সমীর রায়চৌধুরীর গল্প-প্রবন্ধ “বাইরের কিছু নয়, ভেতরের কোনো উদ্রেক”: সমীর রায়চৌধুরীর ৩টি গল্পে বাস্তবতার যাপনচিত্র

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

জাদুবাস্তবতা কি অধিবাস্তব না অতিবাস্তব ? বাস্তবতার অভাব না আধিক্য কোনটা নির্মাণ করে জাদুবাস্তবের আঁতুড় ? কিউবার সাহিত্যিক আলেহো কার্পেন্তিয়ার ১৯৫০-এর দশকে যে “মার্ভেলাস রিয়্যাল” এর কথা বলেছিলেন তা ছিল আদ্যপান্তভাবে রাজনৈতিক এবং প্রতিস্পর্ধী । কার্পেন্তিয়ার ইউরোপীয় বাস্তববাদের বাইরে বেরিয়ে এসে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার বয়ানের কথা বলেন যা তথাকথিত প্রথম-বিশ্ব-বহির্ভূত অরৈখিক বাস্তবতার যাপনচিত্র তুলে ধরতে পারবে । তাঁর লাতিন আমেরিকান “মার্ভেলাস রিয়্যাল” ইংরেজি ভাষায় লেখা ভারতীয় সাহিত্যে রেখাপাত করে সালমান রুশদির ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ ( ১৯৮১ ) উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে । অব্যাহত থাকে জাদুবাস্তবতার উত্তরঔপনিবেশিক রাজনৈতিক চালচিত্র । জাদুবাস্তবতা কোনো অধিবিদ্যক ( metaphysical ) বাস্তবো্ত্তীর্ণ পৃথিবীর রূপকথা নির্মাণ করে না । বরং বাস্তববাদ যেভাবে কায়েমী রাজনীতির পক্ষ নেয়, তার সমালোচনার প্রয়োজন থেকেই জাদুবাস্তবতার আয়োজন । ম্যাজিক এখানে বাস্তবকে বদলাতে সচেষ্ট ।

কুমকুম সাঙ্ঘারি লিখেছেন, “Marvellous realism must exeed mimetic reflection in order to become an interrogative mode that can press upon the real at the point of maximum conteradiction.” জাদু বাস্তবতায় জাদু, বাস্তবকে পুননির্মাণ করে আর বাস্তবতা জাদুকে তার রাজনৈতিক কুহক বিস্তার করতে দেয় ।

এই সংক্ষিপ্ত তাত্বিক অবতারণা সমীর রায়চৌধুরীর তিনটি স্বঘোষিত ‘অধুনান্তিক’ ছোটগল্পে বাস্তবতার ফ্রেমকে পর্যালোচনা করার জন্য । আমরা আগে থেকেই এই তিনটি গল্পে বিধৃত বাস্তবতাকে জাদুবাস্তবতা ধরে না নিয়ে দেখার চেষ্টা করবো কিভাবে এই গল্পগুলিতেবাস্তববাদ বা রিয়্যালিজমকে ভাঙা-গড়া করেছেন লেখক । বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবক সমীর রায়চৌধুরী নিজের সাহিত্য সৃষ্টিকে নিজেই উত্তরাধুনিক এবং উত্তরঔপনিবেশিক লক্ষণাক্রান্ত বলে মনে করেছেন । এই ধারায় বাস্তববাদের রাজনীতিকে প্রশ্নচিহ্ণের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়তো স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ।

 

মানুষবাজার

প্রথম আলোচ্য ‘মানুষবা্জার’ গল্পটি ডায়ালগের ফর্মে লিখিত বা ফর্মের দিক থেকে এক রাজনৈতিক প্রশ্নবোধক মোড তৈরি করে । লেখার বিষয়ে বাস্তবতার এক আধিক্য দেখা যায়, গল্পটি, বাস্তব যেখানে অ-বাস্তব ( non-real ) হয়ে ওঠে সেই সন্ধিক্ষণ-বিন্দুটিকে তুলে ধরে । পাটনা সচিবালয়ে রিক্সা করে পেনশন তুলতে যাওয়ার সময় কথক সুকুমারের দেখা হয়ে যায় স্কুলজীবনের বন্ধু শ্রীবাস্তবের ( নামটি লক্ষণীয় ) । এই শ্রী-বাস্তব

তাকে মানুষবাজারের বাস্তবের কথা শোনায় । এই বাস্তবতা অতীব মাত্রায় বাস্তব হওয়ার মাধ্যমেই অ-বাস্তব হয়ে ওঠে । অনভরকম জীবনের স্বপ্ন দেখা শ্রীবাস্তব বহু দিন আগে মুম্বাই চলে গেছিলো । এতদিন পর দেখা হওয়ায় সুকুমার জানতে পারে যে অনেকদিন যাবৎ মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এক্সট্রা সাপলাইয়ের কাজ করার পর শ্রীবাস্তব এখন রাজনৈতিক মিছিলের জন্য মানুষ সাপলাই করে । সুকুমার যখন জিজ্ঞাসা করে কোন রাজনৈতিক দলের মিছিল, সে জানায় সব দলকেই সে লোক জোগান দেয় কারণ মিছিলে হাঁটার এই এক্সট্রা লোকদের সংখ্যা নির্দিষ্ট ।একই লোকের দল সরকার পক্ষের মিছিলে হাঁটে ; আবার তারাই বিরোধীদের মিছিল আলো করে রাখে। শ্রী-বাস্তব যে সিস্টেমের বর্ণনা করে যায়, কিভাবে সে ‘লিঙ্কম্যান’দের সাহায্যে বেকার লোক ধরে ইত্যাদি — তার মধ্যে দিয়ে এক অরৈখিক অ-বাস্তবতার চিত্রায়ণ সম্পূর্ণ হয় ।

সমীর রায়চৌধুরীর কথক লেখক হওয়ায় তাদের কথোপকথন সাহিত্যের রাজনীতিকে যুক্ত করে সিনেমার এক্সট্রা আর রাজনৈতিক এক্সট্রা — এই দুই ধরণের অভিনেতার সঙ্গে । ‘অভিনয়’ বা পারফরমেন্সের ধারণাটির মাধ্যমে লেখক, সাহিত্যিকদের ‘মানুষবাজারের’ জগতের কাছে নিয়ে আসেন । শ্রীবাস্তব বলে : “তোদের লাইনে যেমন একজন লেখক আর টেক্সটের বক্তব্য এক নাও হতে পারে।” তাদের বিনিময়ে প্রকট হয়ে ওঠে মানুষের ভাষার আড়ালে নিজেকে লুকোনোর শৈলীর কথা যা মানুষবাজারে অভিনয়কে সর্বব্যাপী করে তোলে । দুই বন্ধুর ডায়ালগ এক উত্তর-রাজনৈতিক ( post-political ) বাস্তবতার ছবি তুলে ধরে যেখানে আদর্শ মৃত এবং মানুষ মুক্ত-অর্থনীতির বাজারের অদৃশ্য, অভিন্ন, ক্রমিক পণ্য-সংখ্যায় পর্যবসিত হয়েছে । ‘মানুষবাজারের’ এই উদ্বৃত্ব মানুষরা যতটা বাস্তব, ততই অবাস্তব । তারা সেই নিবেশপথ যার মধ্য দিয়ে বাস্তবতা আত্মবিনির্মাণ ঘটায় । এই গল্পটি তাই অতি-বাস্তবতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাকে অ-বাস্তবের কাছে নিয়ে আসে ।  এই অপারেশন রাজনৈতিক বাস্তববাদ এমনকি তার সাহিত্যিক অভিনয়সুলভ ভেক ধরাকেও সমালোচনা করতে ছাড়ে না ।

 

মেথিশাকের গন্ধ

সমীর রায়চৌধুরী নিজেই লিখেছেন ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পের কেন্দ্র হল অন্ধকার।’ গল্পের শেষে একটি ছোট্ট নোটে তিনি জানিয়েছেন যে সচেতনভাবেই মানুষকে কেন্দ্রচ্যূত করে অন্ধকার নিয়ে গল্প লিখতে চেয়েছেন । বাস্তবতা যদি মানুষকে বাস্তবদ্রষ্টার ভূমিকা থেকে বিচ্যূত করে তবে এমন এক রিয়্যালিটি তৈরি হয় যা নন-হিউমান । এই নন-হিউমান রিয়্যালিটিই কি ‘মেথিশাকের গন্ধ’-র নব্যবাস্তবতা । লোডশেডিঙের নিকষ অন্ধকারের মধ্যে কথক রান্নাঘরে ব্যস্ত স্ত্রী শেফালির দিকে আস্তে আস্তে এগোতে চাইছেন । অন্ধকারে মেথিশাকের গন্ধই তাঁর গাইডিং থ্রেড । হাতড়াতে হাতড়াতে কথক স্পর্শ করে চলেছেন বাড়িতে অনেকদিন ধরে জমতে থাকা ‘বিষয়-সম্পদ’ । অ-মানবীয় এই সব জিনিসের বিবরণ এই গল্পের বাস্তবতাকে উত্তর-মানবতার ( posthuman ) ইশারায় বোধিত করেছে । অন্ধকারের স্পর্শ-গন্ধের মধ্যে মানুষ-কথকের স্মৃতি অন্ধকারকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছে । ছোটবেলায় বড়োরা বলতেন, অন্ধকারে দত্যি-দানো থাকে, আবার কোনো কাছের মানুষ মারা গেলে বলা হতো সে অন্ধকারের দেশে চলে গেছে । এইভাবে কথকের মানব স্মৃতিতে অন্ধকার ভয় আর উষ্ণতার যুগপৎ চিহ্ণ হয়ে উঠেছে ।

লোডশেডিঙের সূত্রে লেখক এই গল্পের অন্ধকারকে সমাজবিদ্যার চোখে দেখেছেন । স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের প্রসঙ্গ এসেছে, এসেছে তাদের ব্যবস্হা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের কথা । উঠে এসেছে অন্ধকারে চুরির ভয়ের কথা, লোডশেডিঙের রাজনীতি : “এটা আবার মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা, তাই লোকে যাতে মনে না করে নিজের এরিয়ায় তিনি বেশি কাজ করছেন, তাই খুব একটা পাবলিক-ওয়র্ক এলাকায় হয় না । আর যাই ওক পার্টির এসব নির্ভীক সততা আছে।” রাজনৈতিক স্যাটায়ারের হাত ধরেই স্পষ্ট হয়েছে আরেকটি বিদ্রূপ : “তবে একটা ব্যাপার সুখের । নিয়মিত লোডশেডিঙ  হওয়ার ফলে জেনারেটরের ব্যবসা, মশার রকমারি ওষুধপত্তরের বিক্রিবাটা, মোমবাতি আর ব্ল্যাকে কেরোসিন ইত্যাদির ব্যবসা বেড়েছে । কিছু বেকার ছেলের তবু যাহোক হিল্লে হয়েছে।”

‘তমসা নদীতীরে’ বাল্মীকির আশ্রমের উপমায় অন্ধকারের আর্থসামাজিক তথা রাজনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি স্হান পেয়েছে তার মিথিকাল বাস্তবতা । এই প্রাতর্কিক অবতারণার মধ্য দিয়ে গল্পটি অন্ধকারকে সৃজনশীলতার দিকে নিয়ে গেছে ।

“কবিতার জন্ম হয়েছিল এই নদীতীরে, আরও সহজ করে বলা যায় মানুষ নামের প্রাণীর কবিত্বের জন্ম এই তমসা তীরে । যে কবিত্ব এই প্রজাতির চালিকাশক্তি । বিজ্ঞানীরা অবশ্য ব্যাপারটাকে বলেন, দ্য গ্রেট অ্যাবাউট টার্ন । গন্ধ শব্দ স্পর্শ এভাবে একটা মাত্র বৈশিষ্ট্যের পথ না বেছে নিয়ে সবদিকে সচেতন হওয়ার মন । আর এই মনের প্রশ্রয় তমসাকে ভয় করে ।”

এই অন্ধকার ইন্দ্রিয়জ । এখানে স্পর্শ-গন্ধের পাশাপাশি প্রখর হয়ে ওঠে শ্রবণ । শেফালির স্হির হয়ে থাকার সাবধানবাণী থেকে রান্নাঘরে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ — এই অন্ধকারের বাস্তবতা গভীরভাবে সংবেদী । অন্ধকার বর্তমান থেকে অতীতের দিকে স্মৃতির প্রসারপথ খুঁজে নেয় :

“বেশ জমাট অন্ধকার । সবকিছু একাকার হয়ে গেছে । আকারের যে হট্টগোল আমার আকারটুকু সায় দিয়ে রেখেছে সেই সবকিছু অন্ধকারের মধ্যে লোপাট হয়ে গেছে । এই অন্ধকারে আমার সম্বল ওই মেথিশাকের গন্ধ আর শেফালির কন্ঠস্বর । মেথিশাক দিয়ে বেগুন না মেথিশাক দিয়ে শেফালির কন্ঠস্বরের ব্যঞ্জন, এই মুহূর্তে ঠিক কী বলা যাবে ! মেথিশাকের গন্ধে মাথিশাকের শরীর ছাপিয়ে এই জীবনের আরও কতো কি যে ক্রমশ সেঁধিয়ে গেছে । ছোড়দি ভালোবাসত মেথিশাক দিয়ে শুকনো-শুকনো কইমাছ । মা মেথিপাতা শুকিয়ে রাখতেন, ফোড়ন দেওয়ার জন্যে কিংবা মুগডালে দিতেন।”

‘মেথিশাকের গন্ধ’ কথকের নিজের ভাষাতেই ‘অন্ধকারের স্হানিকতা’র কাইনি । স্ত্রী শেফালির বারন সত্বেও কথক অন্ধকারে নিজের বাড়ির স্হানিক পরিসরটিকেই পুনরাবিষ্কার করতে-করতে এগোতে থাকেন । এই পুনরাবিষ্কার তাঁর জীবনচর্যার  পুনরানুশীলনও বটে । দেওয়ালে টাঙানো ছবির কথা ভাবতে-ভাবতে তিনি ফিরে যান কয়েক দশক পিছনে, তাঁর জীবনব্যাপী বাড়ি বদলের ইতিহাসে । পুরোনো বাড়িতে আত্মপ্রকাশের নানা স্মৃতি ভর করে থাকে এই ইতিহাস । গুরুজনের ইচ্ছা পূরণের জন্য সাধের পায়রাদের কেটে ফেলার কষ্ট এসে মিশেছে এই অন্ধকারে । ছবিগুলো আঁকিয়েদের কথা বলে, তাদের ভাবনা-চিন্তার কথা বলে । বাঁধন দাশের ছবির প্রসঙ্গে উঠে আসে । ‘বিশ্বায়নে স্হানীয়টুকুর গুরুত্বের’ কথা । এই গল্প ‘স্পেস যেভাবে সম্পর্ক গড়ে’ তার দলিল । এই স্হানিক বাস্তবতার স্হানীয় রং বিশ্বয়নের ‘গ্লোকাল’ ( গ্লোবাল+লোকাল ) স্পেসের বাস্তবতাকেই যেন ধরতে চায়।

ব্যক্তিক ইতিহাসের আটপৌরে ঘরোয়া অন্ধকার কথকের কাছে জীবিত-মৃত ‘প্রিয়জনের সংসার’ । তিনি অন্ধকারে এগোতে এগোতে অপেক্ষা করে থাকেন কখন মেথিশাকের গন্ধ গিয়ে ‘শেফালির উপস্হিতির জৈব গন্ধ’-এ মিশবে । সেটাই তাঁর গন্তব্য । তাঁর ‘হদিশ’ । গল্পটি শেষ হয় বাড়ির অন্যান্য বিষয়-আশয়ের মধ্যে লালিত এই অন্ধকারকে গার্হস্হের অনিবার্যতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে । গল্পটি অন্ধকারকে অ-মানবীয় করে তুলতে পারে না, বরং তাকে মানুষের চোখ দিয়েই দেখে শেষ পর্যন্ত । অন্ধকার এখানে মানবায়িত হয়না কিন্তু প্রভাস পায় মানবদৃষ্টির আয়নায় । গল্পটি এখানে স্বঘোষিত উত্তর-মানববাদী ইশারাকে বিনির্মিত করে ফিরে আসে অন্ধকারের সঙ্গে মানব-সম্পর্ক স্হাপনের প্রেরণায় । এই গল্পের বাস্তবতা তাই কোনো সহজ সরল জাদু বা পরা-বাস্তবতা নয় । বাস্তবতা এখানে তার মানবীয়, অমানবীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, পৌরাণিক — এমন নানান স্তরের স্মৃতি-তর্পণকে আধার করে গড়ে ওঠে ।

 

গান্ধারী-পুং

বাস্তবতা কি তা-ই আমরা আমাদের চোখ দিয়ে দেখি ? শেষ আলোচ্য গল্প ‘গান্ধারী পুং’ এমনই এক প্রশ্ন উস্কে দেয় । লেখক-কথকের স্ত্রী শেফালির চোখে অস্বস্তুি শুরু হওয়ার মুহূর্ত থেকে গল্প শুরু হয় । শেফালি ভাবেন চোখে বালি পড়েছে কিন্তু কথক বুঝতে পারেন “বাইরের কিছু নয়, ভেতরের কোনো উদ্রেক” । বাস্তবতাও কি এমন নয় ? বাইরের কিছু নয়, ভেতরের কোনো উদ্রেক ? লাফিং ক্লাব থেকে সদ্য বাড়ি ফেরা শেফালির চোখে যখন তাঁর স্বামী ‘টিয়ার্স ড্রপ’ দেন, তখন বাস্তবতা ইন্দ্রিয় থেকে অনুভূতির পথে হাঁটে আর হাসি-কান্নার ভারসাম্যে জীবনকে ছুঁয়ে যায় ।

গল্পটি মেডিকাল ডিটেইলিঙের মাধ্যমে যে শুধু বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠে তাই নয়, শেফালির চোখের সমস্যা, নেত্রনালিতে অবরোধ, এবং ক্রমশ এগিয়ে আসা অন্ধত্বের ব্যক্তি ইতিহাস বৃহত্তর  সমাজ-বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশ দূষণের সূত্র ধরে :

“চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সারা বিশ্বে আধুনিক উন্নয়নজনিত প্রদূষণের ফলে এখন প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ পরিবেশগত কারণে অন্ধ ; প্রতি বৎসর এই সংখ্যা উর্ধ্বগামী । অবশ্য এই পরিসংখ্যান কেবল সেইসব পেশেন্টকে নিয়ে যাঁরা চিকিৎসালয়ে গেছেন, চিকিৎসক দেখিয়েছেন । ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের পরিসংখ্যান নেই । এদেশে আর্থসামাজিক কারণে অধিকাংশ মানুষের বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়ার সামর্থ নেই । কিছু-কিছু  চিকিৎসক স্বয়ং এই ব্যাপারে তৎপর হয়েছেন । আজকের জীবনযাত্রা আর রাষ্ট্রব্যবস্হার কারণে মানুষ স্বাভাবিক সংবেদনশীলতা হারাচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় ।”

লেখক গল্পের ভেতরে ন্যারেটিভকে থামিয়ে যেসব প্রাতর্কিক চিন্তাপ্রবাহ চালনা করেন তার আরেকটিতে স্হান পায় মহাভারতে গান্ধারীর অন্ধত্ব, মহাকাব্যিক যুগে মানুষ এবং প্রকৃতির নৈকট্য উত্তরঔপনিবেশিক সময়ে পরিবেশ বিজ্ঞানের মাধ্যমে সেই নৈকট্যের জরুরি পুনরুদ্ধার — ইত্যাদি নানা আইডিয়া । গান্ধারীর অন্ধত্ব বাস্তবতাকে ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার বাইরে সংবাহিত করে : “তিনি চাক্ষুষ দেখা থেকে সরে গিয়ে অনুভূতির দেখাকে শ্রেয় মেনে বেছে নিয়েছিলেন ।” অন্ধত্বের পপসঙ্গে স্মৃতিপথে চলে আসে অন্ধ কবি সুরদাসের কথা, যাঁর গানে দর্শকশ্রোতার অশ্রুপাত বাস্তবতাকে আবেগায়িত করে । ইন্দ্রিয়োত্তর এই বাস্তবতাকে ম্যাজিক রিয়্যালিজম বলার প্রয়োজন নেই । রিয়ালিটি যতোটা ইন্দ্রিয়ের বাইরে ততটাই শরীর ও মনের  ভেতরে । রিয়ালিটি এই দুইয়ের সংযোগস্হল ; ভিতর ও বাহিরের সংলাপকেন্দ্র ।

‘গান্ধারী-পুং’ বিভিন্ন অত্যাধুনিক চক্ষু চিকিৎসার ডিটেইলিঙে পৌরাণিক বাস্তবতার  এক বৈজ্ঞানিক তথা সাংস্কৃতিক অনুবাদকে তুলে ধরে :

“আমাদের প্রজন্মে জানতাম ‘ত্রিনেত্র’ একটি দার্শনিক…আধ্যাত্মিক টার্ম । অথচ আজ তা বিশ্বস্তরে পেটেন্টের অন্তর্গত চিকিৎসাবিজ্ঞানের টার্ম ; বাস্তব, চাক্ষুষ একটি যন্ত্র । রোগের কারণ হয়ে ওঠা নিত্যনতুন নিরাময় আবিষ্কার আজকের জীবনে বাধ্যবাধকতা ।”

শেফালির চোখ সেরে ওঠে । অধুনান্তিক গান্ধারী অন্ধ হয়ে যান না । আর তাঁর পুং কথক ‘কান্নাহাসি যখন একই সঙ্গে ঘটে’, ‘রোদবৃষ্টি বুননে’ সেই প্রবল অনুভূতির ‘রামধনু’ দেখতে পান । টিয়ার্স ড্রপ  তার লাফিং ক্লাব খুঁজে পায় আর অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পায় বহির্দৃষ্টিকে । এই দুইয়ের সন্মিলনে গড়ে ওঠে অনুভূতিপ্রবণ এক বাস্তবতা।

সমীর রায়চৌধুরীর গল্পগুলির বহুমাত্রিক বাস্তবতাও এমনই এক রোদবৃষ্টির রামধনু যেখানে ব্যক্তিবাস্তবতা সমষ্টির বাস্তবতাকে ছুঁয়ে থাকে । এই বাস্তবতা বর্তমান ও ভবিষ্যতের চেহারায় পপাচীন ও অতীতের নবরূপে প্রত্যাবর্তন চি্‌হ্ণিত করে । ব্যক্তিগত পরিসর এই স্তরায়িত বাস্তবতায় রাজনৈতিক হয়ে ওঠে । লেখক এই তিনটি গল্পে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের কোনো প্রত্যক্ষ প্রকরণ বা উপাদান ব্যবহার করেননি ; বরং বাস্তববাদী ঢঙেই বলার চেষ্টা করেছেন গল্পগুলিকে । আখ্যান যেখানে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে লেখকের চিন্তাপপতর্ক দিয়ে সেখানে গল্পগুলির বাস্তববাদ ইডিওলজির উদ্রেকে তুলে ধরেছে এক রাজনৈতিক বিন্যাস । এই রাজনৈতিক বিন্যাস রিয়্যালিটির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে । এর ফলে এই বাস্তববাদের ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে প্রতি-বাস্তবতার ( anti-reality ) একাধিক প্রস্হানবিন্দু ।

( দমদম জংশন পত্রিকার জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত )

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন