, কোর্স ধুতি এবং গলাবন্ধ লম্বা কালো মিস-ফিট গরম কোট । কোটটি, নিঃসন্দেহে ফালগুনীর নিজস্ব নয়, অন্তত কোটটির ঝুল ও ব্রেস্ট-সাইজ দেখে তর্ক করার অবসর ছিল না।  পুরানো ও ব্যবহৃত, নিশ্চিত তার দাদার বা কারোর । প্রথম দর্শনে যা বিদ্ধ করেছিল, ভয়ঙ্কর, তা হলো ফালগুনীর চক্ষুদ্বয়। বস্তুত তা ছিল আয়ত --- উজ্জ্বল ও ভাষাময়, আমর্ম আবেগচঞ্চল করে তোলার মত প্রাণবন্ত, একগাদা স্বপ্নের প্রতিফলন । সবে সে প্রেম পেতে শুরু করেছিল, তারি ছটা ছিল মুখশ্রীতে, দৃষ্টিতে, হাবভাবে, চাল-চলনে । পরবর্তীকালে, ফালগুনী দাড়ি বাদ দিয়েছিল, চুলের সিঁথি পরিবর্তিত হয়েছিল, আরও পরে, চোখের দৃষ্টিও হয়েছিল পোড়খাওয়া । প্রেম সাফল্য অর্জন করেনি, ব্যর্থতা ঘিরে ধরেছিল, সাময়িক । সেই প্রেমিকা, গ্রহণ করেছিল এমন একজনকে, যার পটভূমি ছিল সুখী জীবন । অর্থাৎ আমৃত্যু নিরাপত্তা, প্রচুর অর্থ, স্বচ্ছলতা, বিলাস, জীবন উপভোগের আরো, আরও অনেক উপকরণ। ফালগুনীর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না কোনোটাই, একমাত্র পূর্বপুরুষদের আভিজাত্য, বংশমর্যাদা ছাড়া।নারীর রহস্যময়তা ও ব্যবহার, ফালগুনীকে একেবারে ধ্বস্ত করে ফেলেছিল।শুরু হয় নিজের মধ্যে খেলা, আইডেনটিটির উন্মোচন, নেশা, গাঁজা, ভাঙ । পরবর্তীকালে নেশা করাটা ফালগুনীর রক্তে মিশে গিয়েছিল । নিজের 'ইগো' ঝালিয়ে নেবার জন্য, ইমোশানকে সতেজ করার জন্য, নেশা একান্ত প্রয়োজন, ফালগুনীর এইরূপ বিশ্বাস ছিল।


জেব্রা প্রথম সংখ্যা এবং হাংরি জেনারেশানের লিফলেটগুলি ফালগুনীকে টেনে এনেছিল আমার কাছে । মনে পড়ে, সেদিন ফালগুনীকে নিয়ে শেয়ালদা স্টেশানে বসে অনেকক্ষণ গল্প করি । ফালগুনী সদ্য পাঠ-সমাপ্ত কবিতার গোছা থেকে একটি কবিতা দেয়, মাত্র একটি। জেব্রা দ্বিতীয় সংখ্যার প্রস্তুতি চলছিল, এবং ঐ কবিতা ছাপা হয়। পরে আমাদের অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে । ফালগুনীর অন্য কোনো পত্রিকার প্রয়োজন পড়েনি। হাংরি বা হাংরি মনোভাবাপন্ন পত্রিকায় তার কবিতা, চিত্রনাট্য, রিভিউ বেরিয়েছিল। গল্প-কবিতা, কৃত্তিবাস-এও ২/১টা।



ফালগুনীর দাদা তুষার রায়, কবি হিসাবে ছিলেন তখন প্রচারিত । তুষারের ঘোরাফেরা ছিল পঞ্চাশের কবিদের মাঝে, কৃত্তিবাস, দেশ-আনন্দবাজার, কবি-লেখকদের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল, ফলে প্রশ্রয় ও তোল্লাই দুটোই পেয়েছিলেন অপর্যাপ্ত। ফালগুনী ও তুষারের মাঝে চরিত্রগত ব্যবধান ছিল পাতাল-আকাশ, দুজনেই নেশা-প্রিয়, নেশার পর তুষার হয়ে উঠতেন এক্সট্রোভার্ট; ফালগুনী যেত নিজের খোলসে সেঁধিয়ে। এমনিতে স্বল্পবাক সে, প্রথম সারিতে হুড়মুড় করে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ছিল না বা গলা উঁচু করে চ্যাঁচানো । আকন্ঠ মদ গিলেও মাতলামো ছিল না । বস্তুত সে ছিল প্রাসাদ-প্রতিম অভিমানী; অবহেলা অবজ্ঞা সে হজম করে নিয়েছে নিরবে, কখনও বা তাকে গ্রাস করেছে সাময়িক বিষণ্ণতা। তখন সে একা, নিঃসঙ্গ, মৌনগভীর।



তুষার ফালগুনীকে সহ্য করতে পারতেন না । পটভূমি অজ্ঞাত । আপাত দৃশ্যে পারিবারিক হিসেবনিকেশ থাকতেও পারে । একবার আমি আর ফালগুনী কফিহাউস থেকে বেরিয়ে নিচে ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়েছি, উল্টোদিকের ফুটপাতে তুষার । হঠাৎ সিটি মারার শব্দ; তুষার ছুটে এসে ফালগুনীকে -- "কে সিটি মেরেছে ? অ্যাঁ? কে সিটি মেরেছে?" ওঁর ওই মারকুটে মুখ দেখে ফালগুনী চুপ, আমিই বললুম অগত্যা -- "জানি না। ওদিকে হয়তো বা"। "ও, হ্যাঁ।" তুষার ফিরে যান। এ-ধরণের অযথা, অনাবশ্যক, নানান ব্যাপারে ফালগুনীকে হেনস্হা হতে হতো । ফালগুনী ও তুষারের কাব্যভাবনা আলাদা ছিল । যদিও নেশা, যথেচ্ছাচার দুজনকেই মৃত্যুর দিকে নিয়ে গিয়েছিল । প্রেম, ভালোবাসা, অভিলাষ ও আকাঙ্খার প্রতি অক্ষমতা, যা ফালগুনীর কবিতায় হাহাকার তুলত, যা মূলত অপুরণের অক্ষমতা -- দ্বিধা ছিল কতদূর নিয়ে যাবে তাকে । ফালগুনী তখন কবিতা নির্মাণের ব্যাপারে সিরিয়াস। পরবর্তী সময়ে নেশা এবং অসুখ তাকে বিছানাশায়ী করে ফ্যালে । এই সব ছাপিয়ে কবিতা নির্মাণের ব্যাপারটা সে, বলাবাহুল্য, অবহেলা করে গেল একরকম। ব্যক্তিগত সুখ ও তৃপ্তির অভাব তাকে চাতালহীন ধরার ওপর নাচিয়ে ছেড়েছে; যন্ত্রের, ভোগহীনতার দুঃখ, নিজেকে পাপ-পূণ্যের দাঁড়িপাল্লায় তোলা, অপাংক্তেয় ও ফালতু ভাবা।



মুদ্রার অপর পিঠ আড়াল করে রাখা হয়।সুজলাং সুফলাং মলয়জ শিতলাং-- অথচ এই কলকাতার বাস্তব রাস্তায় রেশন ও কেরোসিনের জন্য দীর্ঘ লাইন, ফুটপাথে হাজার-হাজার পাথুরে বিছানা, রেল-লাইনের ধারে-ধারে ঝুপড়ি ও চুল্লুর ঠেক, স্পল্যানেডে সন্ধের সময় দালাল ও ছিনতাইবাজ, হাইরাইজ বিল্ডিঙের গোপন কক্ষে মৌ-মক্ষিকার চাক-জমাট মধু, প্রকাশ্য দিবালোকে খুন ও বোমাবাজি, বিজ্ঞানসন্মত রিগিং, ঘুষ ও কালোবাজারি, বধুমাতা ও যৌনকর্মীর সদৃশ আচার, ভিখিরির মিছিল ও চাঁদা আদায়কারী -- রেশানালিজম ও রোমান্টিসিজম, বহুদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বাংলা সাহিত্যকে । এইসব আচ্ছন্নতা, চটচটে ব্যাপার গোড়ালি থেকে তুলে ফেলার কৃতিত্ব ফালগুনীর। ভাষা এবং তেজ বাদ দিয়ে পোস্টমডার্ন সাহিত্য হয় না।


ফালগুনীর কোনো হাতঘড়ি ছিল না, রোদ-চশমা ছিল না, আংটি ছিল না -- সব সে বিক্রি করে দিত, অবলীলায়। তারপর মদ -- নেশা। সাফাইযোগ্য জিনিসপত্তর বাড়ি থেকে হাতে করে নিয়ে আসত, শেয়ালদা সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটে হাতবদল হয়ে যেত। তার নিজস্ব কোনো বই ছিল না । জেব্রা দ্বিতীয় সংখ্যা সবে বেরিয়েছে, ফালগুনী প্রস্তাব দিল সেলিব্রেট করার, পকেট সংক্ষিপ্ত টের পেয়ে জেব্রার কপি নিয়ে মেট্রো সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি । মৃনাল সেনের ফিল্ম শেষ, আমাদের হকারি শুরু । জেব্রা বিক্রি করে দারুন সেলিব্রেট করেছিলুম।


ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রগতি কিছুই আর পৃথিবীকে বদলাতে পারেনি বিশেষ, ঘুরে-ঘুরে মানুষের জিভ বদলানো ছাড়া আর কিছু বদলায়নি। মৈত্রী, শান্তি, আদর্শ , সদভাবনা, সদাচার -- এই সকল বড়-বড় বুকনি মানুষকে, মানব সমাজকে, পাথর করতে সাহাজ্য করেছে। ভুল জীবন, ভুল সংঘাত, ভুল ধারণা, ভুল পরিণতি। অনেকের ধারণা ইতিহাস মানে প্রগতি । ওটা ভুল। একটা সভ্যতা জন্মায়, বড় হয়, পালটায়। সংস্কৃতি বলতে বোঝায় এই মুহূর্তের ব্যাপার, এখনকার। সংস্কৃতি ফুলের মত, নিজের ইচ্ছাতেই বাড়ে এবং ঝরে যায়। সংস্কৃতি মরে গেলে তা সভ্যতা হয়ে যায়। সভ্যতা মানে শৃঙ্খলা । সভ্যতা কৃত্রিম। কিন্তু সংস্কৃতি কৃত্রিম নয়।ধর্ম মানে মৃত্যুবোধ।


আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিস্টান, আমি পার্সি এরকম ধারণা ভুল। আমি সমস্ত ধর্মেরই লোক। যেহেতু আমি একটা সম্প্রদায়ে জন্মেছি, তাই সেই সম্প্রদায়ের মৃত্যুবোধের ওপর নির্ভর করে আমার নিজস্ব জীবনদর্শন। পরম্পরা মানে অতীতের গুণগুলোকে কেবল গুরুত্ব দিয়ে যাব তাতো ঠিক নয়, অতীত গুণকীর্তন করে বেঁচে থাকলে ডায়নোসরের মত লুপ্ত হয়ে যেতে হবে।কবি বা সাহিত্যিক ভবিষ্যৎবক্তা, দ্রষ্টা, ভিশনারি । নিজের চেতনাই প্রত্যেকের কাছে চূড়ান্ত ও ধ্রুব । স্ব-চেতনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যেই মাদকের ব্যবহার, বলতেন ফালগুনী।


ফালগুনীর কবিতা-প্রকাশ শুরু ষাট দশকের প্রথমার্ধে । সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল সক্রিয়। যদিও সে পরিচিতি লাভ করে সত্তর দশকে, কারণ এই সময়ে সে খুঁজে পেয়েছে তার হাত-পা রাখার জায়গা। তার সমসাময়িক কবিরা যখন গাদাগাদি কবিতা নিয়ে ঝুলন্ত বাসের হাতলে, ফালগুনী তখন রাস্তার একধারে, ধুলো-ওড়া গাছতলায় দাঁড়িয়ে।সমকালীন কবিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, চোখে পড়ার মত আলাদা, হুড়মুড়ে প্রবাহ থেকে পেছনে। তার কবিতার মনোভূমি, জীবনদর্শণ, চেতনা, উপলব্ধি, উপস্হাপনা, স্বাতন্ত্র্যে ঝকঝকে।


নিজেকে সে অশিক্ষিত মনে করত, বোদা, এই কারণে যে, চুরির সপক্ষে যে যুক্তি খাড়া করতে পারে সেই এলেম ওর ছিল না। দৈনন্দিন ও জাগতিক জীবনের, জীবন সংক্রান্ত উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা, অনুভুতি, সর করায়ত্ত করেছিল, এবং তা থেকে পাওয়া শিক্ষাই সে চুড়ান্ত মনে করত, এবং সে-প্রাপ্তিই ছিল তার আত্মপ্রকাশের সিংদরোজা । জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে এসেছে কবিতা, জীবনেরই ফসল -- জীবনের মত অপরিবর্তনীয় । আমাদের সঙ্গে মেলা-মেশা, দিবারাত্রি, কলকাতার ভিড়পথ, নির্জন রাস্তা পরিক্রমা, বিভিন্ন লোকেদের বাকচাতুর্য, ভুল ধারণা, গ্রন্থ থেকে উঠে-আসা আক্রমণাত্মক কোনও ধারণা -- এসব সাহায্য করেছিল তাকে নিজস্ব , একেবারে নিজস্ব, ভাষাজগত এবং ভাষাপৃথিবী সৃষ্টি করার; লক্ষণীয়, কবিতায় তার নিজস্ব উপলব্ধি । নেই কোনও ভাবাবেগ, বা ছিলছিলে রোমান্টিকতা, বা নিসর্গের আকাশবাণী, এবং আমরা পাই পোস্টমডার্ন, ক্রুর, খসখসে, নির্মম, লেপাপোছা, উবড়ো-খাবড়া, কাঁটাতার, নুড়িবালি ছড়ানো-ছিটানো। যদিও, অভিজ্ঞতার এলাকা ব্যাপক ছিল না , সীমাবদ্ধ, বাঁধাধরা গন্ডীর মধ্যে বাস্তবতার ঘেরাটোপে, অথচ কী অমোঘ ! তার জীবনে প্রেম-প্রেমহীনতা, সাফল্য-ব্যর্থতা, ক্রোধ-আকাঙ্খা, উথ্থান-পতন, আন্তরিকতা-দুৎকার, হাহাকার- উচ্ছলতা, সন্দেহ-বিশ্বাস, সুস্হতা-অসুস্হতা, দুঃখ-আনন্দ, বিষণ্ণতা-সুখ, উপদেশ-গালাগাল, শিষ্টতা-আভদ্রতা, শ্লীলতা-অশ্লীলতা, সহজ-জটিল সব কিছু সে আগাপাশতলা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছে, তুলে ধরেছে নিক্তির কাঁটায় । 


আভিজাত্য ব্যাপারটা ফালগুনীর একেবারেই ছিল না, অথচ থাকার কথা তারই।হামরা হাংরি আন্দোলনে অধিকাংশ উঠে এসেছিলাম নিচের তলা থেকে । অভিজাত শব্দোচ্চারণ যা আমাদের দৃষ্টিপথে এসে দাঁড়ায়, তার সঙ্গে সম্যক পরিচয় আমাদের অনেকেরই ছিল না। আত্মীয়-স্বজনদের নামোল্লেখ করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করার মত কিছু ছিল না। আমরা নগর-শহরের বাসিন্দা ছিলাম না। আমাদের মুখ থাকত কাঁচুমাচু, কফিহাউসের টেবিলে বিদেশি লেখক-কবিদের নাম শুনে আমরা থৈ-হারা হয়ে পড়তাম। আমাদের পকেটে রুমাল ছিল না, চুলে কখনও বা সরষের তেল, শার্টের তলায় ছিন্ন নোংরা গেঞ্জি, ঠোঙায় মুড়ি-তেলেভাজা চিবোতে-চিবোতে ফুটপাথ ধরে হাঁটতাম, পিরিচে চা ঢেলে সুরুৎ-সুরুৎ শব্দে পান, ভিটামিনের অভাবে ঠোঁটে খড়ি, টিউশানিতে চা-বিস্কুটের প্রত্যাশা, খুঁটি নেই, সুপারিশ নেই, প্রেম করার আর্টও রপ্ত করিনি।


ফালগুনীর ছিল বনেদি ব্যাকগ্রাউন্ড। অথচ আর্থিক অবনতি তাকে ঠেলে নামিয়ে দিয়েছিল একেবারে সাধারণ পর্যায়ে। অবলীলায়, অতি সাবলীল, স্বচ্ছন্দে সে সব কিছুকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এই যে ধ্বংসের প্রকোপ -- তার জানা ছিল পরিণতি । এই ধ্বংসের পরিণামে সহজেই সে টের পেয়েছিল গোপন সূত্র -- যে সূত্র তাকে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছিল। রাস্তায় সহজভাবে সে রিকশওয়ালার কাছ থেকে খৈনি চেয়ে ঠোঁটে গুঁজে নিত, দেশি মদের টেবিলে পাশে-বসা শ্রমিকের ঠোঙা থেকে ভেজা ছোলা-আদা তুলে নিতে তার কোনো দ্বিধা বা সংকোচ ছিল না। সচেতন ছিল বলেই সে মিথ্যা ভড়ং বা ভুল অহমিকা থেকে সরে এসেছিল।


স্নান না করে অনায়াসে দিন কেটে যায় দেখে সে স্নান করেনি কতদিন। যে বর্ধিত নখে রমণীকুলের পালিশ ঝকঝকিয়ে ওঠে, ফালগুনীর বাধাহীন সেই নখ বাড়তে দিয়েছে হাতে-পায়ে, ময়লা জমেছে নখে, কানের গর্তে, গলার ত্রিবলিতে, ঘাড়ে, কন্ঠায়, কনুইয়ে, চামউকুন লেপ্টে থাকেছে -- কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। চুলে তেল পড়েনি, রুক্ষ, শন, দশ বা পাঁচ আঙুলের চিরুনিদাঁড়া কিছুটা এলোমেলো বিন্যস্ত করে ; দাঁত মাজেনি কতদিন, পিচুটি দেখা গেছে কতদিন -- এই নয় যে এসব ব্যবহার তার ইচ্ছাকৃত -- কবি হতে হবে বলে এই সব, যেমন কফিহাউসে কবিদের কন্ঠস্বরের পরিবর্তন, অস্বাভাবিক বলার ভঙ্গিমা, কাব্যপাঠের স্বরপ্রক্ষেপ, ছুঁচালো ও সরু ঠোঁটের ব্যবহার, চোখের চাউনি, পালিশ চকচকে মুখ, এনামেল দাঁতের হাসি, সিগারেটে ঠোঁটের বিচিত্র স্টাইল -- এসব ফালগুনীর ছিল না। শরীর চর্চা বা দিনচর্যা নিয়ে কখনও ভাবিত হয়েছে বলে মনে হয় না । সংবাদপত্র না পড়েও দিন অবলীলায় অতিক্রম করে বলে সংবাদপত্রও ছুঁয়ে দেখেনি কতদিন। আরোপিত নয়, ঐ ধরণের জীবনযাপনে স্বচ্ছন্দ বোধ করত নিশ্চয়ই। দৈনন্দিন নির্দিষ্ট কোনো রুটিন ছিল না, বন্ধু-সহমর্মীর বাড়িতে রাত কাটাত মাঝে-মাঝে । কন্ঠস্বর ছিল শ্রুতিকটু, বলা চলে ফ্যাসফ্যাসে। অথচ রাস্তায়, হাঁটা-চলাকালীন, যখন সে খুব আনন্দিত হতো, গেয়ে উঠত রবীন্দ্রসঙ্গীত । প্রিয় শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, দারুন ভক্ত। প্রিয় পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কট্টর সমালোচকও বটে। ফালগুনীর তখন যৌবন; নিহিলিস্ট নয়, অন্তর্ঘাতক মনে-হৃদয়ে, এসময়ে অহংকে শাসনে রাখা সম্ভব নয়। 

নৈরাজ্য ছিল না ফালগুনীর মনে ও হৃদয়ে; অভাব ছিল বটে -- আর্থিক অনটন, নিরাপত্তার অভাব, প্রেমের অভাব, পোশাকাদির অভাব, সাংসারিক সুখের অভাব -- এসবই ছিল তার, তবু সব কিছু উপেক্ষা করার মত দুর্দমনীয় আত্মা ছিল তার, ব্যবহারিক জীবনে জীবিকার জগৎ বলতে তার কিছুই ছিল না । জীবিকার জগৎ থাকলেই এসট্যাবলিশমেন্টের প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। শতধা বিভক্ত এসট্যাবলিশমেন্টের ধারা-প্রণালীর মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়ে মানুষের শিরদাঁড়া বেঁকে নুয়ে পড়ে । গভীর সংকট থেকে উদ্ধারের প্রয়াস মানুষকে এই ভাবে এসট্যাবলিশমেন্ট-বিরোধী করে তোলে। বিকল্প-ভাবুক করে তোলে।


ফালগুনী ছিল ভয়ানকভাবে একা । ফলে, ভাবনা-চিন্তার সময় ছিল অফুরন্ত । বাড়িতে থাকলে, দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, কখনও বি.টি.রোডে সেন্ট্রাল লাইব্ররি, পকেটে দু'টাকা নিয়ে বিকেলের আগে কলেজ স্ট্রিটে, বাসভাড়া ফাঁকি দেবার সচেষ্ট প্রয়াস, পাতিরামে পত্র-পত্রিকা নাড়াচাড়া । স্টলে দাঁড়িয়ে সে বহু মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় রচনা পাঠ করেছে; তারপর কফিহাউস।কফিহাউসের পরবর্তী অধ্যায় হল নানান ঠেক । ফেরার ভাবনা -- পাথেয় সম্পর্কে কোনোরকম চিন্তা ছিল না। 


নিঃসঙ্গ থাকার ফলে নিজের মধ্যে ঘোরা-ফেরা, বলা চলে নিজের মধ্যে সেঁদিয়ে যাওয়া ও মগজ-ভ্রমণ -- এই প্রবণতা থাকার ফলে তার নিঃসঙ্গতা, বা একাকী থাকাটা তাকে কাতর করেনি তেমন, পরিচিত বা বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ছিল হাতে-গোনা, তেমন সামাজিকতাও ছিল না তার। পাড়ার ছেলেবেলাকার সঙ্গী, কলেজের সহপাঠী এবং যৌবনের আমরা কয়জন।



সে ছিল ইমসমনিয়ার রোগী । রাত দুটো-তিনটে ওব্দি পত্রিকা-বই নিয়ে, মুখে সিগারেট, ধোঁয়া -- হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলে, এরকম দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ত। রাত পেরোলে পরদিন, কিংবা রাত ঘন হচ্ছে দেখে, 'যচ্ছি-যাচ্ছি' করে যখন বেরোতো -- বাস বন্ধ। গভীর রাত, স্তব্ধ পরিবেশ, জনমানুষহীন পথ, গোনাগুনতি যানবাহন, হৈচৈ নেই, একা-একা ভুতের মত রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে, এ-দৃশ্য অনেকের দেখা। শীতে, কুয়াশা-ঘেরা, লম্বা কোট পরনে, রহস্যময় প্রতিচ্ছায়া নিয়ে ফালগুনী চলেছে । কুকুরের কোরাস-চিৎকার, লরি যাতায়াতের জোরালো আলো ও আওয়াজ, হঠাৎ-হঠাৎ পাগলের/মাতালের আবির্ভাব, সি.পি. লেখা কালো পুলিশি ভ্যানের ছুটে যাওয়া। এমনকি, ৭০-৭১ সালে, বরাহনগর-কাশীপুর যখন সংবাদপত্রের হেডলাইন, ফালগুনীর তখনও একই চলা-ফেরা ।


পাটনায় এক অন্য ফালগুনী । পাটনায় তার দিদি ও ছোটবোন থাকতেন । আর ছিলেন ফালগুনীর প্রেমিকা, যাঁর ওই শহরে বিয়ে হয়েছিল। কলকাতায় শরীর যখন ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়ত, মনে গভীর অবসাদ, দিন-যাপন এক ভার-স্বরূপ, তার মা তখন ফালগুনীকে পাঠিয়ে দিতেন দিদি-জামাইবাবুর কাছে, পাটনায়। ফালগুনীর জামাইবাবু মলয়ের কলেজের অধ্যাপক ছিলেন; লোহানিপুরে থাকতেন। পাটনায় ফালগুনী সুস্হ এ একা। প্রকৃতপক্ষে একা। কোনও সঙ্গী নেই, সহমর্মী নেই। সমীরদা, মলয় সেখানে থাকলে, ফালগুনী তাদের কাছে, আনন্দে। আমি পাটনায় গেলে সে হাউইয়ের হতো আমার ওখানে. লোদিপুরে, যে পাড়ার পটভূমি আমার বহু গল্পে। যদ্দিন আমার থাকা, ফালগুনী ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর, মনের কথা, নতুন কবিতা রচনা ও পাঠ।ফণিশ্বর রেণুর ফ্ল্যাটে যখন তাকে নিয়ে যাই, গরমকাল, কাটগ্লাসে ছাঁকা তাড়ির ওপর ছোটোএলাচ গুঁড়ো দিয়ে ছড়িয়ে আড্ডা। আমার গরহাজিরাতেও হাজির হতো মাঝে মধ্যে, কখনও বা মলয়ের সঙ্গে; রেণুর ফ্ল্যাটে গেলে, গ্রীষ্মকাল বাদে, মল্টেড হুইস্কি।


পাটনায় এগজিবিশান রোডের মোড়ে কফিহাউসে, একটি কোণে বসতেন রেণুজী, যেটি রেণুজ কর্নার নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছিল।টেবিল ঘিরে আমরা, সমীরদা, মলয়, অলোক ধনওয়া, রাজকমল চৌধরী ও অন্যান্য হিন্দি লেখক। বিহারের রাজ্যপাল দেবকান্ত বড়ুয়ার ভাই নবকান্ত বড়ুয়া পাটনায় এলে আসতেন রেণুজ কর্ণারে। আমাদের কবিতা পড়তে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। ফালগুনীর কবিতাগুলো স্বভাবতই ছিল অন্য রকম, পাঠভঙ্গীও গতানুগতিক নয়। রেণুজী হিন্দিভাষীদের জন্যে মুখে-মুখে অনুবাদ করে শোনান। রাজ্যপাল-ভবনে হাংরি কবিতাকে কারোরই অশ্লীল মনে হয়নি।নবকান্ত বড়ুয়া এরকম কবিতার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না; ফালগুনীকে তিনি অত্যাধুনিক ও ক্রেজি বলেন।


পাটনায় ফালগুনীর জন্য তার দিদির চিন্তা ছিল, দায়িত্বও। ওর কোনো খবর না পেলে মলয়ের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন, বকুনি দিতেন মলয়কে। পাটনায় আমরা ভাঙের পকোড়া হাতে গল্প করতে-করতে কখনও গান্ধী ময়দানে, কখনও মহেন্দ্রুঘাটে, কখনও গোলঘরে, কখনও বা শ্মশানে চরস ও মৃত্যুবোধের খোঁজে।দুজরা শ্মশান ছিল আমাদের বাড়ির কাছে, গঙ্গার ধারে। ফালগুনীর স্বাস্হ্যের কিছুটা উন্নতি হত, অনিয়ম সত্তেও। সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় ছিল ফালগুনীর দরোজাখোলা কথাবার্তা, প্রেমিকার সম্পর্কে, শরিকি বাড়ির খেয়োখেয়ি সম্পর্কে। পাটনায় তবু ফালগুনী কিছুটা দুর্নাম কুড়িয়েছিল।ছোটো শহর, বাংগালিবাবু-সমাজের ছেলে কিনা কংকরবাগ তাড়ির ঠেকে বসে তাড়ি খায়। ছিঃ ছিঃ। পাটনার যত্র-তত্র মলয়ের সঙ্গে যেতো, কিন্তু মলয় সেসব কথা লেখেনি এখনও পর্যন্ত।সম্ভবত ১৯৭৪-এ ফালগুনীর অন্তিম পাটনা বাস, কেননা মলয় তখন হাংরি মকদ্দমাকে কেন্দ্র করে বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতায় বিরক্ত, ও দূরত্ব গড়ে ফেলেছে ; পাটনা ছেড়ে মলয় রওনা দিয়েছে লখনউতে থাকার জন্য।

মাঝে-মাঝে ফালগুনী অবশ্য বে-রুটিন হয়ে দিদির বাড়ি থেকে গৃহছাড়া হতো। কখনও গান্ধী ময়দানে, কখনও বা পাটনা রেলওয়ে স্টেশনে, কখনওবা মহেন্দ্রুঘাটের জাহাজি পাটাতনে। কখনও বা ওর শয্যা ফুটপাতের পাথুরে বিছানায়।


হাংরি আন্দোলনের সময়ে আরো কয়েকটি আন্দোলন হয়েছিল ভারতবর্ষের নানা ভাষায়।বাইরেও।প্রতিবেশি নেপালে ঘটেছিল 'রালফা' আন্দোলন।রালফা ও হাংরিদের নিয়ে সমীরদা (রায়চৌধুরী) একটা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন, নকশাল নেতা কাঙ্চনকুমারের সহযোগীতায় বেনারস থেকে, হিন্দি কবি নাগার্জুন-এর অভিভাবকত্বে।রালফার নেত্রী ছিলেন পারিজাত, অসামান্যা সুন্দরী, বৌদ্ধধর্মাবলম্বী।মলয় এই পারিজাতের প্রেমে পড়েছিল, এবং ওর বেশ কিছু কবিতা পারিজাতকে নিয়ে লেখা; পারিজাতও ওর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, কিন্তু সে-গল্প মলয় কোথাও লেখেনি এখনও। কাঠমান্ডুতে আমাদের সদলবলে অভিজান তাঁকে বেশ উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত করেছিল।আমরা মহিষের কাঁচা মাংস 'কাচিলা' এবং দিশি নেপালি মদ 'এলা' খেয়ে পারিজাতের আড্ডায় বহু রাত কাটিয়েছি; আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন নেপালি অ্যাকাডেমির কর্ণধার বাসু শশী। নেপালে আমাদের মাসাধিক থাকার ও যথেচ্ছাচারে কাহিনী নিয়ে একটা পৃথক লেখা হতে পারে।সেই পারিজাত, বিমল রালফাকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে উড়ে এসে হাজির আমার আস্তানায়।ত্রিদিব মিত্র আর আমি তাঁদের তুলে আনি দমদম বিমানবন্দর থেকে -- বেলঘরিয়ায়। ত্রিদিব থেকে যায় আমার বাসায়, এবং আশ্চর্যের ব্যাপার সেই রাতে অতি আকস্মিকভাবে ফালগুনী এসে হাজির।

তখন আমার ঘরের ডানদিকে ছিল সবুজ ঘেরা মাঠ, অনেক গাছ-গাছালি, পাখিদের আপিলা-চাপিলা, রাতে ঝিঁঝি, একনাগাড়ে চেয়ে থাকলে চোখ সবুজ হয়ে পড়ে, দূষণমুক্ত বাতাসে বুক ফুলে ওঠে। অথচ মাঝে-মাঝে ঐ ১৯৭১-৭২ সালে, মাঝরাতে, নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে, কখনও সন্মিলিত পদশব্দ, দীর্ঘশ্বাস-প্রশ্বাস, চাপা কাতরানি। ঘুম ভেঙে গেলেও কাঠ হয়ে পড়ে থাকতে হতো। ফালগুনীও ছিল তেমন একটি রাতে।পরদিন সকালে সূর্যের আলোয় শুধু মাটির চাড় ছাড়া আর কিছু লক্ষিত হয় না। বছর ছয়-সাত পরে, যখন বাড়ি তৈরির জন্যে ভিত খোঁড়া হচ্ছে, একাধিক কঙ্কাল, শরীরের খাঁচা। হাতে একজনের লোহার বালা ছিল।


ফালগুনী পারিজাতের ইনটারভিউ নিতে শুরু করে। 'শিরিষ কা ফুল' উপন্যাসের লেখিকা পারিজাতে পাহাড়ি টোনে উত্তর দিতে থাকেন। তাঁর কন্ঠস্বরে মাদকতা ছিল। ফালগুনী উঠে দাঁড়ায় অসমাপ্ত সাক্ষাৎকারে। "আসছি, রথতলা থেকে..."। কাঠমান্ডুতে আছে সন্তুলা, জাঁড়; কলকাতায় বাংলা, মা-কালী। ফালগুনী গেল রথতলায়, রথতলায় ছোট্ট গুমটি, যদিও বেআইনি, সেই যে গেল, পরদিন দেখা গেল বরানগরে। ইনটারভিউয়ের কাগজ আর পাওয়া যায়নি।


আমাদের কয়েকটি গোপন ডেন ছিল, যেখানে যাওয়া-আসা হত, খালাসিটোলা বন্ধ হবার পর, নাইট শোয়ে। এখনও চোখ বুজে, খুললেই দেখতে পাই ফালগুনীর তৎপরতা, গেলাস হাতে, বগলে বোতল। খালাসিটোলায়, খেতে-খেতে সময় অতিক্রান্ত হলে কালীদা এসে তাড়া দিত -- গেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন। কাউন্টারের সামনে তখন দাঁড়িয়ে কমলকুমার মজুমদার, সঙ্গে কয়েকজন। ঠুমরি নিয়ে আলোচনা। কমলবাবু মলয়কে ওর মকদ্দমায় ১০০টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। খালাসিটোলায় তখন আমাদের ওঠার লক্ষণ নেই দেখে এক-এক করে বাতি নিভিয়ে দেওয়া হতো। শুধু একটি বাতি মাঝখানে। ফালগুনী নেশাগ্রস্ত অবস্হায় বলে উঠত, "কালীদা, আপনিই তো অন্তর্জলী যাত্রার হিরো। আপনাকে দেখেই তো কমল মজুমদার ঐ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন"।তবুও কালিদার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেত না, হুমকি দিয়ে তুলে দিতেন আমাদের, ওনার "বাউন্সাররা" ওনার হুকুমের অপেক্ষা করত।


বেরিয়ে কখনও জ্যোতি সিনেমা হলের পেছনের ডেন-এ। কফিহাউস থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট-মার্কেটের পেছনে গাব্বুর ঠেকে। গাব্বুর আসল নাম ছিল মোহম্মদ সিরাজ, বিহারের লোক, মলয়ের চেনা।আমাদের সাপ্লাই করত 'বাংলা' -- একটু বেশি দামে। গরমকালে পাওয়া যেত তাড়ি, টক, অথচ নেশা হতো প্রচন্ড।আর আমরা খেতাম পরোটা, রুটি, এবং হরেক মাংসের টিকিয়া, চাপ। আমাদের মধ্যে সুভাষ আর শৈলেশ্বর ধর্মের কারণে গরুর মাংস খেত না, ওরা ডিম খেত।মদের সঙ্গে গাঁজা বা সিদ্ধি খেত না ফালগুনী। বড়বাজারে সত্যনারায়ণ পার্কে, সিদ্ধির দোকানে ও ছিল রোজকার খদ্দের। ভাঙের গুলি বা সিদ্ধির সরবৎ ছিল লোভনীয়।


ফালগুনীর বাড়ি ছিল বিশাল, অনেকটা জায়গা নিয়ে, সামনে বিশাল ফটক, ফটকের মাথায় মৃত্তিকা-কেশরী। গেট পার করে অনেকটা হেঁটে প্রথমে মন্দির, পেরিয়ে গাড়িবারান্দা, রেনেসঁসের দিনে ভক্সৌল গাড়ি থাকত, তারপর সদর। কলকাতার প্রাচীন বনেদি বাড়ির মতই তার নকসা, নির্মাণ, কারুকার্য, বড়-বড় থাম-খিলান, মেঝেতে ইটালিয়ান মার্বেলের চৌকোপাথর -- খাপচা-খাপচা তোলা। পরে জেনেছিলাম তা থেকে পাথর তুলে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। ভেতরে চারধারে বারান্দা, সামনের ঘর, বন্ধ-কপাট, ভাড়াতেদের দেয়া ও গুদামি হিসেবে ব্যবহৃত। স্যাঁতসেতে অন্ধকার।


বাঁ ধার ঘেঁষে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, শালকাঠের সিঁড়ি।চওড়া বারান্দায় লোহার ঢালাই-করা রেলিং, বিশাল-বিশাল কক্ষ, মানুষের সমান দেড়গুণ উচ্চতার দরোজা-জানালা। বাঁ ধারে ফালগুনীর মা যে-ঘরে থাকতেন, মাঝখানে ছিল মান্ধাতা আমলের বিশাল পালঙ্ক, পায়া ছিল লম্বা, বিছানা ছিল মেঝে থেকে অনেক উঁচুতে।



দোতলার জলসাঘর ছিল বিশাল আয়তনের। ফালগুনী বলত, এখানে কবিতা-পাঠের একটা মুজরো করা যেতে পারে।ঐ জলসাঘরে অনায়াসে শ-দুয়েক শ্রোতা-দর্শক বসতে পারে। দেয়াল ছিল ম্যাড়মেড়ে, চুনের ছাপ পড়েনি এক শতক, মামড়ি খসার মত দেয়ালের গতর থেকে খসে পড়ছিল চুন। দু-একটা ধুলো-মাখা বিশাল অয়েল-পেইনটিঙ ছিল, যা দেখে সহজে তখনকার জমিদারদের অবস্হা টের পাওয়া যায়।হাংরি আন্দোলনের পেইনটার করুণানিধান মুখোপাধ্যায় বলেছিল, এরকম দেয়াল পেলে সাইকেডেলিক আর্টে ভরে দেয়া যায় । আর আলাস্কার তরুণ  বিটনিক লেখক ও শিল্পী ট্রেশম গ্রেগ স্রেফ আওড়াতে থাকে -- "ফ্যানটাসটিক. ফ্যানটাসটিক"।ফালগুনী ওকে খোঁচাচ্ছিল, "ডু ইউ নো ওরিয়েন্টাল আর্ট ? নো ওরিয়েন্টাল আর্ট, স্যাম ?" ওর মায়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ফালগুনী -- আমরা ছিলাম নিমন্ত্রিতজন।

বেনারস থেকে হাংরি চিত্রকর করুণানিধান, সঙ্গে আলাস্কের ট্রেশম গ্রেগ এসে হাজির এক সকালে বেলঘরিয়ায়। আমি পাটনার ছেলে জেনে ফালগুনীর মা বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন। ফালগুনীর সেজদি, যিনি ফালগুনীকে অপরিমিত স্নেহ করতেন, অসুস্হ হলে যিনি চিন্তিত ও বিচলিত হয়ে উঠতেন, বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত জেগে থাকতেন দরোজা খোলার জন্য, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতেন না, ছটফট করতেন, ফালগুনীর ভালো-মন্দের দিকে তিনি সবিশেষ লক্ষ রাখতেন। এই সেজদির পক্ষপাত ফালগুনীকে উৎসাহী করে তুলত। মনে আছে, আমরা চারজন ফালগুনীর মায়ের ঘরে মেঝের ওপরে বসে খেয়েছিলাম, পরিবেশনায় সেজদি। খাবার শেষে একসময় তিনি ফালগুনীর কবিতা সম্পর্কে জানতে চান। পরে কিছুটা বিষাদ-মাখা কন্ঠে বলেছিলেন, "অনিয়ম করে শরীর নষ্ট হলে লিখবে কি করে ?" বস্তুত তাই ঘটেছিল।শেষের দিকে ফালগুনীর শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছিল।


কেন যে দোতলার স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে ছাদের একচিলতে চিলে-কোঠায় আশ্রয় নিয়েছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি । নিজের ভেতরে ঢুকে যাওয়া, নিজের মুখোমুখি হওয়ার মত এমন নিরিবিলি জায়গা, বস্তুত ছিল লোভনীয়। সিঁড়ির লাগোয়া অপরিসর চিলে-কোঠা, জানালা পশ্চিম-মুখো, পাল্লাহীন ঘর, চিলতে আলো তখন এসে পড়েছিল। ঐ কোঠাঘরে ছিল একটা ছোট্ট তক্তাপোশ, মাথার ধারে তেলচিটে বালিশ, মুড়ে-রাখা বিছানা, অর্থাৎ চাদর ও সতরঞ্চি, একটা ছোট্ট কাঠের নড়বড়ে টেবিল। আগেকার আমলের লোহার টিনের চাদরও ছিল, আর রাখা ছিল একটা ছোট্ট কুঁজো, এলুমিনিয়াম গেলাস তার ওপর ঢাকা।আগোছালো অপরিষ্কার ছন্নছাড়া, মেঝেময় ধুলো ও ছাই, দেশলাই কাঠি, খাওয়ার পর বিড়ির টুকরো। দেয়াল অপরিচ্ছন্ন। দেয়ালে যিশুর একটা অতি পরিচিত মূর্তি, ফালগুনী তার গায়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে কালো রবারের সাপ। কালো দিব্যতা, যাকে নিয়ে ওর বিখ্যাত কবিতা। একটা তোবড়ানো টিনের সুটকেস, সুটকেসের ভেতরে অবিন্যস্ত কাগজপত্তর, মণিমুক্ত।


ফালগুনীর পূর্বপুরুষরা ছিলেন যশোহরের জমিদার । পিতামহ রামরতন রায় , বরানগরে রতনবাবু রোড যাঁর নামে।বরানগরে যে শ্মশানটি রতনবাবু ঘাট সংলগ্ন, কেবলমাত্র রামরতন রায়ের পরিবারের সদস্যদের দাহ করার জন্য যা সংরক্ষিত -- ব্যতিক্রম শিশিরকুমার ভাদুড়ী ও শ্রীরামকৃষ্ণ । ফালগুনীর চিতা এখানেই নিভেছিল। ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের ফলে তাদের জমিদারি পাকিস্তানে পড়ে; ফলে আয়ের উৎস হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।


অতিরিক্ত ও মাত্রাহীন নেশা-প্রীতি, পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব, এবং সেই সঙ্গে পথ্য ও চিকিৎসার অভাব -- তার শরীর ভেঙে পড়ে। ক্রমশ ক্ষয় হতে থাকে। শেষ দিকে, কবি দীপক মজুমদারের সঙ্গে ফালগুনীর আলাপ হয়, ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা। দীপক তাকে দিয়েছিলেন সেই মজার সন্ধান, যা সম্ভবত আমরা দিতে পারিনি, কেননা দীপকের যৌনতা ছিল বাধাবন্ধনহীন, লাগামছাড়া।বিদেশিনীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল দীপকের।তা ফালগুনীকে মাটির আরও কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল।


শেষদিকে একবার সে পাড়ি দিয়েছিল সাগর-যাত্রায়। পাড়ার ছেলেবেলাকার বন্ধু অরুণের সঙ্গে। ফালগুনী তখন পুরোপুরি অসুস্হ। ভালোভাবে উঠতে-বসতে পারে না। ছইয়ের ভেতরে শরীর শায়িত। মোহনার মুখে নৌকা এসে টালমাটাল সাগরের জল ছুঁয়েছে, ওপচানো ঢেউয়ের গর্জন, গম্ভীর ধ্বনি, নৌকোর গায়ে সাগর-জলের ঝাপটানি। বড় বেশি কাতর হয়ে পড়েছিল ফালগুনী । মাথা তুলে, ছইয়ের বাইরে নীলাকাশ, মেঘের খেলা, জলচর পাখি, জলে প্রতিবিম্বিত সূর্য, আলোর ছটা -- আরো বেঁচে থাকার আকাঙ্খা ছিল তার: " বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই...."


মুহূর্তে দৃশ্যান্তর। ক্যামেরা প্যান করে দূরে পাহাড়শ্রেণির দিকে, মেঘ, নিবিঢ় আকাশ ছুঁয়ে নীতার মুখমন্ডল।মেঘে ঢাকা তারায় তার আর্ত গোঙানি, দিগ্বিদিক নিস্তব্ধ পরিবেশকে খান-খান করে ভেঙে ফ্যালে । বাংলা সাহিত্যে  আধুনিকতার যুগের সমাপ্তি হয়।



( হাওয়া৪৯ ফালগুনী রায় সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত )

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন