হাংরি আন্দোলন : বাংলার ষাটের দশকের বিদ্রোহী কবিরা

 সারা হুসেন

আজকের সংঘর্ষরত লেখকরা অতীতের সাহিত্যিকদের প্রতি এক রকমের চুম্বক আকর্ষণ বোধ করেন। আমরা প্রায়ই তাঁদের কাজের, জীবনযাপনের এবং জীবনশৈলীর দিকে তাকিয়ে অনুপ্রেরণা সঞ্চার করি, আমাদের নিজেদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাঁদের উদ্যোগ এবং কার্যপ্রণালীকে গ্রহণ করার প্রয়াস করি এবং নিজের লেখক সত্তার কন্ঠস্বর খুঁজে পাই । আজকের যে সাহিত্যিক পৃষ্ঠভূমি তা যে সমস্ত আন্দোলন ও বিপ্লব থেকে গড়ে উঠেছে তার পানে তাকাই ।

১৯৫০ দশকের বিট জেনারেশন যেভাবে লেখকদের আকর্ষণ করেছিল তার সমকক্ষ আর কোনো সাম্প্রতিক ঘটনা দেখা যায়নি । যুবক, অগোছালো, প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকরা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী জীবনযাপন করছেন, সমাজের নিয়মনির্দেশ অমান্য করেছেন, সেসব গালগল্প জ্যাক কেরুয়াক ও অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে শহরের পর শহর ঘুরে বেড়াবার কল্পনা করতে ভালো লাগে -- সূর্যের আলো আপনার মুখের ওপর এসে পড়েছে --- কেউ একজন হারমোনিকা বাজাচ্ছে -- হিপি জীবনযাপনের আদর্শ, যা বিটদের সম্পর্কে রোমান্টিক ধারনা আপনার মনে তৈরি করে দিয়েছে ।


          কিন্তু একবার আপনি বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে বাস্তবজীবনের কাজ-কারবারে প্রবেশ করলে, সেই ছবিগুলো ক্রমশ পালটে যেতে থাকে । যে ধরনেরই লেখক আপনি হতে চান, আপনি প্রয়াস করেন শব্দের মাধ্যমে পৃথিবীকে যতোটা বদলে দেয়া যায়, বিস্ময়কর ঐন্দ্রজালিক খেয়ালি জগতসংসার গড়া যায়, এমনকি বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটিয়ে ফেলা যায় । নিজেদের মস্তিষ্কে গড়ে তোলা  এরকম কল্পনার মানুষ আমরা সবাই হয়ে উঠতে হয়তো পারব না, ভারতবর্ষে এরকমই এক সাহিত্যিক আন্দোলন ঘটেছিল, আমাদের নিজস্ব বিট জেনারেশন, যদি তাকে বলা যায়, যা বাংলা সাহিত্যকে গ্রহণ করার, পাঠ করার ও লেখার প্রথাকে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছিল ১৯৬০র দশকে।


          ডক্টর উত্তম দাশ তাঁর ‘হাংরি শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’ গ্রন্হে জানিয়েছেন যে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন যে চারজন তাঁদের বলা হয় ‘হাংরিয়ালিস্ট কোয়ার্টেট’, তাঁরা হলেন মলয় রায়চৌধুরী এবং তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়া । আভাঁগার্দের এই ঘরছাড়ারা অচঞ্চল কলকাতার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক জগতকে খুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিল ( তখন কলকাতাকে বলা হতো ক্যালকাটা ) এবং প্রকৃতপক্ষে স্বীকৃতি দেবার মতো যৌবতেজ । সদস্য সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং কবি ও লেখকেরা এই আন্দোলনে যোগ দিতে লাগলেন যার দরুন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারতের জমিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে তারা উঠে এসেছিল ।


          হাংরি আন্দোলনকারীরা জিওফ্রে চসারের “ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ পঙক্তি থেকে হাংরি শব্দটি নিয়েছিলেন । নয়নিমা বসুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মলয় রায়চৌধুরী বলেছিলেন, “একটি সংস্কৃতির অবসানের পর্ব আরম্ভ হলে তা বাইরে থেকে যা পায় তাকে আত্মসাৎ করতে থাকে । আজকে পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে হাংরি আন্দোলনকারীদের পূর্বাশঙ্কাকে সত্য বলে মনে হয়।”


          ষাটের দশক ছিল বাংলার দেশভাগোত্তর যুবসমাজের বিরক্ত প্রজন্ম । তাঁরা তাঁদের ক্রোধ এবং উৎখাত হবার বোধ যে লেখনকর্মের দ্বারা প্রকাশ করা আরম্ভ করলেন তা সেই সময়ের ঔপনিবেশিক দর্শানুপাত এবং প্রথানুগত বাংলা পঠনপাঠনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পাঠকদের ভেবে দেখতে বাধ্য করলেন যে ভারতীয় সাহিত্য কেমন দৃষ্টিতে দেখা হয় ও পাঠ করা হয় । অধ্যাপক এস. মুদগাল যেমন বলেছেন, “হাংরি আন্দোলনের মূল থিম ছিল ইতিহাস-বিশ্লেষণ সম্পর্কে অসওয়াল্ড স্পেংলারের ব্যাখ্যা, যিনি বলেছিলেন যে যখন একটি সংস্কৃতি অবসানের মুখে পড়ে যায় তখন সেই সংস্কৃতি বাইরের যাবতীয় উপাদান আত্মসাৎ করতে থাকে । হাংরি আন্দোলনের সদস্যরা মনে করেছিলেন যে বঙ্গসংস্কৃতি তেমনই এক জলবিভাজকে আক্রান্ত হয়েছে এবং বহিরাগত খাদ্যের ওপর নির্ভর করছে ।”


           হাংরি জেনারেশন কেবল একদল ক্রুদ্ধ যুবকের গোষ্ঠী ছিল না । সেই সময়ে বাংলা সাহিত্য, উচিত শব্দাবলীর অভাবে বলা যায়, সীমিত হয়ে গিয়েছিল এবং অত্যন্ত কম সংখ্যক পাঠকের জন্য রচিত হতো। হাংরি আন্দোলনকারীরা এর থেকে বেশি কিছু চাইছিলেন -- তাঁরা এক নতুন ভাষা চাইছিলেন, এক নতুন সাহিত্য পরিসর যা সাধারণ বাঙালিদের  প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারে, কেবলমাত্র কয়েকজন এলিটের বোধগম্যতায় সীমিত না থাকে । যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ঈপ্সিতা চন্দ বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “হাংরি আন্দোলনকারীদের  অবস্হান ছিল চরম আইকনোক্লাসটিক ; তখনও পর্যন্ত যা কিছু অলঙ্ঘনীয় ছিল তাকে  ভেঙে ফেলার জন্য , এমনকি যেভাবে কবিতা লেখা হতো, তাও, এবং যেভাবে তাঁরা জীবনযাপন করতেন, তাতে প্রতিফলিত হতো । অধ্যাপক চন্দ বলেছেন, তাঁদের হতাশা কেবল কবিদের মধ্যেই সীমিত ছিল না, একটি সমগ্র উচ্চশিক্ষিত যুবকবর্গ অনুভব করত যা তাদের কোনো ভবিষ্যত নেই ।”


         চারজন হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিলেন আরও অনেক খ্যাতনামা কবি-লেখক, যেমন সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ত্রিদিব মিত্র, সুভাষ ঘোষ, ফালগুনী রায়, অরুণেশ ঘোষ এবং আরও অনেকে । এই সমস্ত লেখকরা এসেছিলেন দরিদ্র পরিবার থেকে, এবং সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক আবহ তাঁদের কন্ঠস্বরকে আরও উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল ।


          স্হানীয় ভূখণ্ডের ইতিহাসে সেই সময়টি ছিল ভীষণ কঢিন । দেশভাগের ফলে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, কোথাও মাথা গোঁজার মতো কপর্দক ছিল না তাঁদের -- নিজের বলার মতো জায়গা ছিল না । দারিদ্র্য ছিল চরম, খাদ্যের ও মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের অভাব, অথচ তা তখনকার সাহিত্য ও ভাষায় প্রতিফলিত হচ্ছিল না --- প্রবেশ করতে পারছিল না এলিটদের বৈঠকখানায়, যাঁরা নিজেরা বেশ আরামের জীবন যাপন করছিলেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা এই বাস্তব অবস্হার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন, এবং সেই সমস্ত ঘটনা ও গল্প তুলে ধরছিলেন তাঁদের প্রকাশিত বুলেটিন ও প্যামফ্লেটে ।


          হাংরি আন্দোলন সমস্ত রকমের চলিত রীতি ও ভাষাকে ভেঙে ফেলতে লাগলেন -- তা প্রথানুগ আঙ্গিকের, বিষয়বস্তুর, ছন্দের দিক থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, তখনকার ‘এলিট’ সাহিত্য যা বাজার দখল করে রেখেছিল তা থেকে একেবারে পৃথক । ‘এলিট’ সাহিত্য রচিত হত নম্র, সংস্কৃতিবান, সভ্য, শোভন ভাষায়, এবং তার ভেতরে হাংরি আন্দোলন বিশুদ্ধ নৈরাজ্য নিয়ে প্রবেশ করল । রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে তাদের মনে হয়েছিল ভেজিটারিয়ান, যখন কিনা তাঁদের নিজেদের ভাষা ছিল পথচলতি মানুষের এবং আটপৌরে কথাবার্তার, জনগণের জন্য গড়া ভাষা, সদ্যপ্রসূত আবং যার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় -- “জীবনের ভাষা”, যাকে অন্যেরা অশোভন ও অশ্লীল বলে দেগে দিচ্ছিলেন ।


          নয়নিমা বসুকে দেয়া সাক্ষাৎকার মলয় রায়চৌধুরী স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা ঔপনিবেশিক সাহিত্যিক মানদণ্ডকে বিসর্জন দিয়ে নিজেদের একাত্ম করেছেন উত্তরঔপনিবেশিক সময়-পরিসরের সঙ্গে। তাঁরা নিজেদের লেখাপত্র প্রকাশ করতেন এক পাতার লিফলেটে এবং সেগুলো বিলি করতেন কফিহাউসে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, সংবাদপত্র দপতরে । তাঁদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী কার্যকলাপ অ্যালেন গিন্সবার্গকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিল, যিনি ষাটের দশকে ভারতে বসবাসের সময়ে মলয় ও সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন । কিন্তু প্রভাবশালী বঙ্গসমাজ তাঁদের সেভাবে গ্রহণ করতে পেরেনি । সমাজের সমালোচনার অর্থ রাজনীতির ও ক্ষমতানশীনদের আক্রমণ । নয়নিমা বসু লিখেছেন, হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ক্রোধ শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল যখন হাংরি কবিরা ক্ষমতাবানদের, বাঙালি রাজনীতিকদের, আমলাদের, সংবাদপত্রের সম্পাদকদের জোকার, রাক্ষস, দেবী-দেবতা, জীবজন্তু ও কার্টুন চরিত্রের কাগজের মুখোশ পাঠালেন । মুখোশের ওপর লেখা ছিল “দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন।”


          এগারোজন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হল, এবং মলয় রায়চৌধুরীকে, যাঁকে মনে করা হতো হাংরি আন্দোলনের মুখপত্র ও নেতা, তাঁকে সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে গ্রেপ্তার করা হল । তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা ( ইংরেজিতে Stark Electric Jesus রূপে অনুদিত ) সভ্য বাঙালি ভদ্রলোকেদের রুচিবিরোধী মনে হল, এবং তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও কবিতায় অশ্লীলতার অভিযো্গ আনা হল । তাঁর বিরুদ্ধে মামলা পঁয়ত্রিশ মাস চলেছিল, তাঁকে হাজতে পোরা হয়েছিল, এবং দুই মাসের কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল । বহু সদস্য এই সময়ে হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে চলে গেলেন, কয়েকজন চাকরি হারালেন, কেউ কেউ জীবনের অন্য ক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন । মলয় রায়চৌধুরী কিন্তু নিজের পরিবার ও অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে সমর্থন পেলেন, এমনকি টাইম ম্যাগাজিনে তাঁর মামলার খবর পেয়ে ওক্তাভিও পাজ ও আরনেস্তো কার্দেনাল তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন । তাঁর সমর্থনে অ্যালেন গিন্সবার্গ এই  চিঠি লিখেছিলেন ভারতীয় কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামের যুগ্মসম্পাদক আবু সয়ীদ আইয়ুবকে :-



৭০৪ ইস্ট ফিফ্থ স্ট্রিট, নিউ ইয়র্ক, অ্যাপট ৫ এ


প্রিয় আবু সয়ীদ


          জঘন্য ! আপনার বাগাড়ম্বর আমায় বিভ্রান্ত করে তুলেছে, মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন, "আমার কোনও পদমর্যাদা নেই", এসব কথার মানে কী ? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড রয়েছে । কমিটির ভারতীয় এক্জিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে, ভারতে কমিটির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কেও আপনি ওয়াকিবহাল । চিনের ভারত আক্রমণের সময়ে আমি কলকাতায় একটি বড়সড় সমাবেশে উপস্হিত ছিলাম, যেখানে আপনার সহসম্পাদক শ্রীঅম্লান দত্ত সাংস্কৃতিক বর্বরতা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন । যা হোক, শ্রীবি ভি কার্নিককে আমি চিঠি লিখেছিলাম. যদিও আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতা কমিটির কোনও সদস্য বা কমিটির সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিরই কাজটি করা দরকার ছিল । আর বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি "আপত্তিকর উপাদান"-এর কথা । মশায়, আপনি ও পুলিশই একমাত্র সেগুলিকে আপত্তিকর বলছেন । সেগুলি নিছক আপত্তিকর তকমা পাওয়া উপাদান মাত্র, প্রকৃত আপত্তিকর নয় । পরের দিকে যে বলেছেন, "প্রশ্নাতীত আপত্তিকর", তা-ও নয় । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি, তাই তা এতোটুকুও "প্রশ্নাতীত" নয় । আসলে পুরোটাই হল রুচি, মতামত ইত্যাদির ব্যাপার । পুলিশ তাদের নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । আমার মতে এটি কালচারাল ফ্রিডাম বা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতারই বিষয় । আশা করছি, এ-বিষয়ে ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম, বিশেষ করে সেটির কলকাতা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা-ও একমত হবেন । আমার আরও অদ্ভুত লাগে জেনে যে, এক্ষেত্রে কারওকে সাহায্য করা মানে নবীন লেখকদের বলা, তাদের মতাদর্শ থেকে পিছু হটতে, নিজেদের অবস্হান পালটাতে, ইত্যাদি । ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো প্রমুখের ক্ষেত্রে যেরকম করা হয়েছিল সেরকমই একেবারে । এমনকী তাঁরা যে "ফালতু" লেখক, সেটাও । আমি আপনাকে ফের রাগাতে চাই না । আপনি ক্ষুব্ধ হন যাতেভ তেমন কিছু বলছি না । কিন্তু একটি কথা বলতেই হবে যে, বর্তমান ইশ্যু নিয়ে আমার-আপনার পত্রালাপ আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে ওই নবীন রুশ কবিরা কেন আপত্তিকর বা ফালতু, সেই নিয়ে রুশ আমলাদের সঙ্গে আমার কথোপকথন । "দায়িত্বহীন, নিম্ন মানের লেখা, নিম্ন রুচি।" ব্রডস্কির মামলার সময়ে, আপনার মনে থাকতে পারে, বিচারক প্রায় সারাক্ষণ ব্রডস্কিকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, "কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক কবে আপনার মর্ম স্বীকার করেছে।" বেচারা মলয়, -- যদি ও একজন নিম্ন মানের লেখকও হয় -- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সন্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম ।


          ওরা সকলেই সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন, জ্যোতির্ময় দত্ত যদি একথায় আপনার সহমত হয়, তাহলে ও আপনার আত্মগরিমা তুষ্ট করার জন্য সাধুতার ভান করেছে । দলের সবাই, ছাব্বিশজন যাদের জেরা করা হয়, সুনীল, উৎপল বসু, সন্দীপন, তারাপদ তো আছেই, এরা ছাড়াও অন্য যারা গ্রেপ্তার হয় সেই সব মধ্যমানের লেখকরা -- যদিও মলয়ের নির্যাতনের প্রতি প্রতিষ্ঠানের ক্রুদ্ধ মনোভাব দেখে মলয়ের নির্বুদ্ধিতার প্রতি আমার মমত্ব জাগছে -- এরা সবাই ফালতু এমন দাবি করা আপনার পক্ষে বা জ্যোতির পক্ষে অসম্ভব। কৃত্তিবাস-হাংরি গোষ্ঠীকে -- এই মামলায় যারা সকলেই পুলিশের দ্বারা হেনস্হা হয়েছে -- সমর্থন করেন এমন কোনো বাঙালি লেখক বা সমালোচককে যদি আপনি না চেনেন, তাহলে আপনার মতামত সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে । নিজেকে একদম আলাদা রেখে বুদ্ধদেব বসু তাদের গুণের স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেমন দিয়েছেন বিষ্ণু দে ও সমর সেন । আমি শুধু মলয় নয়, গোটা দলটার কথা বলছি ।


          এর পাশাপাশাই আপনার আরও একটা স্টেটমেন্ট আমায় অবাক করেছে। আপনি বলছেন, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধেও কংগ্রেসকে একইরকম ভূমিকা নিতে হবে, "আমি পর্তুগাল, স্পেন ও পাকিস্তানের কথা বলছিলাম"। এখনও পর্যন্ত আমার শোনা আপনার বক্তব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর ( আমার কাছে ) এটি । লরেন্স, ফ্যানি হিল, জেনে, বারোজ, মিলার, আপনাদের কামসূত্র, কোনারকের আলোকচিত্র -- এসব ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে ধারাবাহিকভাবে, বহুল প্রচারিত আইনি মামলা চলেছে, শায়েস্তা করার চেষ্টা চলেছে । এছাড়াও ফ্রান্সে একাধিক সংবাদপত্র ও আলজেরিয় যুদ্ধ বিষয়ক বই দমননীতির কোপে পড়েছে, পড়ছে । রাজনৈতিক কারণেই এই দমন । এমনকী কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামও এর কয়েকটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যদিও তা নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবেই । কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম সম্ভবত আয়রন কার্টেন দমননীতির বিরুদ্ধেই সরব হতে পছন্দ করে, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধে নয় -- আমার এ ধারণা আরও বেশি করে দৃঢ় হচ্ছে, বিশেষ করে আপনার প্রতিক্রিয়ার ধরন-ধারন দেখে । এই বিগত এক বছরেই নিউ ইয়র্ক শহরে চলচ্চিত্র, বই সংক্রান্ত পুলিশি ধরপাকড় তো হয়েইছে, এমনকী কমেডিয়ানরাও ( লেনি ব্রুস-এর ঘটনা ) বাদ যাননি । আমার মনে হয়, আপনার এ সম্পর্কে যতোটা জানা প্রয়োজন ততোটা আপনি জানেন না । ভদ্র ভাষায় বলতে তাই দাঁড়ায় আর কী । যেমন, আপনি কি জানেন যে, ইংরেজি ভাষায় যে প্রকাশক ডুরেল, মিলার, বারোজ, জেনে, নবোকভ, টেরি সাদার্ন, দ্য সাদে ও প্রাচ্য প্রণয়গাথা প্রকাশ করেছিল, সেই অলিম্পিয়া প্রেস ফরাসি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ? এ ব্যাপারে ফরাসি কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম কিছু করতে তেমন উৎসাহী ছিল তা নয় । অলিম্পয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া এক আন্তর্জাতিক কেচ্ছায় পরিণত হওয়ায় একটু নড়েচড়ে বসে তারা এখন একটা পিটিশন দিয়েছে । নিশ্চয়ই এটা জানেন যে, ভারতে লেডি চ্যাটার্লিজ নিষিদ্ধ ? ভারতীয় কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম কি এ বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছে ? হাংরি আন্দোলনকারীরা তো হাল আমলের ।


          যা হোক, এসবই তত্ত্বকথা, আমার ক্ষোভ উগরে দেয়া -- মতের বিনিময় -- ঈশ্বরের দোহাই, মাথা গরম করবেন না -- মলয় রায়চৌধুরী ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে আনা পুলিশের অভিযোগ মনে হয় এখনও রুজুই আছে -- মলয় লিখেছে যে এই ২৮ ডিসেম্বরই বিচার শুরু হবে -- এই অদ্ভুত পরিস্হিতি থেকে মুক্ত হবার মতো প্রবীণ লেখকদের কাছ থেকে কোনো সহায়তাই পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত --- ও বলেছে, বোধহয় ওর কথাগুলো সত্যিই, যে "আমাদের গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে কবি ও লেখকরা এতোটাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এখানে যে, তারা প্রায় সকলেই তাদের লেখার ধরণটাই পালটে ফেলেছে।" অবশ্যই যে লেখক দলকে ও চেনে, তাদের কথাই বলছে, "প্রতিষ্ঠিত" বয়স্কদের কথা নয় । ও লিখেছে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামকে চিঠি লিখেও কোনো উত্তর পায়নি ও । আপনিও এড়িয়ে গেছেন । আর "আমাদের গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাদের কোনো বুলেটিন বা ম্যাগাজিন আমরা ছাপাতেই পারছি না।"পুলিশের ভীতি । উৎপল বসু আজ একটি চিঠিতে লিখেছে, "ভীষণ বাজে খবর। আজ আমার কলেজ কর্তৃপক্ষ ( যেখানে আমি জিওলজি পড়াই ) আমায় পদত্যাগ করতে বলল । আমার কোনো যুক্তিই ওরা শুনতে নারাজ । আমার তো একরকম সর্বনাশ হয়ে গেল । ওরা "টাইম" পত্রিকা খুলে দেখিয়ে বলল : এই তো আপনার ছবি ও বক্তব্য । আপনার মতো কোনো লোক আমাদের এখানে থাকুন, এ আমরা চাই না । আমার চিঠিপত্র পুলিশ ইনটারসেপ্ট করছে । আপনি আমার শেষ চিঠিটি পেয়েছেন, ইত্যাদি।" এ একদম অসুস্হকর এক পরিস্হিতি । এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে প্রাথমিকভাবে আপনাকে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম । কারণ পুলিশি শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে । এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ । প্রবীণ দায়িত্ববান কোনো সদাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্পত্তি সম্ভব নয় । বোধহয় ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না । যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতা কংগ্রেসের দপ্তরে এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন । আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন । তবে চিঠিতে অন্তত আপনাকে সোজাসুজি কথাগুলো বলছি । এই মুহূর্তে আপনার-আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্হিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয় ।


          অনুগত -- অ্যালেন গিন্সবার্গ


পুনশ্চ : আমার বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী । পিটার অরলভস্কি ও আমি গত এক মাস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাদানে ব্যস্ত ছিলাম । আমি মাত্র কয়েকদিন আগেই কেমব্রিজ থেকে ফিরেছি ।



          কলকাতা উচ্চ আদালতে মলয় রায়চৌধুরী জিতে যান, কিন্তু ততদিনে হাংরি আন্দোলনকারীদের সংখ্যা মাত্র কয়েকজন । মলয় রায়চৌধুরী বলেছেন যে ইতিমধ্যে বিদেশিরা তাঁর কবিতা ইউরোপ আমেরিকায় ্রৌঁছে দিয়েছিলেন এবং তাঁর রচনা সেখানকার লিটল ম্যাগাজিনগুলোয় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল ।” মামলার খরচের চাঁদা তোলার জন্য আমার কবিতা নিউ ইয়র্কের সেইন্ট মার্কস চার্চে পঠিত হয়েছিল, নয়তো আমার যা আর্থিক অবস্হা ছিল, উচ্চ আদালতে মামলার খরচ যোগানো অসম্ভব হতো ; বন্ধুরা যারা হাংরি আন্দোলনে ছিল রাজসাক্ষী হয়ে আমাকে ছেড়ে পালিয়েছিল, চাকরি থেকে নিলম্বিত হয়ে গিয়েছিলুম, গ্রেপ্তারির সংবাদ সহ্য করতে না পেরে ঠাকুমা মারা গেলেন , লেখালিখিও  আমাকে ছেড়ে চলে গেল ।”


           কিন্তু হাংরি আন্দোলনের সন্মোহন ও উদ্দীপনা এখনও তরুণ কবি-লেখকদের মধ্যে জাগ্রত এবং মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যান্য হাংরিদের রচনাবলী, তাঁদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও, আন্দোলন জীবন্ত থেকে গেছে। হাংরি আন্দোলনকারীরা কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, সারা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় যে ছাপ ছেড়ে গেছেন তা মুছে ফেলা যাবে না । হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে করা হয় সাহিত্যজগতের নায়ক, তা সে ধারনা যতোই রোমান্টিক হোক না কেন । এই সেই লেখক-কবির দল যারা নতুন কন্ঠস্বরের জন্য ছিল ক্ষুধার্ত এবং নিজেদের আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছিল, তাদের সাহসী ও বেপরোয়া লেখার মাধ্যমে ঝড় তুলতে পেরেছিল রাজনৈতিক এলাকায়, তাঁদের আরম্ভ করা সেই ঝড় যেন ছিল ঘোষণা, আসন্ন পরিবর্তনের ঘোষণা ।


ঋণস্বীকার : হোমগ্রোন.কম.ইন ( অনুদিত )

১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে প্রকাশিত

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন