বন্দী শিবিরের কথামালা

অলোক গোস্বামী
তোমাকে গান শোনানোর কথা ছিল। এমন এক, গান যাতে ঝড়-বিদ্যুতের শব্দ,বেয়নেট,
হুইশলের তীব্র শ্লেষ, বারুদ গন্ধ, কিচ্ছু থাকবে না।
যেহেতু নদীর প্রতি উভয়েরই দুর্বলতা তাই সুরে মৃদু ছলাৎছল, একটু আধটু নাবালক ঘূর্ণি,
বাতাসে পাল ওড়ার শব্দ ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখা যেতে পারে। তাবলে ব্যান্ডের ভাটিয়ালি অথবা
ভায়োলিনে দাঁড়ের শব্দ অথবা স্প্যানিশ গিটারে জলকে চল,একদম নয়।
শর্ত ছিল সে গানের কোনো স্বরলিপি থাকবে না। মাত্র একবার ব্যবহারের পরই সে সুরের জীবনকাল শেষ হয়ে যাবে।
তথাস্তু। এসব তেমন কষ্টকর কিছু ছিল না। যেটুকু সুরের অভাব হোতো আশা রাখি, ধার পেতাম।
এ জীবনে তো কতই ঋণ! শুধু হাত পেতে যাওয়া, ভবতি ভিক্ষাং দেহি।
প্রস্তুতিও ছিল ঠিকঠাক কিন্তু এরপরই তো শোনানোর পালা। কোথায় বসবে আমাদের আসর?
আমাদের দেখা হবে কোথায়? কখন খুলবে বুলন্দ দরওয়াজা?
নালিশ কিম্বা প্রার্থনা জানিয়ে লাভ নেই। আমার দুনিয়া এখন পুরোপুরি বধিরদের দখলে।
বাতাসে এখন সুরের স্পর্শটুকুও নিষিদ্ধ।
ধরুন, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ আমার লেখা অথচ দূর থেকে ভেসে আসা অকাল আষাঢ়ে
ভিজে চুপচুপে রবীন্দ্রনাথ দরজা বন্ধ করে ভাবছেন, তবে কি বন্দরের কাল হলো শেষ!
ধরুন, ‘আমরা সবাই রাজা’ আমার লেখা। শুনতে শুনতে তাল ঠুকতে ঠুকতে
রবীন্দ্রনাথ ভুলেই যাচ্ছেন দুর্যোগ কেটে গেলে একটা অন্ততঃ তথ্য খুঁজে প্রমাণ দিতে হবে যে এপারেই জন্মেছিলেন।
ধরুন, ‘জলে স্থলে বাজে বাঁশী, ভালোবাসি ভালোবাসি’ লিখেছি আমি
আর কাগজের প্রথম পাতায় ধর্ষনের পর নৃশংস খুন হওয়া সদ্য কিশোরীর বিকৃত লাশ দেখতে দেখতে
গরম চা ড্রেসিং গাউনে ফেলে ঝলসে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ।
কিম্বা ধরুন…….
থাক কতই বা আকাশ কুসুম অহেতুক বপন করা যায়! এখানে বরাদ্দ শুধুই রেশান জীবন।
বেঁচে যাওয়া কেন এত দুঃসহ হলো!
৩.
শুনেছি কাল থেকে সব দুঃখের অবসান। সাঁজোয়া যত্নে প্রকৃতিপাঠ শিবির থেকে অপরাধ শিবিরে আনা হবে রানিদিকে।
উনি আমাদের চিনিয়ে দেবেন অদ্ভুত সেই লজ্জাবতী গাছ যা শুধু স্পর্শ পেলেই প্রস্ফুটিত হয়।
শোনা যাচ্ছে সে মূলেই নাকি অনিবার্য প্রতিষেধক আছে। ব্যস, তারপরই অনন্ত জীবন।
ভালোবাসা আলো বাতাসের কথা বলতে ইদানিং কুন্ঠা হয়। বুঝতে পারছি কিছু ঋণ খেলাপই রয়ে যাবে।
থাকুক। সঙ্গে থাকুক অনেক অমীমাংসা। বিতৃষ্ণার চে’ স্মৃতি ভালো। ভাবা ভালো, আমি যে গান গেয়েছিলেম।
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় শূন্যস্থানে ফিরে আসার আকাঙ্খা থাকতে নেই।
এই যে বেঁচে আছি একাকী মুহূর্তের দীর্ঘশ্বাসে, এই বা কম কী!
বেঁচে থাকা দীর্ঘজীবী হোক। তাই আপাততঃ শুধু গোছাচ্ছি। গুছিয়ে রাখছি চারপাশ।
ছাইপাঁশ। স্মৃতিবাক্সে পাল্টে দিচ্ছি গন্ধ ফুরিয়ে যাওয়া ন্যাপথলিন।
পুরনো প্রেমপত্রগুলো রোদে দিচ্ছি প্রতিদিন।
হয়তো এসব কিছু নয়। হয়তো কিছুই নেই এসবে। তবু যেন সবকিছু ক্রমাগত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা।
৫.
বন্ধুবৃন্দের অনেককেই দেখেছি চুমুক দেয়ার আগে গ্লাসে গ্লাস ঠুকে ‘চিয়ার্স’ বলতে।
আবার কারো কারো প্রিয়, সাদা বাংলায়, ‘ উল্লাস’। দুটোর কোনটাতেই আমি খুব একটা সড়গড় নই।
আজও প্রথম চুমুকের সঙ্গে চোখে জল আসে, উঠে আসে তীব্র জ্বলন।
অন্য হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিতে নিতে এই দহনকে কি দান ভাবা যায়!
৬.
শরীরে জলতরঙ্গ বেজে উঠলে কেউ কি মৃত্যুর কথা ভাবতে পারে! মনে পড়ে পূর্ব দহন?
আমি তো সূর্য নই যে পুষে রাখা আগুনে প্রতিপলে নিজেকে পুড়িয়ে পান করে যাবো সান্ত্বনা।
বরং জরা এলে ছলে বলে বদল করে নেবো অনন্ত যৌবন। এ যদি অন্যায় হয়, হোক। জয় মোহমায়া।
জয় আবেগ শৃঙ্খল। জয় অলাতচক্র। ওঁ মধু। ওঁ মধু। ওঁ মধু।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন