কাব্যগ্রন্থঃ- চোখ : অন্তর্জাল 
কবিঃ- সমরেন্দ্র রায় 
প্রকাশনীঃ- কবিতা পাক্ষিক 
প্রচ্ছদঃ-বিভাবসু
রূপায়ণঃ- শৈবাল নায়ক
প্রকাশ কালঃ- ২০১৯ কলকাতা বইমেলা 
মূল্যঃ- ১০০/-

যুদ্ধক্ষেত্রে কবিতা লেখেন যিনি
রাজর্ষি মাইতি

পৃথিবীব্যাপী সাহিত্যের দুনিয়ায় নজির সৃষ্টিকারী 'কবিতা পাক্ষিক ' এর প্রাণপুরুষ ও পোস্টমডার্ন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ প্রভাত চৌধুরী কবিতার ধারণা প্রসঙ্গে বলেছেন, "যা লেখা হয় তাই কবিতা, আর যিনি লেখেন তিনিই কবি। " এর পরেও অবশ্যম্ভাবীরূপে এলিট কলমচিদের মঞ্চে বিরুদ্ধতার গগণসঙ্গীত বাজতে থাকবে কবির গোত্রমান নিয়ে। আড়ালে আবডালে ধোপদুরস্ত, মফসসল থেকে শহরমুখীরা কেতাবি ছকে মাইক্রোসার্জেন  হয়ে উঠবে প্রাচীন কাব্যদর্শন জ্ঞানের ভুয়া মাহাত্ম্যকে পাশবালিশ করে। নিজেকে কুলীন প্রমাণ করতে অন্যের অন্তর্জলি যাত্রা উপভোগ করবে। কিন্তু চাকা আর সময় দুই-ই যে ঘূর্ণায়মান! তাই জীবন তাকে যতই অগ্রদানী হতে নির্দেশ দিক না কেন, সরস্বতী যেন ভবিতব্য মেনেই তাঁর নামাঙ্কিত বিজয়মালা গেঁথে রেখেছেন। কার সাধ্য তাঁর কলমকে গোল্ডেন -হ্যান্ডসেকের পথ দেখায়। 
                     সূর্যোদয় থেকে পড়ন্ত বিকেল পর্যন্ত যার চর্কিপাক কেবলমাত্র জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। বিস্ময়কর ধুলোঝড়ে যার প্রতিটি আগামী অদৃশ্য যন্ত্রণার রূপকথা লিখে চলে, সেই মানুষটির প্রায় তিন দশকের কবিতা যাপন যেন আক্ষরিক অর্থেই তথাকথিত এলিট -কূলকে উচিত শিক্ষাদান। 

      সমরেন্দ্র রায়, যাঁর পরিচিতি মাষ্টারদা নামে হলেও আমার কাছে এক এবং একমাত্র সমরদা। যিনি একাধারে কবি, নাট্যকার ও প্রায় তিন দশক অতিক্রান্ত 'সমিধ' সাহিত্য পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সত্তরোর্দ্ধ মানুষটি যেন এক চলমান বিস্ময়। অবশ্য হবে নাই বা কেন!  সুপার হাই ব্লাডপ্রেশার যার স্বাভাবিক রক্তচাপ, তার কাছে ক্ষণিকের সমালোচনা বা বিপক্ষীয় কূটনীতিকদের তির্যক বিশ্লেষণ যেন শীতরোদে পিঠ রেখে কমলালেবুর রসালো কোয়ায় ঠোঁট ভেজানো। সমরদাকে যত দেখি ততই মনের নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারের প্রদীপ তেজোদ্দীপ্ত হয়। আপাদমস্তক সাধারণ মানুষটির অন্দরমহলে টোকা দিলে খুলে যায় অগণিত রোমাঞ্চের দরজা। যেখান থেকে প্রতিনিয়ত ভেসে আসে আপণজনের ভালোবাসার সুবাস। ঘোর লাগে, মোহাচ্ছন্ন হয়ে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তাঁর সৃজন সরোবরে। 
ঘোর ভাঙে যখন মগ্নতার ছন্দপতন ঘটে কবির কলমের আঁচে। চোখের তারায় অন্তর্জালে আটকে পড়ে হাজারো ভাবনা। দোল খায়, ভাবসাগরে ক্রমাগত বুদবুদ ওঠে অসংখ্য প্রশ্নের। পাঠক মন হোঁচট খায় কবির কথায় -"এখনও আমরা বর্ণমালা শিখিনি ;বর্ণ কী তাও জানিনা ইচ্ছেটাকে হারিয়েছি। ইচ্ছেরা আলো হয়ে খেলা করে তাদের সাথে। "
(অপরাজীবন)
                     শেখার ইচ্ছে যে ডিজিটাল যুগেও প্রবীণ কবির এতটুকু কমেনি, তার নির্যাস হলো 'অবভাস' কবিতাটি। পুতুল নাচের জাদুকরের মতো কবির স্বগতোক্তি, " সে জন্যই নিজেকে চেনার আগেই অভ্যাসটাকে চিনে নিতে হয়। " সময়ের দোলাচলে ঘাসের উপর ঝরে পড়া পাতাদের সাথে কবির মনে বেঁচে থাকে সৃজনের বংশধর। বৃষ্টির আদুরে ছোঁয়ায় সোঁদামাটির গন্ধ মেখে পেন্ডুলামের মতো দোল খায় কবি ভাব। শৈশব আর বার্ধক্যের মাঝে উদোম চরাচরে কবি সমরেন্দ্র রায়ের খেদোক্তি, "এউ মুহূর্তে আর পিছনে ফিরবো না। রেখে যাবো অস্থির ছেলেবেলা হিমজাল জড়ানো বাস্তবতা। " 
(হিমজাল) 
যে মানুষটার জীবনের প্রতিটি দিন কুরুক্ষেত্র, তাঁর চোখেও বিষন্ন ঘুমের বিছানা ছেড়ে 'স্বপ্নেরা ইদানিং রাস্তায় নেমে এসেছে। ' দেহতটে বয়ে চলা ইছামতী নদীর স্রোতে যে তরল সংকেত কবিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পুড়ে যাওয়া রোদ-ছবির কাছাকাছি সেখানে অবকাশ ছাড়া আর কিছুই নেই। নির্বাক রোদে পোড়া মাটির গন্ধ চাটে পলকহীন আবেগ। একটানা চেয়ে থাকতে থাকতে কবি মনে হঠাৎ খেলে যায় একপ্রস্ত আনন্দ। আবার নিমেষে সামলে নিয়ে বলেন, 'পিছু ধাওয়া এক অবাক তাড়না। ওখানেও বাসা বাঁঁধে ঘুনপোকা, ঘঘরভাঙাকীট। '

কবিতা পাক্ষিক থেকে প্রকাশিত সমরেন্দ্র রায়ের কাব্যগ্রন্থ 'চোখ অন্তর্জাল ' পড়তে পড়তে যে নিদারুণ প্রকৃতি চেতনা, জীবনের অনুভূতির বর্ণনাময় সম্ভার পাঠকের প্রক্ষোভকে জাগিয়ে তোলে তা জীবাশ্মের ন্যায় বহুকাল স্মৃতির দেরাজে সঞ্চিত থাকবে। সাবলীল শব্দালাপ, বিষয় ও ভাবনার বৈচিত্র‍্যে পাঠকমহলের সুখপাঠ্য স্বীকৃতি প্রাপ্তি কবির বহুপূর্বেই ঘটেছে। একজন গুনমুগ্ধ অনুগামী ও পাঠকরূপে প্রার্থনা করি আজীবন লড়াকু সমরেন্দ্র রায়ের সুস্থ ও দীর্ঘায়ু জীবন। 
                    

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন