নদী অথবা দরবেশ
নাসের হোসেন
১.ওড়না।।
তুমি কোথা থেকে এসেছো? কোথায় যেতে চাও?/
চিরপথিক- কে যদি এই কথা কেউ জিজ্ঞাসা করে
তার কোনো উত্তর মিলবে না।যেমন আর- কী,
রাত কত হল,উত্তর মেলে না।
রাস্তার আলোগুলো প্রচণ্ড ঝড়ের পর জ্বলছে না আর।
আকাশজুড়ে এবং দিগন্ত- বিস্তৃত ছড়িয়ে আছে রজনির
কালো ওড়না।ওড়না বলেই নরম ও মখমলি।অর্থাৎ
দিগন্তব্যাপী অন্ধকারটি নরম ও মখমলি।
২. ছাতিম।।
ফুটপাতে আজ আর কেউ নেই।হাড়- হাভাতে।মানুষগুলো
অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে।সুতরাং, তাই,এই বিশাল
ছাতিমগাছের নীচে এসে দাঁড়িয়েছো।সারা শরীরে কালো
নরম ও মখমলি কাপড় জড়ানো।
ঢোলা কাপড়ে ঢাকা দুই হাত
দু- দিকে মেলে দিয়ে কিছুটা আপনমনেই বললে,আহ্
এরই নাম তো বাঁচার আনন্দ।একটা বিড়াল কোথা থেকে
এসে পায়ের কাছে ঘুর-ঘুর করছে।
৩.প্রাইভেট গোয়েন্দা।।
করোনাকালে অনেককিছু করা মানা,তাই
এর আর এক নাম--- কোরো না।পাবলিক শত কষ্টের
মধ্যেও রসকষ পুরো হারিয়ে ফেলেনি।তাই মজা করতে
পছন্দ করে।মুখে মাস্ক,হাতে গ্লাভস,পা- ঢাকা মোজা ও
জুতো,যেন স্বয়ং এক প্রাইভেট গোয়েন্দা করোনা নামক আততায়ীর
পেছনে অনুসন্ধানে ব্যস্ত।ঝড়- জলে বিপর্যস্ত হয়ে আছে সবকিছু।
কয়েকটা গাছ এইমাত্র ভেঙে পড়লো মাটিতে।কৃষ্ণচূড়া
ফুলগুলি ডাল সমেত রাস্তার জলে মিশে আছে।
৪.মন্ত্রপাঠ।।
ওষুধ কেনার দরকার ছিল।এত রাতে সব দোকান বন্ধ।তাছাড়া
যা ঝড়ের তাণ্ডব চললো।রাত দশটার পরেই সব শুনশান।
এটা তো একটা বিরতি চলছে।আবার কিছুক্ষণ পরেই
শুরু হবে ঝড়- জল।ছাতিমগাছের নীচে সেই অচেনা দরবেশ
এখনো দাঁড়িয়ে আছে, কোনো আশ্চর্য মন্ত্র পাঠ করে চলেছে।
যে মন্ত্রের মধ্যে রয়েছে সমগ্র মানুষকে ভালোবাসা।
নিস্বার্থভাবে ভালোবাসা।ইতিমধ্যে বিড়ালের পাশাপাশি একটি
কুকুরছানাও এসে বসে পড়েছে।
৫.ভাসান।।
কে কোথায় বয়ে চলেছে।এক ঘণ্টা বিরতির পর
পুনরায় ঝড়ের তাণ্ডব বয়ে চললো।কত বাড়ির চালা
উড়ে গেল।কত বাড়ির দেওয়াল ভেঙে পড়লো।
হাজার- হাজার গাছ ইলেকট্রিক তারের
উপর পড়লো।সব অন্ধকার। বাকি যেসব গাছ
দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলির কোনোটাই বুঝি আস্ত
থাকবে না আর,জলের তোড় ভাসিয়ে চলেছে কতকিছু
রাস্তার ভূমিকা যদি হয় হাঁটানোর,এখন ভূমিকা হচ্ছে ভাসানোর।
৬.সময় কিংবা জল।।
যেও না।এরকম আর্ত নিবেদন যদি উঠেও আসে
উপায় নেই, যেতে হবেই।জল তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে
যাবে।বন্যার সময়ে যেরকমটা ঘটে থাকে।কোথায় কে
যাবে,গিয়ে পড়বে,সেখান থেকে আরো কোথায়,
তা নির্ধারণ করাটাই মুশকিল,সময় যেমন বয়ে
নিয়ে যায়,এখানে সময়ের জায়গায় জল ভেবে নিলে
অসুবিধা হয় না। সময়ের কাজ এখন জল পালন
করতে চাইছে,সে- অনুমতি সে পেয়েও গেল, তাই ছুটছে।
৭.জলেশ্বরী।।
জাগো হিম জলেশ্বরী, জাগো,সেই যে দুপুরবেলায়
এখানে যে দোকানগুলো খোলা ছিল, এখন সব বন্ধ
প্রত্যেকে যে যার নিজের বাড়িতে, এই ভয়াবহ দুর্যোগে
নিজের লোকেদের ছেড়ে কে কবে দূরে থাকতে চেয়েছে
অন্ধকার নিঝুম সব ঘর- বাড়ি,কেবলি ঝড়ের
গর্জন,গাছপালার উন্মাদ মাথা- নাড়ানো,আর
ভেঙে- ভেঙে পড়া,চোখের সামনে পর- পর কয়েকটা
গাছ ভেঙে পড়ে গেল,চিৎকার শোনা যায়: জাগো জাগো জলেশ্বরী।
৮. পাতালপুরীর বাজনা।।
মাইল মাইল রাস্তা জুড়ে ছুটে চলেছে জলেশ্বরী
এমনভাবে,যে, মনে হচ্ছে,এখানেই একটা চিরকালের
নদী নির্মিত হয়ে গেল,নদীর একটা উৎস থাকে এবং
মোহানা থাকে, সেটিও নিশ্চয় থেকে যাবে বরাবরের মতন
কিন্তু নদীর তো নদীখাত- এর দরকার হয়,এখানে
তো নদীখাত নেই,এ তো বাঁধানো রাস্তা,তাহলে
এত জল বেশ কিছু সময় পরে নেমে যাবে পাতালে
কোনো দূর পাতালে,সেই পাতালপুরীর বাজনা শোনা যাচ্ছে ।
৯. দীর্ঘদেহী অবয়ব।।
তুমি কি এখনো দেখতে পাচ্ছো, সেই এক দীর্ঘদেহী দরবেশ
দু- হাত তুলে কোনো একটা মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে, পায়ের কাছে
একটা বিড়াল ও একটা কুকুর,ফুটপাতেও জল জমে গেছে
শুধু এই ছাতিমগাছের চারপাশে কিছুটা উঁচুতে যে বেশ চওড়া
বসার জায়গা,তার উপরে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘদেহী পুরুষ
সে কি মন্ত্র পড়ছে,দায়- দায়িত্ব কতটা ও কতটুকু
তারপর সেই জলের নদী ঠেলে দরবেশ এগিয়ে চললো
আমাদের প্রাকৃত চোখের সামনে,এগিয়ে চললো।
১০.বিচিত্র আলোকসজ্জা।।
জল ঠেলতে ঠেলতে দরবেশ এগিয়ে চলেছে
রাস্তার উপরে কোমরজল নদী, সে- নদী ঠেলে - ঠেলে
এগিয়ে চলেছে দরবেশ,আরএমন সময়েই ঘটলো
এক আশ্চর্য ঘটনা,পুরো নদীর উপর ঝলমল
করে উঠলো মণিমুক্তাখচিত আলোকমালা
এই ঘোর নিশীথে অন্ধকারের মধ্যে জ্বলছে- নিভছে
মণিমুক্তাখচিত আলোকমালা,যতদূর চলে যাচ্ছে
দরবেশ,ততদূর খুলে যাচ্ছে এক- একটা বিচিত্র আলোকসজ্জা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন