রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা : কবি সুভাষ  মুখোপাধ্যায় 
সংযুক্তা পাল 

পর্ব-২

    রবীন্দ্রপরবর্তী সময়ের দাবিকে আত্মস্থ করে স্বতন্ত্র চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটালেন জীবনানন্দ, যা সাহিত্য তথা কবিতায় এক ভিন্ন ধারার সূচনা করল এবং 'আধুনিক' হিসেবে গণ্য হল, যদিও শব্দটির মধ্যে যথেষ্ট স্ব-বিরোধ বর্তমান কারণ প্রত্যেকেই তাঁর নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে আধুনিক। জীবনানন্দের কবিতায় তাঁর ব্যক্তি-মানস সময়-কালের হাত ধরে অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে এক অমোঘ 'কল্পনাপ্রতিভার' স্ফূরণ ঘটাল।
           
     ঐতিহাসিক প্রহেলিকার গোপন সুড়ঙ্গপথে মগ্নতা ও ব্যাপ্তি নৈর্ব্যক্তিক রূপে আয়ু পেল বাংলা কবিতায় যা বিষণ্ণতা , ধূসরতার পরত ভেদ করে সৎ ও সুন্দরের জন্ম দিল।একান্ত জীবন নির্ভর ম্রিয়মাণ যে আলো তা অন্ধকারকে বাদ দিল না, বদলে ফেলল ঐকান্তিক শব্দযাপনে। কবিতায় নারী এল চেতন-অচেতনের দোলাচলতায়, নির্নিমেষ ধূসরতায়,শিল্পীর চোখে আঁকা স্থাপত্যের সংবেদনশীল আশ্রয় , স্পর্শকাতর ফসলের শান্তির আকাঙ্ক্ষা হয়ে।
           জীবনানন্দের নারী ভাবনায় মিশে আছে অনস্তিত্ব-বোধের থেকে অস্তিত্বের দিকে যাত্রা। ইতিহাসপথযাত্রী কোনো নাবিক ব্যাবিলন,মিশরের ধূসর প্রান্তরে কিংবা নাটোরের অন্ধকারখচিত কোনো রত্নমহলে যে নারীকে স্পর্শ করতে পারে হয়তো শরীরে নয়...ঘ্রাণ দিয়ে, চৈতন্য দিয়ে,এক ধ্যানমগ্ন সময়ের দর্শন দিয়ে।
'শ্যামলী তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন;/যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল/সূদূর নতুন দেশে সোনা আছে ব'লে/মহিলার প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল/টের পেয়ে,দ্রাক্ষা দুধ ময়ূর শয্যার কথা ভুলে/সকালের রুঢ় রৌদ্রে ডুবে যেত কোথায় অকূলে।'
'সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন/থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।'
বনলতা সেন আশ্রয়-বাস্তবতা কিন্তু প্রত্যক্ষ বা সম্যক বাস্তবতা নয়,দূরাগত প্রতিধ্বনির মধ্যে থেকে ভেসে আসা কোনো সাংকেতিক, সাংগীতিক মূর্ছনা। যে রূপসীদের তিনি এশিরিয়ায়, মিশরে,বিদিশায় মরে যেতে দেখেছেন তাদেরকেই আবার কোনো একসময় 'দীর্ঘ বর্শা' হাতে নিয়ে আকাশের কুয়াশা ঘেরা সীমানায় কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন—কেন?
'মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?/জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?/প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?/আড়ষ্ট–অভিভূত হয়ে গেছি আমি'

শানবাঁধানো পুকুরঘাটে কিংবা নিকোনো মেঝেতে বসে এঁটো বাসন মেজে চলা বা আনাজ কুটতে থাকা কোনো নারীকে ব্যক্ত করতে চেষ্টা করেননি জীবনানন্দ কারণ তা তাঁর নান্দনিক-বোধের পরিপন্থী ছিল; কিন্তু মৃত্যুর বিপরীতে জীবনের অভিমুখে, প্রেমের ভয়াবহতায় এ নারী থেকে যায়। মৃত্যুর পরে অনেক জন্ম ধরে এই নারীসত্তার আবর্তন দিকচক্রবালে যা কবিকে আড়ষ্ট এবং অভিভূত - দুইই করে। আমাদের অর্ধমৃত সত্তা বেঁচে থাকার প্রবল যুদ্ধে 'যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে' ও অমৃত সূর্যের' সন্ধান পায়;এই বিপ্রতীপতার সেতুও রচনা করে জীবনানন্দীয় নারী।
'একদিন ম্লান হেসে আমি/তোমার মতন এক মহিলার কাছে/যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হ'তে গিয়ে/অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে/শুনেছি কিণ্ণরকন্ঠ  দেবদারু গাছ,/দেখেছি অমৃত সূর্য আছে।'
'সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সবিতা,সুচেতনা নারীরা যেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভঙ্গুর রূপের চেয়ে হৃদয়ের আলো বা অন্ধকার ধূসর হয়েও উদ্ভাসিত ও দৃঢ় হয়েছে।... তাদের নিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের সমুদ্রতীরের সভ্যতা, যুবাদের ঈপ্সা, অভিমান ও বিষাদ ,রাত্রির অন্ধকার আর ভোরের আলো উত্তোলন হয়ে আছে। তাদের সঙ্গ, অস্তিত্ব ও আকর্ষণ ক্রমশ আমাদের চেতনায় সৃষ্টির অর্থ, মানুষের যাত্রা ও জন্মের অর্থ স্পষ্ট করতে থাকে:'('জীবনানন্দের কবিতায় নারী'/দৈনিক জনকন্ঠ/লিটন আব্বাস-নভেম্বর ২৩,২০১৮)

পাশ্চাত্যের 'হিউম্যানিজম্' তত্ত্ব বা দর্শন অনুযায়ী চিন্তাশীল মানুষ 'আমি চিন্তা করি' অতএব 'আমি হই' থেকে নিরীশ্বরবাদী এই 'আমি' কোথাও আমার ভিতরের 'অন্য আমি' র অস্তিত্ব টের পাই যে আসলে 'আমি' রূপ ঈশ্বর, কবি- মানস আসলে জানেন—
'মানুষ কাউকে চায় - তার সেই নিহত উজ্জ্বল/ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল।'
সেই ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করে সাধনার ফল হিসেবে মানুষের এই চাওয়া যতখানি ব্যাপ্তি হয় কর্মে, সংগ্রামে,নত হয় শক্তির কাছে, ঠিক তখনই বিধ্বস্ত সত্তা , হৃদয়ের কাছে ফিরে আসতে চায়। সময়ের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত অস্তিত্ব এই সত্যই জানান দেয়—
'সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয়, কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়,/আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষের গভীর হৃদয়।'(সুরঞ্জনা)

জীবনানন্দের কবিতায় প্রেম তাই পরাবাস্তব, আত্মমগ্ন হৃদয়বেত্তায় ধ্যানলব্ধ নারীত্বের উন্মোচন।
প্রকৃতি, সভ্যতা,মিথ-আসলে একটা সমগ্র জীবন,অখন্ড জীবনবোধকে নারীর সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন কবি। কখনো নির্বিশেষ থেকে বিশেষে আবার কখনো বিশেষের মধ্যে দিয়ে নির্বিশেষের ইঙ্গিত,এ এক অদ্ভুত আলো-আঁধারি,যেন রহস্যের নীল স্রোতে নারীর অবগাহনের ছবি তিনি এঁকে চলেছেন—
'তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো;/এখনো নারীর মানে তুমি,কত রাধিকা ফুরালো।'(মিতভাষণ)
নারী সত্তা তাঁর কাছে প্রকৃতির মতই আবহমান,লোকায়ত অথচ অধরা তাই 'রূপসী বাংলা'র 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি' তে বেহুলা- র ক্লান্তি মর্মবেদন, 'মিতভাষণ' এ রাধিকার অনুষঙ্গ নারীকে বিশেষ সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীভূত করেও করেনা; নারী একইসঙ্গে কখনোবা আমাদের শুভ চেতনার দ্যোতকও— 'সুচেতনা তুমি এক দূরতর দ্বীপ' (সুচেতনা)
কিংবা
         ' তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে/কবেকার সমুদ্রের নুন; তোমার মুখের রেখা আজো /মৃত কত পৌত্তলিক খৃষ্টান সিন্ধুর/অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন;/কত কাছে—তবু কত দূর।' (সবিতা)

সচেতন সক্রিয়তার ওপারে যে অধিচেতনের বাস সেখানে বিলীন হয়ে যাওয়া এই 'সবিতা', 'সুরঞ্জনা' দের সক্রিয় চৈতন্যে ফিরিয়ে আনতে চান কবি।
        'ফিরে এসো সুরঞ্জনা:/নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;'
পরক্ষণেই প্রত্যয়ী কবি নিজেই ঘোষণা করেন নারীর অধিচেতন অস্তিত্ব
       'সুরঞ্জনা,/তোমার হৃদয় আজ ঘাস:/বাতাসের ওপারে বাতাস/আকাশের ওপারে আকাশ'
অর্থাৎ নারী যেন ক্রমশই আর রক্তমাংসের নয়, প্রকৃতির কাছাকাছি তার রূপ:'সুদূরতার, শান্তির ও জ্ঞানের' দ্যোতক।
' তোমার মুখের রূপ যেন রক্ত নয়, মাংস নয়, কামনা নয়,/নিশীথ দেবদারু দ্বীপ;/কোনো দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপ;'(আদিম দেবতারা/'মহাপৃথিবী')

এক অবিন্যস্ত,বিধ্বস্ত, দ্বান্দ্বিক সময়ে দাঁড়িয়ে আধুনিক কবিতা নিজেকে বারবার ভেঙেছে, গড়েছে যেভাবে, যে আশ্রয়কে কেন্দ্র করে ঐ সময়ের কবিরা কেন্দ্রমুখী হতে চেয়েছেন অথচ কেন্দ্রচ্যুত হয়েছেন অসংখ্যবার, সেখানেই জীবনানন্দের কবিতায় সময় এবং অভিজ্ঞতা ও তার সঙ্গে 'কল্পনাপ্রতিভার' সংশ্লেষে , মগ্ন চৈতন্যের ওঠাপড়ায় ইতিহাস ও প্রকৃতির মতই নারীও সেই রহস্যের অন্তর্ভুক্ত যা কবিকে ধরা দিয়েও অধরা। সর্বোপরি জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় স্ব-প্রজ্ঞা ও মণীষার আলোকে ব্রহ্ম এবং সৃষ্টির মধ্যে অভেদকল্পকে দার্শনিক নন্দনবোধে স্থিত করেছেন; সেই একই বোধের দ্বারা নারীকেও সৃষ্টির স্বরূপে আত্মস্থ করে কবিতায় ব্যাপ্তি দিয়েছেন।

'হে আকাশ,হে সময়গ্রন্থি সনাতন/আমি জ্ঞান আলো গান মহিলাকে ভালোবেসে আজ,/সকালের নীলকন্ঠ পাখি জল সূর্যের মতন'

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন