উনুনজুড়ে নৌকাবাইচের ফসিল ওড়ে

অনিরুদ্ধ আলম 

দেহাতীত ম্রুভূমিতে আকীর্ণ দক্ষতা নিয়ে কারা পরিমাপ করে মানুষের জয়-পরাজয়? তিনভাগ ব্যর্থতা আর দুইভাগ সফলতার পাই চার্ট সাতপুরুষে-পরিচালিত পিজার দোকানে কবে পেয়েছিল জনপ্রিয়তা? অনুপ্রবেশকারী অতীত তবুও ছিনিয়ে নিয়ে যাবে কঙ্কালসর্বস্ব দিঘি, নামগন্ধহীন বৃষ্টি, বৈষম্যবিমুখ উচ্ছ্বাস আর বিশ্বস্ত হাতঘড়ি। 


অশরীরী হতে-হতে, কে ওই বিরহী কারিগর তড়িঘড়ি গড়েছে সমীকরণময় আট দরজা নয় কুঠুরি? খুদের শুভ্রতা মাখা আকাশে-আকাশে গুনেছ আজ কয়টি আকাশ অদ্ভুত বিস্ময়ে? সুঁইদানির সঙ্গে গোপনসন্ধিতে কেবলি ছুঁয়ে দেখি সোনামুখী সুঁইয়ের নকশী ঝলক।

   


নিষ্পলক মাটির ছলাকলাহীন উনুনের বুকে চিতার দাবদাহ আগ্নেয়গিরির জ্বালাকেও অতিক্রম করে যায়। খনি-মজুরদের নিমগ্নতাতে গভীর রাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে, প্রচলিত বালিশের বুকে কান পেতে ওর নীরব মুখরতাগুলো মুখস্থ করে যাই। টেলিগ্রাফের সুরেসুরে অগ্রাহ্য হাওয়া থেকে খসে পড়ে কয়লার বস্তা পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কিছু বার্তা। আলো-আঁধারির অগোচরে ওসব পুরে রাখি আমার উপবাসী বুক-পকেটে। দাঁড়াও! বৃষ্টি হলেই এক-বিঘত উচ্চতার কাচজলে আমাদের উঠোনে লুন্ঠিত হবে ভ্যানগগের স্নেহে বিগলিত একটি আকাশ। নৌকা বাইচের মতো গণতান্ত্রিক উৎসবে অঢেল গণজমায়েত হয়ে ওঠে কী অবিরল জলতান্ত্রিক! তা-ই নয় কি? উৎকণ্ঠার স্টিমারে ক’রে অকাল-প্রসূত বার্ধক্যের বন্ধ্যা বালিয়াড়িরাও সুদূর পরাহত। 

ভূলোক-দ্যুলোক ছাপিয়ে বানের পানিতে ভেসে-আসা একটি কেয়াপাতার নৌকো অনেক দিন তুলে রেখেছিলাম আমার মারবেল রাখার অবর্ণনীয় কাঠ-বাক্সে। 


চৌকাঠ পেরুলেই কে-কার বান্ধা-মানুষ? কলসও অনর্থ বোধ হয় অলস পিপাসার কাছে। ভাবতে-ভাবতে, আজো বুঝে ওঠা হয় নি– নিঃসঙ্গ নদী এবং নিভৃত মাঠ কে কতটা এর-ওর পক্ষে বা বিপক্ষে? আমি কি খোলা-বইয়ের পাতা? মেনকা, ওরকম বিভোরতায় কতখানি আমাকে চেয়েছিলে?– কখনো হল না জানা। তোমাকে মনে পড়ার মাধ্যাকর্ষণজনিত রঙ হোক-না আরো রঙিন। 


বেদুইন দুপুর জড়াল অনিল-খোঁচিত রোদ। দেদার রোদ পরেছে উদার ছায়ার নূপুর। সুমেরীয় নূপুর বাজছে টাপুরটুপুর। অভিনেতা পেন্সিল তবে আঁকুক আমার প্রত্যন্ত নিখিল।  


শিথিল জলের শরীর থেকে আঁশটে গন্ধ চেয়ে নিয়ে হোগলা পাতাতে গুছিয়ে রাখতে-রাখতে শের আলী মাঝি ভাবে, পৃথিবী একদিন চলে যাবে মাছ আর গাছদের দখলে। তখন কি আজিজদের মতো দলিললেখক চাকুরি হারিয়ে ভুখানাঙ্গা থাকবে? সকল যুদ্ধবাজ যুদ্ধ ভুলে নদী আর পাহাড় নিয়ে কবিতা লিখতে এঁটেল মাটির মতো সামর্থবান কুমোর হয়ে উঠবে?    


গুমর-বিবর্জিত দরবেশের লম্বা দাড়ির প্রগলভতা থেকে প্রাণিত বটের ঝুড়ি। ভূতলে-লুটানো অমন দ্যোতনা ছুঁয়ে একদিন বুঝেছিলাম– ভুবনডাঙার সব পাতা-পাখি-পাথর একই প্রজাতির ভিন্নভিন্ন পরিপূর্ণতা। কিংবা বেকন কি একান্তে চেয়েছিল– সুপুরুষ সুরাপাত্রের সদর চিত্রকর্ম থেকে উঠে এসে এক-ঝাঁক জলপরি তার অনুগামী হবে? 


সমতটী বৃষ্টির সশব্দ সরোবরে ফুটে-থাকা কিছু জলজ জরির ফুল ঈর্ষার্ত হল কদম বুদবুদের সাফল্য দেখে। বিষণ্ণ যোগিনীদের কৌতূহলে তারা গ’লে-গ’লে ঘুমিয়ে পড়ে পানিসেঁচের আত্মঘাতী প্রযুক্তিতে ভর করে।  


সাদরে শয্যাহীন প্রেমিক মাত্রই ফিনিক্স পাখির কাতরতা-বিদ্যায় পারদর্শী হয়?  


সাঁতারবিদ্যা বুঝি সেলাইঘর-বিবর্জিত মর্ত্যের মজ্জাগত সংশ্লেষ? 


নিঃশর্ত ঘুঘুদের নিঃসঙ্কোচ প্রজাতিসঙ্ঘ থেকে-থেকে তাদের চালাঘরে আয়োজন করে ফাঁদ-চেনা বিয়ষয়ক প্রশিক্ষণ। রাস্তায় কুড়িয়ে-পাওয়া হাজার টাকার সদ্য অচল নোটগুলোতে কেবলি চলকায় ভোকাট্টা ঘুড়ির ঝিলিক। আতসবাজির মতো আত্মহত্যাকেই বেছে নেয় একটি লঙ্গরখানা খোলার প্রবীণ প্রতিজ্ঞা। 


একদিকে টানা বাড়ছে বিশ্ব-উষ্ণায়ন; অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দার অনুতাপ-বঞ্চিত পরশে সূর্যসন্তানরা ভুলে যাচ্ছে রজনীগন্ধার চাষ।


আনুপাতিক ছন্দাবর্তে পড়ন্ত দুপুরের টুপটাপ পংক্তিতে বিকেলের গোলাপ চুপচাপ উঁকি দেয়। দুয়ার-আটা রোদের মতোই নুনজলে ডুবে-থাকা একমুঠো ভাত বড়ো আলস্যে খোঁজে নাই থই গন্তব্য-ভাবনায়। আকাশমণির ব্যবিলনে বয়াতি আলো আরো আলো হয়ে উঠেছিল। উন্মাদের হাতেও পাঁচটি করে আঙুল আছে ব’লে, মাছ ধরতে যায় তামাবিলে তাদের স্মৃতিভ্রষ্ট ছায়া। 


অনসূয়া, মুখবাঁধা বিশ্বাসের জায়াতুতো চরণে কে দেয় সমর্পণের অঞ্জলি? পিঠে কুলো বেঁধে মেরাজদের বাগানবাড়ি পেরুলেই, চিটচিটে রোদে মাখামাখি হই। চোখে পড়ে যাই হোঁদল-কুতকুত কাকতাড়ুয়াটার। হাতের নাটাইটা ওর দু’ হাতে গছিয়ে দিয়ে বলি, ‘আবার নামুক বাউন্ডুলে রেল জংশনের মতো প্রশান্তিময় বৃষ্টির উদ্বেল ফোঁটারা এই ভাটি অঞ্চলে।’


অনাসৃষ্টির কথা আর বলো না! হতে পারে কি– পার্বতী কর্তৃক অনুদানপ্রাপ্ত প্রচ্ছায়া-উৎসব জলতরঙ্গে-আঁকা আলপনা? নির্বাণ-আতিথেয়তায় চিহ্নিত তেলপিঠের স্ফিত বুকে উঁকি দেয় কালিজিরার একটি সরল তিল। একেই কি বলে স্বেচ্ছামূলক মূর্ছা-যাপন? 


কেউ কি বিড়ির চালশে ধোঁয়াতে দীর্ঘায়িত করে সেইসব স্মৃতিচারণ– একদিন মনেমনে বিনা অর্ঘ্যে কত যে স্বর্গ জিতেছি! ফুঁপিয়ে-ওঠা ধোঁয়ার দুইপাশজুড়ে তখনো উড্ডীন শতাব্দীর একজোড়া নীল কবুতর।  


নধর স্বপ্নের ছদ্মবেশে আকাঙ্ক্ষা আর আকাঙ্ক্ষার ছদ্মবেশে স্বপ্ন এখনো আমার আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর আয়োজন শেষ করতে পারে নি। সোয়ান উপত্যকার ত্রাণশিবির ভেবে শুধু দুস্থ নিকষ মেঘেরা এসে ওখানে অবস্থান নেয় বারবার। 


সংস্কারপন্থী লণ্ঠনের টানটান দ্যুতি থেকে ছিটকে-পড়া দোদুল্যরা এখন পোষা উটপাখি হতে চায়। 


নির্দ্বিধায় বুকে-হেঁটে-চলা কিছু বিদ্রূপ উলটপালট করে দিতে পারে বাবলা ফুলের কামাসক্ততা। ভেঙে দিতে পারে কূটনৈতিক বেড়াল আর দুধের হাঁড়ির মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত যোগাযোগ। অনিশ্চয়তার শিলাপাত স্বরূপ ফলাফল সেই একই–  নরমুন্ড-মালা আর পরচুলাতে সজ্জিত আসন্ন নবান্নের বেশবাশ।  


খাস সিঁড়ি বেয়ে-ওঠা কোনো-কোনো গোধূলি পরজীবী গ্লানিকে কুয়োর জলে পড়ে-থাকা চাঁদ বলে ঠাওরায় না। সহযোদ্ধা প্রশান্তির একচেটিয়া নাম-ঠিকানাগুলো খুঁজতে-খুঁজতে কখন যে মেঘে-মেঘে অনেক বেলা হয়ে এল! 


মেলা ষড়যন্ত্রে আবর্তিত ঝড় প্রকৃত পিঁপড়েকে বিসর্জনে পাঠাতেই পেঁপেগাছটা পেয়ে গেল অবধারিত সন্ন্যাসের খোঁজ। ব্যয়বহুল সাবানের মতো পিচ্ছিল বিরহে সুখের সংক্রমণ হয় না। কৃষিকাজে অনভিজ্ঞ পারদের কৌশলে প্রেম হয়ে ওঠে ভ্রমণপিপাসু।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন