আমার জাদুবাস্তবতা

মলয় রায়চৌধুরী

          শৈশবে ও তারুণ্যে পশ্চিমবঙ্গের যে বাস্তব জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, যাকে আমি চোখ বুজে আজও মগজের ভেতরে স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত করতে পারি, যে-আইডিলিক বাস্তব জগতে আমি আর বোনভাইরা লন্ঠনের আলোয় বসে বড়োজেঠিমার কল্পকাহিনীগুলোকে, যেগুলো উনি রামায়ণ, মহাভারত, পঞ্চতন্ত্র, আরব্য রজনী,ঠাকুমার ঝুলি, ঈশপের ফেবল ইত্যাদির কাহিনিকে মিলিয়ে-মিশিয়ে নিজের মতন করে আমাদের শোনাতেন, সেই কাহিনিগুলো উত্তরপাড়া কোন্নোগর গরলগাছা পাণিহাটি নিমতা ইত্যাদি তখনকার গ্রামে প্রতিস্হাপিত করতে পারতুম, লিখতে আরম্ভ করে দেখলুম যে সেই বাস্তবকে অপসারিত করে দিয়েছে সম্পূর্ণ  আলাদা ধরণের আপাত-অবাস্তব, বাস্তব ঘটনাবলি, যা ঘটিত ঘটনা, 

মগজের ভেতরে ছবি তৈরি করে ভাবলে মনে হয় অবিশ্বাস্য, অসম্ভব, শিউরে ওঠার মতন অনেক সময়ে ।  


          আমার শৈশব কেটেছে অতিদরিদ্র নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের, সেসময়ে যাদের বলা হতো অন্ত্যজ, ও গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত পাড়া পাটনার ইমলিতলায়, যার বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতায় ছিল অতিবাস্তবতার, অসম্ভাব্যতার, সাংস্কৃতিক অনুমানসমূহের, মিথের, সামাজিক কিংবদন্তির বাস। তাদের নৈতিকতায় বাইনারি অপোজিটস বা যুগ্ম বৈপরীত্যের স্হান ইউরোপীয় আদল-আদরায় ছিল না । তারা মনে করত না যে, কেউ একেবারে খারাপ বা একেবারে ভালো হতে পারে । অধঃপতনের কোনো ধারণা ছিল না । পাড়ার সকলেই জানতো যে বকরিয়া পাঁড়ে নামের এক বামুন নিজের ছাগলিদের সঙ্গে সঙ্গম করে কিন্তু তাতে আপত্তি ছিল না পাড়ার লোকেদের । জীবন কোনোদিন আরও ভালো হয়ে উঠতে পারে এরকম ভাবনা হাস্যকর মনে হতো সকলের । পাড়ায় দু’দিন দোল বা হোলি খেলা হতো, তাড়ি আর ঠররা খেয়ে, সবাই অংশ নিতো, ঢোলক আর বাঁশি বাজিয়ে নাচে আর অশ্লীল গানে, পাড়ার মহিলারা সেদিন যথেচ্ছ ব্যবহার করতেন, যে কারণে আমাদের বাড়ি থেকে দাদা মেজদা আর আমাকে বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হতো, তা সত্ত্বেও আমরা ছেঁড়া প্যাণ্টজামা পরে বেরিয়ে পড়তুম । দেহ ও ইন্দ্রিয় হয়ে উঠতো উৎসবের উৎস, মানুষের সঙ্গে মানুষের আড়াল ভেঙে পড়ত সেই দু’দিন । নর্দমার জল, পাঁক, গোবর ইত্যাদি দিয়ে দোল খেলা হতো । বলা যায় যে লজ্জাবোধ উধাও হয়ে গেলেও প্রত্যেকেরই অপমানবোধ ছিল । পাড়ার যেকোনো বাড়িতে খেলার সময়ে ঢুকে পড়া যেতো, কেউ বাধা দিত না, এমনকী পাড়ার মসজিদেও মাদুরের পেছনে লুকোনো যেতো । ইমলিতলা পাড়ায় দাদা, মেজদা আর আমাকে এবং আমাদের পরিবারকে বহিরাগত মনে করা হয়নি কখনও । 


          ইমলিতলা পাড়ার কুশবাহারা বিশ্বাস করতো তারা সম্রাট অশোকের বংশধর, যদিও তারা রাতে চুরি করতে বেরোতো, সাধারণত স্নান করতো না। দুসাধরা বিশ্বাস করতো তারা দুঃশাসনের বংশধর আর কম্পানি বাহাদুর বা লর্ড ক্লাইভের সেনাদলে ছিল, যদিও তারাও রাতে চুরি করতে বেরোতো আর ভালো দাঁও মারলে শুয়োর মেরে ধেনো মদ বা তাড়ি দিয়ে খেতো, গোরাইয়া নামে আমাদের অপরিচিত কোনো দেবতার পুজো করতো, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বিশ্বাস করতো যে কারোর অভিশাপ লেগেছে, তখন বাড়ির লোকেরা দুসাধদের ভগত বা ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করতো, আমাদের বাড়িতে খাঁচাকলে ইঁদুর ধরা পড়লে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে খেতো। কুর্মিরা বিশ্বাস করত তারা জন্মেছে কচ্ছপ থেকে, সেই কচ্ছপ ছিল বিষ্ণুর অবতার, যদিও তারা দিনের বেলা ছিনতাই করতে বেরোতো আর সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করতে যেত । কাহাররা বিশ্বাস করতো তারা জরাসন্ধের বংশধর, যদিও তারা চুরি ডাকাতি পকেটমারি সবই করত । পাসিরা বিশ্বাস করতো তারা ভৃগুমুনীর বংশধর, যদিও তাদের কাজ ছিল রাজেন্দ্রনগরের তালের আর খেজুরের জঙ্গল থেকে রস আর তাড়ি পেড়ে এনে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করা । লোহাররা, যারা নিজেদের বলত বিশ্বকর্মা, তারা বিশ্বাস করতো যে পার্বতী তাদের ধুলো থেকে জন্ম দিয়েছিলেন, যাতে দুজন দানবকে মারার জন্য শিবের জন্য অস্ত্র তৈরি করে দিতে পারে, যদিও তাদের কুঁড়েঘরে ছিল হাপর,  আর লোহার নানা ধরণের কাজ করতো, পাড়ার চোরেদের জন্য সিঁধকাঠি তৈরি করে দেয়া থেকে চাপাতি বানানো আর আমাদের জন্য বিনে পয়সায় লাট্টুতে আল লাগানো, ইত্যাদি । নাঈ বা নাপিতরা বিশ্বাস করতো শিব নিজের নাভি থেকে তাদের উৎপন্ন করেছিলেন, পার্বতীর নখ কাটার জন্য, যদিও একটা বাক্স হাতে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো মাথার চুল বগলের চুল কাটা, দাড়ি কামানো আর নখ কাটার জন্য ।


         কুলসুম আপারা বিশ্বাস করতেন তাঁরা ওয়াজেদ আলি শাহের বংশধর, যদিও বাড়ির সবাই শতচ্ছিন্ন পোশাকে অন্ধকার ঘরে বসে বিড়ি বানাতেন আর পোষা হাঁস ও দিশি মুর্গির ডিম বেচতেন, ওনাদের বাড়িতে একটা ঘরে দেয়ালে টাঙানো কারবালার ঘোড়া নামে ফ্রেমে বাঁধানো  টিনের ঘোড়া ছিল, যা ওনাদের কাছে ছিল জীবন্ত একটি অশ্ব । ওনারা আলোর তৈরি তিন রকমের ফেরেশতায় বিশ্বাস করতেন, বৃষ্টি আর খাবারের ফেরেশতা, বিশ্বপ্রলয়ের ফেরেশতা এবং মৃত্যুর ফেরেশতা  । অবিশ্বাস করার মতন করে মুচকি হাসিও হাসা যেত না কারোর সামনে । এনাদের কারোর কাছেই সময় রৈখিক ছিল না এবং বংশের ইতিহাস অতিপ্রাকৃত উদ্ভট আজগুবি ছিল না । যারা নিজেদের মনে করতো সম্রাট অশোক, রাজপুত্র দুঃশাসন, বিষ্ণু, ভৃগুমুনী, শিবের বংশধর, তাদের গায়ে বইছে সম্রাট, রাজপুত্র, দেবী, দেবতার রক্ত, সমাজের একেবারে তলায় নেমে গিয়ে তাদের কাছে সেই সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি ইত্যাদি । ইউরোপের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ ঢোকেনি তখনও পাড়ার জনমানসে, মণ্ডল কমিশনও হয়নি । তারা যা বিশ্বাস করতো তা ছিল সন্দেহের অতীত, প্রশ্নাতীত । বাস্তববাদী অথবা জাগতিক পরিবেশে তারা অবাস্তব বা ঐন্দ্রজালিক উপাদানকে মনে করতো স্বাভাবিক ।


          শৈশবে তাদের ওই কাজগুলো আমার খারাপ কাজ মনে হয়নি, ভাবতুম যে সবাই যেমন টাকা রোজগার করে, ওরাও করে । চুরি বা ডাকাতির অভিযোগে পাড়ায় কারোর খোঁজে লাল-পাগড়ি পুলিশের দল এলে গলির মোড় থেকেই কেউ ছুটে গিয়ে খবর দিতো আর ধরা পড়ার ভয়ে পুরুষরা গোলটালির ওপর দিয়ে পেছনের আমবাগানে পালিয়ে যেতো । পুলিশ দেখলে পাড়ার কুকুররাও ডাক পেড়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে দিতো । পুলিশ ছিল অত্যাচারী নির্দয় নৃশংস ক্ষমতাপ্রতাপের প্রতীক, ফলে তাদের ঠকাতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হতো আত্মীয়রা । পাড়ায় একজন হুলাসচাচা ছিলেন, কায়স্হ, তিনি তুলসীদাসের রামচরিতমানস-নির্ভর ভবিষ্যৎ বলতেন, আর পাড়ার লোকেরা বিপদে পড়লে তাঁর কাছে যেতো সুরাহার জন্য । হুলাসচাচার কাছে ক্রুশকাঠির মতন একটা রামশলাকা ছিল যেটা দিয়ে অক্ষরমালা চিহ্ণিত করতে হতো, আর উনি নির্দিষ্ট দোহা পড়ে নিদান দিতেন । সকলেই বিশ্বাস করতো ওনাকে । পাড়ায় সকলেরই বাড়ির সদরের চৌকাঠে সিঁদুর মাখানো কালো ঘোড়ার খুরের নাল ঠোকা থাকতো, অমঙ্গল ভুত প্রেত বিপদ যাতে না বাড়ির ভেতরে ঢোকে, কেউ যাতে ‘কালা জাদু’ করতে না পারে, পরিবারের লোকেরা সুখে শান্তিতে থাকে, আমাদের বাড়িতেও, তার প্রভাবকে স্বীকার করতো সকলেই, আমাদের বাড়ির বয়স্করাও । ইমলিতলার বাড়ির রান্নাঘরের দরোজায় একটা তালিকা সাঁটা ছিল, কোন তিথিতে কোন আনাজ খাওয়া উচিত নয়, তা পালন করা হতো, যদিও দরিয়াপুরে যাবার পর তালিকাটা মা ব্যবহার করতেন না । বাড়ির সবাই বিশ্বাস করতেন যে পাঁজিতে দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী টিকটিকি দেহের অথবা পাশে পড়লে কী ঘটতে পারে ।


          প্রাইমারি স্তরে আমি সেইন্ট জোসেফস কনভেন্টে পড়েছিলুম, সেখানে সিসটার আইরিন শোনাতেন জোনাথান সুইফটের গালিভার্স ট্র্যাভেলসের গল্প, লুইস ক্যারলের অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারল্যাণ্ডের গল্প, ইলিয়ড ও ওডিসি থেকে কোনো-কোনো ঘটনা । বৃহস্পতিবার করে স্কুল সংলগ্ন চার্চে যেতে হতো ; সেখানে যাযক ফাদার হিলম্যান শোনাতেন ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্প । স্কুলের শিক্ষিকা আর শিক্ষক শোনাচ্ছেন, অতএব তাঁদের বর্র্ণিত বিবিধার্থক কাহিনিকে অবিশ্বাস করা চলে না । আমার শৈশব কেটেছে অমন ঐন্দ্রজালিক পরিবিশে । এখানে বলে নিই যে আমার মেজদাকে বড়োজেঠা দেড়শো টাকা দিয়ে একজন বেশ্যার কাছ থেকে কিনেছিলেন । মেজদা নিজের জন্মরহস্য জানার পর বাংলায় কথা বলা বন্ধ করে কেবল পাটনাইয়া হিন্দিতে কথা বলতেন । ( আমার শৈশবস্মৃতি ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ ) । 


          বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে, দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙের পরিসরের ভেতরেই যেহেতু কালী মন্দির ছিল, বিজ্ঞানের ছাত্ররাও সেখানে পুজো দিতো, কেউ নিয়মিত প্রতি অমাবস্যায়, কেউ পরীক্ষার আগে । সেসময়ে ছাত্ররা বিশ্বাস করতো যে মূর্তির মাথার ওপর ফুল রাখলে সেই ফুল যদি  পড়ে না যায়, মাথার ওপরেই থাকে,  তাহলে বুঝতে হবে কার্যসিদ্ধি হবে ; তিনবার চেষ্টা করা যেতো । আমি এই বিশ্বাস ব্যবহার করেছি আমার ঊপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’-এ, মানসী বর্মণ নামে একটি নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে, যে গোপনে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল  । আমি জীবিকা আরম্ভ করেছিলুম ব্যাঙ্ক নোট পোড়াবার চাকরি দিয়ে, এবং ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’-এর পৃষ্ঠভূমি হল ব্যাঙ্ক নোট পোড়ানো, পুঁজিবাদের আত্মদাহ, পোড়ার সময়ে তা থেকে শবদাহের গন্ধ বেরোতো ।


          কলকাতায় ফিরে, ফিকশান লেখা আরম্ভ করতে গিয়ে অপরিচিত বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় হলো, কুহকের জগতের সঙ্গে, মানুষের অব্যাখ্যেয় আচরণের সাথে, অকারণ প্রতিশোধস্পৃহার সাথে । চাকুরিসূত্রে আমি সারা পশ্চিমবঙ্গ চষে বেড়াচ্ছিলুম, শৈশব-তারুণ্যের থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞতায় জারিত হচ্ছিলুম, পরিচিত হচ্ছিলুম বিস্ময়কর কুহকের, জাদুজগতের, সংস্কারের সঙ্গে । বাংলায় কথা বললে গ্রামবাসীরা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় সত্যিকথা বলতে চায় না দেখে আমি দাড়ি-গোঁফ বাড়িয়ে এম. আর. চৌধারী নামের এক অবাঙালী আধিকারিকের রূপ নিয়েছিলুম আর উর্দু-হিন্দিতে কথা বলতুম । ভোট দিতেও মহাহ্যাঙ্গাম, নজরদাররা ট্যারাচোখে বসে থাকেন, কে যে কার ভোট দিয়ে চলে যায় তা রহস্য ( আমার ‘শাসক অবিনির্মাণ’ ছোটোগল্প )।


          আমার গ্রামোন্নয়নের ট্যুরের চাকরিতে হিমালয়ের তরাইতে স্বদেশি জংলি গোরুর ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে এক মৃত বাঘিনীর পোস্টমর্টেমের দায়িত্ব দেয়া হয় আমার অধস্তন অফিসারকে, যিনি ছিলেন ভেটেরিনারি সার্জেন, জেলায় কোনো ভেটেরিনারি সার্জেন ছিল না বলে । চিৎকরা বাঘিনীর যোনি দেখে আমার যে যৌনতার উদ্রেক হয়েছিল, তা লুকোইনি । পোস্টমর্টেমের পর ছালটা জেলা কর্তৃপক্ষ নিলেন, কিন্তু বাঘের মাংস, দাঁত, নখ, গোঁফের লোম নেবার জন্য গ্রামবাসীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল, আর পুলিসকে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে হলো । বাঘের মাংস যে ভারতীয়রাও খায় তা জানতুম না ; জানতে পারলুম যে বাঘের মাংস খেলে যৌনক্ষমতা বাড়ে, স্বাস্হ্য ভালো হয় ; হাড় শুকিয়ে গুঁড়িয়ে রাখা হয় নানা রোগের ওষুধ হিসাবে । বহু গ্রামবাসী মাংসও শুকিয়ে রাখে, বিয়েতে মেয়েকে উপহার দেয় । তাদের বিশ্বাস বিস্ময়কর হলেও দেখলুম যে স্হানীয় আমলা আর পুলিশ কন্সটেবলরাও তা বিশ্বাস করে । ঘটনাটা আমার ‘দুধসন্দর্ভ’ গল্পে তুলে ধরেছি ।


          কয়েকটা অমন কুহকের কথা বলি । একটি শহরে একজন মহিলার সামনে তার ছেলেদের জবাই করে সেই ছেলেদের রক্ত দিয়ে মাখা ভাত মাকে খাওয়ানো হলো যার দরুণ মা সারা জীবনের জন্য অপ্রকৃতিস্হ হয়ে গেলেন । সরস্বতী পুজোর দিন একটি দ্বীপে বসবাসের চেষ্টা করছেন এমন ষাট হাজার মানুষের ওপর, সেই দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলে,  কাঁদানে গ্যাস আর গুলি চালিয়ে তাদের মারা হল, বাঁচার জন্য জলে ঝাঁপাতে দেয়া হলো না ; যারা জলে ঝাঁপালো তাদের অনেকে কুমিরের পেটে গেল ( আমার ‘ঔরস’ উপন্যাস ) । একটি সেতুর ওপরে সাধুর পোশাক পরা দুজন মহিলা আর পনেরোজন পুরুষের গায়ে কেরোসিন আর পেটরল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া হল, তারা নৃত্যরত জ্বলন্ত শিখার চেহারা নিয়ে মরে গেল, ঘটনার অনুসন্ধানকারী পুলিস অফিসার খুন হয়ে গেল । একটি লকাপে একজন চটকল-মজুরকে পোরার পর সে লোপাট হয়ে গেল, মর্ত্যে তার হদিশ কোথ্থাও পাওয়া গেল না ( আমার ‘নখদন্ত’ উপন্যাসে ‘শেষ হাসি’ পর্ব ) । 


           কয়েকটি গ্রামে মাটি খুঁড়ে পচা পোশাক পরা ভুতুড়ে মানুষদের হাড়গোড় পাওয়া গেল, যেগুলো দেখে কেউ-কেউ দাবি করল যে সেগুলো তাদের আত্মীয় ( আমার ‘হাতে লনঠন পোঁদে ঠনঠন ঘুণপোকা দেয় আলো’ ছোটোগল্প ) । একটি পাহাড়তলিতে একদিন আচমকা শিলাবৃষ্টির মতন একে সাতচল্লিশ রাইফেল বৃষ্টি হল । মোড়লের নির্দেশে একটি গ্রামে সকলের সামনে দুপুর বেলায় একজন যুবতীকে পারাপারি ধর্ষণ করল প্রতিবেশি যুবক ও প্রৌঢ়রা, এমনকি যুবতীর কাকাও । একটি গ্রামাঞ্চল দখল করে সেখানের বউদের তাদের ছেলেমেয়ের সামনেই ধর্ষণ করে গলা কেটে ফেলা হল । কয়েকটি গ্রামের পরিবারদের সেই গ্রাম থেকে চিরকালের জন্য তাড়িয়ে দেয়া হল, অন্যত্র জলচল বন্ধ করে দেয়া হল । কোথাও ধানখেতগুলোয়, খামারে, চালাবাড়িতে  আচমকা আগুন ধরে গেল । বিজলিতারের ওপর কলাপাতা এসে পড়ে লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে লাগল । মোহোল্লা কমিটির লোকেরা বাড়ি বয়ে গালমন্দ করে গেল । একদল যুবক এসে দাবি করল যে আমার ছাদে চারটে মাইক লাগাবে মহালয়ার দিন থেকে । ঘোষিত নাস্তিকের রাজনৈতিক দলের সদস্যরা নানা দেবী-দেবতার জন্য যথেচ্ছা চাঁদা দাবি করতে লাগল । বাজারে চোখের সামনেই পাবদা আর লইটা মাছকে গোলাপি রঙে, ঢেঁড়স আর পটলকে সবুজ রঙে চোবানো হল, তরমুজে ইনজেকশন দিয়ে লাল রঙ ঢুকিয়ে দেয়া হল, একটা ঘরে পেঁপের বোঁটায় সাদা পাউডার মাখাতে দেখলুম যাতে তা রাতারাতি হলুদ হয়ে যায় ।  


           পশ্চিমবাংলার আধুনিকতাবাদী রাজনৈতিক জনজীবনে দেখেছি জঙ্গীপাড়ায় স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা করে আঁজলাভরে রক্তপান করা হবেছে, হাওড়ার কান্দুয়ায় পাথরে হাত রেখে আটের পাঞ্জা কেটে নেয়া হয়েছে, যাদবপুরে থেঁতলে মেরে ফেলা হয়েছে বৃদ্ধাকে, বর্ধমানের দেওয়ানদিঘিতে আটজনকে বেদম পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, বানতলায় ঘিরে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে মহিলাদের যাঁদের একজনের যোনিতে প্রবিষ্ট করা হয়েছিল একটি টর্চ, কুড়ি বছরের নাজিমা খাতুনকে উলঙ্গ করে পিটিয়ে ঘোরানো হয়েছে শ্যাওড়াফুলিতে, আওয়ামি লিগ নেত্রীকে পারা-পারি ধর্ষণ করা হয়েছে হাওড়ার যাত্রীনিবাসে । অবিশ্বাস্য ঘটনাবলী । ( আমার ‘উত্তরদার্শনিকতা’ প্রবন্ধ )।


            গোরুর চামড়া ছাড়িয়েছে এই অজুহাতে কয়েকজন মানুষকে সোঁটা দিয়ে পেটানো হল । ট্রেনের কামরায় আগুন ধরিয়ে সব যাত্রীদের পুড়িয়ে মেরে ফেলা হল ( আমার ‘মিহিকার জন্মদিন’ ছোটোগল্প )। একটা জেলায় নকল নোটের কারবার আর পোস্তফুলের চাষের নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার জন্য থানা আক্রমণ করা হল আর তাকে জোরদার করার জন্য পাশের রাজ্য থেকে সীমা টপকে গুণ্ডারা বেমালুম ঢুকে পড়ল । রেলে টাইপিস্ট নিয়োগের জন্য আবেদনকারীদের বলা হল প্রত্যেককে নিজের টাইপরাইটার সঙ্গে আনতে, যার দরুণ সারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে দলে দলে যুবকেরা মাথায় টাইপরাইটার চাপিয়ে পৌঁছোলো পরীক্ষাকেন্দ্রে, যখন কিনা রেলে কমপিউটার প্রবেশ করে গেছে ( আমার ‘নখদন্ত’ উপন্যাসে ‘ভাগ্যলিখনে হরফের দরকার নেই’ পর্ব ) । পনেরোই আগস্ট মহাকরণের সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের কাছে ঝপ করে পড়ে গেল পতাকা, মুখ্যমন্ত্রী চুপচাপ দাঁড়িয়ে,  যতক্ষণ জাতীয় সঙ্গীত বাজলো, কেবল পতাকাদণ্ডকে স্যালুট জানালেন ( আমার ‘সূর্যাস্তের শিল্প’ ছোটোগল্প এবং ‘নখদন্ত’ উপন্যাসে ‘অট্টহাস্য অবিনির্মাণ’ পর্ব ) । 


          যেখানে-যেখানে মাটির তলায় খনিজ পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকে উপড়ে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে উপজাতিদের, নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে তাদের সংস্কৃতি ( আমার ‘অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস’ ) । চটকলের চাকরি-যাওয়া এক মুসলমান শ্রমিক রাস্তায় মরে পড়েছিল, মর্গ থেকে তার মুখ ও দেহ ঢাকা শব বাড়ি নিয়ে গিয়ে আত্মীয়রা দেখল তা একজন  হিন্দুর, তাদের বলা হল আত্মীয়ের শব আরেকটি শোকাতুর দল নিয়ে গেছে, সেখানে গিয়ে দেখা গেল, সেই শবটিও হিন্দুর, মাঝখান থেকে মুসলমান চটকল-শ্রমিকের শব উধাও হয়ে গেল ( আমার ‘নখদন্ত’ উপন্যাসে ‘জিরো নম্বর মানুষ’ পর্ব ) । প্রচুর এন জি ও গজিয়ে উঠেছে যাদের উদ্দেশ্য হল বিদেশি দান সংগ্রহ করা, এই ব্যাপারটি নিয়ে ২০১০ সালে ‘প্রবাসে নিজভাষে’ পত্রিকায় ‘ভিনিয়েট’ নামে একটা জাদুবাস্তব গল্প লিখেছিলুম, আমার ‘গল্পসংগ্রহ’তে অন্তর্ভুক্ত, যাতে একটি কুমিরের দাঁতের ফাঁক থেকে আটক মাংসকুচি বের করার কাজ করে কাদাখেঁচা পাখি, এবং হাঁ-করে শুয়ে থাকা কুমিরের মুখ থেকে মাংসকুচি বের করার সময়ে তাদের দুজনের কথোপকথনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অনেককিছু জানা যায় ।’ভিনিয়েট’ আখ্যানে আমি মিশরের কুমিরমাথা দেবতার মিথ, গ্রিক মিথ ব্যবহার করেছি । ‘নখদন্ত’ রামায়ণের সপ্তকাণ্ডের পর্বভাগ অনুসরণ করে একটি সাতকাহন, আর পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় গোলমাল যা আমার চোখে পড়েছে, আমি তা এই সাতকাহনে ঢুকিয়ে দিয়েছি ।


           ঘটনাগুলো সরাসরি লেখা যায় না, তা সাংবাদিকতা হয়ে যাবে, নয়তো বাস্তববাদের সংরূপ দিতে হবে যা মূলত সাংবাদিকতারই নামান্তর, অথবা বাণিজ্যিক সাহিত্য । তাহলে উপায় ? উপায় হল বড়োজেঠিমার গল্প বলার কাঠামোকে , সিসটার আইরিন ও ফাদার হিলম্যানের বিস্ময়কর বর্ণনাকে, শৈশবের প্রতিবেশিদের বিশ্বাস, জীবন ও জীবিকাকে আশ্রয় করে ন্যারেটিভ তৈরি করা, এবং বড়জেঠিমা ও প্রতিবেশিরা  অভিনয় করে ও ভাষার সাহায্যে যে কল্পজগত গড়ে তুলতেন তাকে লেখায় আনার প্রয়াস । সমকালীন ঘোলাটে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্হিতি, দেশের মাইক্রো ও ম্যাক্রোলেভেলে ক্ষমতাশীল শাসকগোষ্ঠীর ও ক্রোনি পুঁজিবাদীদের ত্রুটি-দূর্নীতি-অন্যায়, তলাকার মানুষের দুঃসহ ও বহুবর্ণিল জীবনযাপন, জনসাধরণের অসহায়তা, সবরকমের ক্লেদকে তুলে ধরার জন্য সাহিত্যিক প্রতিস্রোত  খুঁজে বের করা জরুরি ছিল । পরাবাস্তবাদ সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল, কেননা হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমি বিষয়টি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চর্চা করতুম, অনুবাদও করেছি । কিন্তু আমার ফিকশনের ন্যারেটিভে আমি পরাবাস্তববাদীদের স্বতঃলেখন, স্বগতকথন এবং মানবমন ও ওই মনকে কেন্দ্রে রেখে আবর্তিত নিজের মস্তিষ্কের জগতকে আনতে চাইনি, ফিকশনকে ব্যক্তিগত উৎসার করে ফেলতে চাইনি । প্রতিটি ফিকশন লেখার সময়ে আমি প্রথমে তার আঙ্গিক সম্পর্কে চিন্তা করে নিই , এবং লেখার সময়ে ভাষাশৈলী সেই অনুযায়ী গড়ে ওঠে।


           স্পেন ও পর্তুগালের শাহি লুটেরাদের কালখণ্ড ফুরোবার পর, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড ইত্যাদি ভূখণ্ডে দলে-দলে ইউরোপীয় পুরুষ তাদের মনকেমনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল স্হানীয় মানুষদের হত্যা করে, এবং দিগন্তের পর দিগন্ত প্রাকৃতিক ভারসাম্যে গোলমাল ঘটিয়ে । সাম্রাজ্যবাদীদের গায়ের জোরে সংস্কৃতি ভাবকল্পটি তখন থেকে, আন্তর্জাতিক জমিন খুঁজে পেয়েছিল । দেখাতে চেয়েছিল যে আধিপত্যবাদীর সত্য, পরাজিতের থেকে ভিন্ন । অন্যায়, অবিচার, কুকর্ম সত্ত্বেও তা দূষিত হয় না । স্বাভাবিক যে স্প্যানিশভাষী লাতিন আমেরিকানদের কলমে দেখা দিল জাদুবাস্তববাদ, দেখা দিল সাহিত্য জগতের এথিকাল অথরিটি হিসাবে ।


            ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতা সম্পর্কে প্রথম পড়ি গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ-এর ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড’ উপন্যাসটি ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার পাবার পর, কিন্তু বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল ১৯৯০ সালে, তারপরও আমি বইটি তিনবার পড়েছি, ভাষার কাজ এবং ন্যারেটিভে ঠাশবুনোট ঘটনাবলী খুঁটিয়ে দেখার জন্য । তার আগেই, ১৯৮৭ সালে আমি পড়েছিলুম সালমান রুশডির ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’, এবং এই বইটিও আমি তিনবার পড়েছি, রয়ে-সয়ে, বোঝার জন্য যে লেখক কাহিনিটি নিয়ে গদ্যের খেলাকে কেমনভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন । ওই সময়ে মুম্বাইয়ের ফুটপাথে বিখ্যাত বই সস্তায় পাওয়া যেতো । এই বই দুটি পড়ার দরুন জাদুবাস্তবতা সম্পর্কে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল । এখন যদিও অতিব্যবহারে অভিধাটিতে খাদ মিশে গেছে, ওই দুটি বই পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে অজস্র চরিত্রকে সঙ্গে নিয়ে সময়ের ধারণাকে লাফিয়ে লাফিয়ে নানাদিকে নিয়ে যাবার জন্য এবং অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে একযোগে একটা যৌগিক বাক্যে পুরে দেবার জন্য গদ্যবিন্যাসের কাজ জরুরি । তা না করতে পারলে ডিটেইলিঙের অভাবে কাহিনি ফেবুলিস্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা । বই দুটির কয়েকটা প্যারা বাংলায় অনুবাদ করে নিজের কাছে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছিলুম যে জাদুবাস্তবতার খেলাকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ।


          ‘হাওয়া ৪৯’ পত্রিকার বিশেষ পোস্টমডার্নিজম সংখ্যা প্রকাশের সময়ে দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনাকালে আমাদের মনে হয়েছিল যে পোস্টমডার্নিজমের কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জাদুবাস্তবতার মিল আছে, যেকারণে গুন্টার গ্রাস, টমাস বার্ণহার্ড, পিটার হাণ্ডকে, জন ফাউলার, অ্যাঞ্জেলা কার্টার, জন বানভিল, মিশেল টরনিয়ার, জিয়ানা ব্রাশচি, লুইস ফেরোন, উইলেন ব্রাকম্যান প্রমুখকে একযোগে পোস্টমডার্ন ও ম্যাজিক রি্যালিস্ট বলা হচ্ছে । বহুভাষাবিদ ডক্টর প্রবাল দাশগুপ্ত পোস্টমডার্নের বাংলা প্রতিশব্দ করে দিয়েছিলেন ‘অধুনান্তিকতা’, আমি এই অভিধাটিই এই প্রবন্ধে ব্যবহার করব । 


          ‘হাওয়া৪৯’ এর উত্তরঔপনিবেশিকতা সংখ্যা প্রকাশের সময়েও মনে হয়েছিল যে জাদুবাস্তবতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে উত্তরঔপনিবেশিক সাহিত্যভাবনার মিল আছে, যেমন টনি মরিসনের ‘বিলাভেড’ । টনি মরিসনের ‘বিলাভেড’ এর ন্যারেটিভ আধিপত্যবাদী ঔনিবেশিক মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একযোগে জাদু ও বাস্তবতার আশ্রয় নিয়েছেন, যাতে আফ্রিকান-আমেরিকান ক্রীতদাসের উত্তরঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতাকে উপস্হাপন করতে পারেন । নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক বেন ওকরি তাঁর ‘ফ্যামিশড ল্যাণ্ড’ উপন্যাসে, ঘানার সাহিত্যিক বার্নার্ড কোজে লিয়াং তাঁর ‘সার্চ সুইট কান্ট্রি’ উপন্যাসে, ঘানার সাহিত্যিক কোয়ামে অ্যান্টনি আপ্পিয়ার ‘অ্যাভেঞ্জিং দি অ্যাঞ্জেলস’ উপন্যাসে, সিয়েরা লিয়নের সাহিত্যিক তাঁর ‘দি লাস্ট হারমাটন অফ অ্যালুসিন ডানবেয়ার’ উপন্যাসে  জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতার পুনর্মূল্যায়ন করেছেন । লিণ্ডা হাচেয়ন তাঁর ‘সার্কলিঙ দি ডাউনপোস্ট অফ এমপায়ার : পোস্টমডার্নিজম অ্যাণ্ড পোস্টকলোনিয়ালিজম’ ( ১৯৮৯ ) রচনায় বলেছেন যে অধুনান্তিকতা ও উত্তরঔপনিবেশিকতার মাঝে সম্পর্ক গড়ে তোলে জাদুবাস্তবতা, তাদের আগ্রহের এলাকা হল প্রান্তিকতা এবং কেন্দ্রিকতা ; কেন্দ্রিকতা ও সর্বজনীনতা সম্পর্কে ঔপনিবেশিক গূঢ়োক্তিতে ভাঙন ধরায় এদের ন্যারেটিভ ; তারা সাম্রাজ্যবাদী এবং ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের মূল্যবোধ ও বাস্তবতার ধারণাকে প্রতিরোধ করে ।


          এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকপ্রাপ্তি ছিল ইউরোপীয় বৌদ্ধিক আন্দোলন, যা আঠারো শতকে পৌঁছোয় তার শীর্ষবিন্দুতে । আলোকপ্রাপ্তির ভাবুকরা বিশ্বাস করতেন সময়ের একরৈখিক সামাজিক প্রগতিতে, যুক্তিবাদী বিচারে-বিবেচনা ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারা লভ্য মুক্তিতে, ইতিহাসের এমন এক গতিতে যার অভিমুখ, তাঁদের বিশ্বাসে, মানব কল্যাণমুখী । মধ্যযুগের কবল থেকে বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের ছাড়িয়ে এনে তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, আরও দ্রুত উন্নতি মানুষের করায়ত্ত । যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে এবং দৈব হস্তক্ষেপের ধারণাকে খাটো করে, সেকুলার ধারণার প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁদের লক্ষ্য । আঠারো শতকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবী জুড়ে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছিল । ফলে ইউরোপের ক্ষমতাবৃদ্ধি এবং কাঁচামাল ও শ্রমিকের অঢেল সরবরাহ আলোকপ্রাপ্তির দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে সহায়ক হয়েছিল । আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্ববিশ্ব গড়তে, এবং একটিমাত্র তত্ত্ববিশ্বকে প্রতিষ্ঠা দিতে, সাহায্য করেছিল সাম্রাজ্যবাদের নিশ্চয়তা । ভিক্টোরীয় আত্মবিশ্বাসের গর্বোদ্ধত কালখণ্ডে, ঔপনিবেশিকতা ও প্রগতিতে বিশ্বাসীরা, ইউরোপীয় চিন্তার জগতে রাজ্যপাট জমিয়ে ফেলেছিল । যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টলমল করে উঠেছিল রাজ্যপাট ; তাকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে প্রয়োজন হল ব্যাপক বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক অবদান এবং তৎসহ অভূতপূর্ব ভোগবাদী রমরমা । তা সত্বেও একের পর এক দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আঘাতে ভেঙে পড়ল উপনিবেশবাদ । পরিবেশের দূষণ, অজ্ঞাত অসুখের সংখ্যাবৃদ্ধি, নিঃশেষ হতে থাকা জ্বালানি, প্রকৃতি ও সবুজ ধ্বংস, ওজোন স্তরের অবনমন ইত্যাদি থেকে প্রকট হয়ে উঠল শিল্পদ্যোগে বৈষয়িক প্রগতির ভয়ংকর চেহারা । অর্থাৎ সর্বায়তনিক অবিশ্বাস । গল্প-উপন্যাস লেখকরা বাধ্য হলেন ভিন্ন এক স্বদেশি সাহিত্যিক কৃৎকৌশল আবিষ্কার করতে ।


            বিশ শতকের আশির দশকের আগে পর্যন্ত আলেখ্যতে অবিশ্বাস্য পায়রোটেকনিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে জাদুবাস্তব সাহিত্যকে মনে করা হতো স্প্যানিশভাষী লাতিন আমেরিকার নিজস্ব এবং এই অভিধা অন্য দেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হতে পারে না । একইভাবে মনে করা হতো যে অধুনান্তিকতা কেবল মার্কিন সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং মার্কিন সাহিত্যিকরা তাঁদের জাদুবাস্তব বৈশিষ্ট্যের ফিকশনকে ম্যাজিক রিয়্যালিস্ট বললে অস্বস্তি বোধ করতেন । আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বিভিন্ন দেশের ফিকশনে যে ধরণের কাজ দেখা দিল, আলোচকরা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে জাদুবাস্তব আলেখ্যর বৈশিষ্ট্য ভাষা ও ভূগোলকে ছাপিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে । জাদুবাস্তব আলেখ্যর প্রান্ত থেকে কেন্দ্রকে সরিয়ে দেয়ার বৈশিষ্ট্য আসলে মূলত মার্কিন পুঁজিবাদের ও মিলিটারি-ইনডাসট্রিয়াল প্রভাবের প্রতিই নির্দিষ্ট ছিল, কেননা মার্কিন দেশটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল পৃথিবীর ক্ষমতাপ্রতাপের কেন্দ্র । উত্তরঔপনিবেশিক ফিকশন রচয়িতারাও প্রান্ত থেকে কসমোপলিটান অথবা সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রকে বিস্হাপিত করতে চেয়েছেন । অনেকেরই মনে আছে হয়তো, সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাস অধুনান্তিকতার বিরোধিতা করেছিলেন, ও তাঁকে অনুসরণ করে অনেকেই বিরোধিতা করেছিলেন, তার প্রধান কারণ ছিল তাঁর দল সেসময়ে ছিল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাপ্রতাপের কেন্দ্রে, এবং এমন সমস্ত কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছিল যাকে বলা যায় শোষণ, পীড়ন, নৃশংসতার চূড়ান্ত । 


           উত্তরঔপনিবেশিকতা অভিধাটি, জাদুবাস্তবতার মতনই বিতর্কিত, কিন্তু মোটামুটিভাবে উত্তরঔপনিবেশিক গল্প-উপন্যাস যে অসংখ্য বিষয়ান্তরের অবতারণা করে তা ঔপনিবেশিকতার চাপানো সাহিত্যিক মানদণ্ড এবং ঔপনিবেশিক আদর্শবোধকে ভিত্তিগত সংস্কৃতি এবং স্হানিক মূল্যবোধ দ্বারা প্রতিরোধ করে । বলাবাহুল্য যে আত্মপরিচয়, ইতিহাস এবং দর্শনানুপাত উত্তরঔপনিবেশিক লেখকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব হল যে নেটিভরা দুটি পরস্পরবিরোধী পরিসরের নিবাসী হতে বাধ্য হয়, যাকে লিণ্ডা হাচেয়ন বলেছেন আত্মপরিচয়ের এবং ইতিহাসের দ্বৈততা ; ইউরোপের যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান চালিত বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংঘাত ঘটে নেটিভের বোধাতীত গুপ্তরহস্য, অতিকথামূলক কাহিনি এবং পৌরাণিক দর্শনানুপাত । মধ্যবিত্ত বাঙালির সমাজে আমরা এই দ্বৈততাকে সাধারণত পুরুষদের মধ্যে প্রত্যক্ষ করি, যখন তাঁরা নিজেদের নাস্তিক ও অনীশ্বরবাদী ঘোষণা করেও, দুর্গাপুজোয় স্ত্রীকে নিয়ে যান অষ্টমির পুজো দিতে, দশমীর সিঁদুর খেলায় অংশ নিতে, কিংবা মার্কসবাদে বিশ্বাসী নেতার নিয়ন্ত্রিত কালীপুজো, দুর্গাপুজো, বিশ্বকর্মাপুজো ইত্যাদির সময়ে অর্ধেক রাস্তা অবরোধ করতে । মার্কসবাদী নেতা, ব্রা্হ্মণসন্তান সুভাষ চক্রবর্তী তারাপীঠে তান্ত্রিক দেবী তারার পুজো দিতে গিয়েছিলেন, এবং সে-ঘটনার প্রচারও করেছিলেন তিনি ।এই দ্বৈততার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকে জাদুর বীজ, যা জাদুবাস্তব লেখকেরা ব্যবহার করেন ।


           স্টিফেন স্লিমেন তাঁর ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজম অ্যাজ পোস্টকলোনিয়াল ডিসকোর্স’ রচনায় বলেছেন যে ম্যাজিক রিয়্যালিজম অভিধাটি বিভিন্ন জঁর ( genre ) এবং দর্শনানুপাতিক কৃৎকৌশলে লেখা গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সময়ে ম্যাজিক রিয়্যালিজম ধারণাটির অন্যান্য প্রতিবেশী জঁর-এর থেকে কী যে পার্থক্য তা সহজভাবে কেউ স্পষ্ট করতে পারেননি, যেমন উপকথা, পৌরাণিক গল্প, মেটাফিকশন, খেয়ালি কল্পনা, অদ্ভুত-গল্প, অতিপ্রাকৃত, অবিশ্বাস্য-গল্প ইত্যাদির কথা বলা যায়, এবং সেকারণে বিদ্যায়তনিক সমালোচকদের অনেকে ম্যাজিক রিয়্যালিজম অভিধাটি এড়িয়ে যান । তিনি একথাও বলেছেন যে অভিধাটিতে এমন কিছু আছে যাকে ফেডেরিক জেমিসন বলেছেন ‘স্ট্রেঞ্জ সিডাকটিভনেস’, যাতে তত্ত্বগত শূন্যতা সত্ত্বেও, ম্যাজিক রিয়্যালিজম বিদ্যায়তনিক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে থাকে । বস্তুত এই ধরনের ফিকশন সম্পর্কে  ধারণার জন্য যাঁদের ফিকশন পড়া জরুরি তাঁরা হলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ( ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড ), সালমান রুশডি ( মিডনাইটস চিলড্রেন ), হারুকি মুরাকামি ( দি উইণ্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল ), টনি মরিসন ( বিলাভেড ), ইসাবেল আলেন্দে ( দি হাউস অফ স্পিরিটস ), আলেহো কার্পেন্তিয়ের ( দি কিংডমস অফ দিস ওয়র্লড ), হোর্হে লুই বোর্হেস ( ল্যাবিরিন্হ ), ইটালো ক্যালভিনো ( ইফ অন এ উইনটার্স নাইট এ ট্র্যাভেলার ) এবং গুন্টার গ্রাস ( দি টিন ড্রাম ) এবং আরও অনেকে যাঁদের এই প্রবন্ধের অন্যত্র উল্লেখ করেছি। এনাদের কাহিনি পড়ে মোটামুটি ধারণা করা যায় যে এই ফিকশনের বৈশিষ্ট্য হল অতিবাস্তব উপাদান, বাস্তব জগতের পৃষ্ঠভূমি, মেটাফিকশন, সংকরায়ন, রহস্যময়তা সম্পর্কে তীব্র সচেতনতা, লেখকীয় বাকসংযম, এবং অবশ্যই রাজনৈতিক সমালোচনা ।


           কার্লোস ফুয়েন্তেস তাঁর  ‘ডিসকভারিং মেক্সিকো’ ( দি উইসন কোয়ার্টারলি, ১৯৮৮ ) প্রবন্ধে বলেছেন যে ওক্তাভিও পাজ-এর সঙ্গে আলোচনার সময়ে তাঁরা এই বিষয়ে একমত হয়েছিলেন যে মেক্সিকোর সংস্কৃতির, জাতির এবং রাজনীতির কোনো সুবিধাপ্রাপ্ত কেন্দ্র নেই, ফলে প্রতিটি লেখক এক কেন্দ্রহীন অবস্হান থেকে লেখেন এবং কোনো কেন্দ্রীয় ক্ষমতাপ্রতাপের সম্ভাবনা দেখা দিলেই তাকে আক্রমণ করতে বাধ্য হন । জুলি অর্টেগা তাঁর ‘পোস্টমডার্নিজম ইন ল্যাটিন আমেরিকা’ ( ১৯৮৮ ) রচনায় বলেছেন যে লাতিন আমেরিকায় যে ন্যারেটিভগুলোকে জাদুবাস্তববাদী বলা হচ্ছে তাতে অধুনান্তিকতার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট, এবং অধুনান্তিকতা অভিধাটিও লাতিন  আমেরিকার কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিসের তৈরি করা । ফেদেরিকো দ্য ওনিসের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন থিও ডি হায়েন তাঁর প্রবন্ধ ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজম অ্যান্ড পোস্টমডার্নিজম : ডিসেন্টারিং প্রিভিলেজড সেন্টার’ ( ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৫ ) । থিও ডি হায়েনের প্রবন্ধটি অ্যাকাডেমিয়া-এডুর সাইটে পাওয়া যাবে । লক্ষ্যনীয় যে উত্তরঔপনিবেশিক ফিকশন রচয়িতারাও ঔপনিবেশিক প্রভূদের চাপিয়ে দেয়া কেন্দ্রিক মূল্যবোধকে ও সাহিত্যিক মানদণ্ডকে বিস্হাপিত করার প্রয়াস করেছেন, যেমন ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’-এর মাধ্যমে সালমান রুশডি বিস্হাপিত করতে চেয়েছেন ই এম ফর্সটার ( হোয়্যার অ্যানজেলস ফিয়ার টু ট্রিড ), রুডিয়ার্ড কিপলিং ও জোসেফ কনর‌্যাডের সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্যের ক্ষমতাপ্রতাপকে, ঔপনিবেশিক মূল্যবোধকে । জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন যে, রুডিয়ার্ড কিপলিং হলেন ‘প্রফেট অফ ব্রিটিশ ইমপিরিয়ালিজম’। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে একইভাবে স্পেন ও পর্তুগালের ঔপনিবেশিক সাহিত্যিক মানদণ্ডকে বিস্হাপিত করার প্রয়াস করেছেন জাদুবাস্তববাদী আলেখ্য রচয়িতারা ।


          রিচার্ড টড তাঁর  ‘কনভেনশান অ্যাণ্ড ইনোভেশান ইন ব্রিটিশ ফিকশন:- ১৯৮১-১৯৮৪; দি কনটেমপোর‌্যানিটি ইন ম্যাজিক রিয়্যালিজম’ ( জন বেনজামিন, ১৯৮৯ ) রচনায় বলেছেন যে অ্যানজেলা কার্টারের নাইটস অ্যাট দি সার্কাস’, সালমান রুশডির ‘শেম’ এবং ডি. এম. টমাসের ‘দি হোয়াইট হোটেল’ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সেই রচনাকৌশলই প্রয়োগ করা হয়েছে যাকে অধুনান্তিক নামে চিহ্ণিত করা হয় । গির্ট লেভেনআউট তাঁর ‘পোস্টমডার্নিস্ট ফিকশন ইন  ক্যানাডা’ ( রোডোপি, অ্যামস্টারডম, ১৯৮৮ ) রচনায় বলেছেন যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাকে অধুনান্তিক বলা হয়, তাকে দক্ষিণ আমেরিকায় এবং ক্যানাডায় ম্যাজিক রিয়্যালিজম হিসাবে চিহ্ণিত করা হয় ; তিনি বলেছেন যে ক্যানাডার ঔপন্যাসিক রবার্ট ক্রোয়েটশ, জ্যাক হজিন্স, টিমথি ফিণ্ডলে এবং রুডি উইবে যে রচনাকৌশল ব্যবহার করেন তা হোর্হে লুই বোর্হেস, গুন্টার গ্রাস, ভ্লাদিমির নবোকভ, সালমান রুশডি এবং ইতালো ক্যালভিনোর রচনাকৌশলের থেকে পৃথক নয়, কিন্তু এই তালিকা থেকে তিনি বাদ দিয়েছেন স্যামুয়েল বেকেট, আলাঁ রোবে-গ্রিয়ে ও জিন রিকারদৌকে । শেষোক্ত লেখকদের বাদ দেবার কারণ হলো, তাঁরা যে রচনাকৌশল প্রয়োগ করেছেন তা পরাকাহিনি বা Surfiction, অর্থাৎ অধুনান্তিকতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য জাদুবাস্তবতার রচনাকৌশলের সঙ্গে খাপ খায় না ।


          তথাকথিত অস্তিমান বা বিদ্যমান বাস্তবকে শোধরাবার জন্য জাদুবাস্তববাদ একটি বিকল্প জগত সৃষ্টি করে  এবং যে বাস্তবের ওপর নির্ভর করে তার ভুলগুলোকে দর্শিয়ে সঠিক পথের নির্দেশ দ্যায় । ক্ষমতাপ্রতাপ প্রদর্শনকারী মতামতকে আক্রমণের মাধ্যমে, তাকে দখল করে, জাদুবাস্তববাদ একটি প্রতিবাদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে । ভূগোল, ভাষা, শ্রেণি, জাতি অথবা লিঙ্গের কারণে যাঁরা পাশ্চাত্য সাহিত্যের সুবিধাপ্রাপ্ত অথবা অধিকারপ্রাপ্ত কেন্দ্রে অবস্হিত নন, অথচ মেইনস্ট্রিম পাশ্চাত্য সাহিত্যে প্রবেশ করতে চান, কিন্তু সেই ক্ষমতাপ্রাপ্ত কেন্দ্রের বীক্ষায় নির্ভর করে লিখতে চান না, প্রয়োগকৌশলের হেজিমনিকে এড়িয়ে যেতে চান, তাঁরা কেন্দ্র-বহির্ভূত একটি অবস্হান নিয়ে লিখতে চান । এমনও হতে পারে যে লেখক এমন একটি দেশের নাগরিক বা জাতির সদস্য যে তিনি জন্মের কারণে সেখানকার সাহিত্যের ক্ষমতাপ্রতাপী কেন্দ্রটির অংশভাক, সেক্ষেত্রে তিনি নিজেকে কেন্দ্রটি থেকে উৎপাটিত করে, ক্ষমতার ডিসকোর্স থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ক্ষমতাহীন ও কেন্দ্রচ্যূতদের পক্ষে সওয়াল করেন । জাদুবাস্তবতায় কেন্দ্রবিচ্যূতি অন্তর্নিহিত, এবং তা লাতিন আমেরিকার স্প্যানিশভাষীদের বাইরের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যেও, যে দেশেই ক্ষমতাপ্রতাপী সাহিত্যিক রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরম্পরাগত ডিসকোর্সের মৌরসিপাট্টা, সেদেশের ভাষাসাহিত্যে ক্ষমতার বিরোধিতা হিসাবে জাদুবাস্তবতার দেখা মিলেছে, যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক জে. এম. কোয়েটজির ‘ফো’ ( ১৯৮৬ ), ভারতীয় লেখক সালমান রুশডির ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ ( ১৯৮১ ), ব্রিটেনের লেখক জন ফাউলেসের ‘দি ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্টস উওম্যান’ ( ১৯৬৯ ) এবং ব্রিটেনের নারীবাদী লেখিকা অ্যানজেলা কার্টারের ‘নাইট অ্যাট দি সার্কাস’ ( ১৯৮৪ ) । কার্টার নারীবাদকে বলেছিলেন, পিতৃতান্ত্রিক ঔপনেবিশেকতা থেকে মুক্তি । অন্য তিনটি উপন্যাসও ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির কথা বলে এবং ‘ফো’ উপন্যাসটি জনৈক নারীর মাধ্যমে ড্যানিয়েল ডিফোর কালো চামড়ার ভাষাহীন ক্রীতদাসের মুক্তির আলেখ্য । ড্যানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো’ উপন্যাসটি ছিল প্রথম কমার্শিয়াল উপন্যাস এবং সেই দিক থেকেও সাহিত্যের বাজার-কেন্দ্রকে আক্রমণ করেছেন কোয়েটজি।


          জাদুবাস্তব অভিধাটি একটি অক্সিমোরোন বা বিরোধাভাস ; অভিধাটিতে যেমন বিশ্বাসযোগ্য দিনানুদৈনিক ‘বাস্তব’ রয়েছে, তেমনই রয়েছে অবিশ্বাসনীয় জাদু বা ম্যাজিক । যদিও বাস্তববাদ নিজেই কালপরম্পরাকে অবহেলা করে নিজের সংজ্ঞাকে ঘোলাটে করে তুলে চলেছে, মোটামুটিভাবে বাস্তববাদী ফিকশন বলতে বোঝায় যার আলেখ্য এমন এক বিভ্রম সৃষ্টি করে যে কাগজের ওপরের ঘটনাবলীকে মনে হয় ‘বাস্তব’ বা ‘সত্য’ এবং প্রতিদিনের সাধারণ জীবনযাপনের সঙ্গে তার মিল আছে । একইভাবে ‘ম্যাজিক’ অভিধাটিও সমান বিবাদ উৎপন্নকারী, একদিকে নিরীহ চাতুরি এবং সৌভাগ্যকামী মাদুলি-তাবিজের এলাকার কথা বলে এবং অপরদিকে  গড়ে তোলে অতিপ্রাকৃত ও খেয়ালি কল্পনার ছবি । ফলতঃ ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজম’ নামের বিরোধাভাসমূলক অভিধা মেলে ধরে  একটি জটিল প্রতর্কের সঙ্কটপূর্ণ তত্ব ।


          আমারিল চানাডি তাঁর ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজম অ্যাণ্ড দি ফ্যানটাসটিক’ ( গারল্যাণ্ড পাবলিশিং, ১৯৮৫ ) রচনায় বলেছেন যে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের বৈশিষ্ট্য হল দুটি পরস্পরবিরোধী অথচ স্বশাসিত সুসঙ্গত যথানুপাতিকতা, একটির বনেদ হল বাস্তব সম্পর্কিত ‘আলোকপ্রাপ্ত’ যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং অন্যটির বনেদ হল প্রতিদিনকার জগতে অতিপ্রাকৃতের অস্তিত্বকে স্বীকার করা । সুতরাং সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের মূল তত্ত্বটি হল একাধারে বাস্তব ও ম্যাজিকের সহাবস্হান । যাঁরা কেবল খেয়ালি কল্পনার বর্ণনাকারী, যেমন হ্যারি পটার কাহিনিগুলোর লেখিকা জে. কে. রাওলিঙ, তাঁরা বাস্তব জগতের বাইরে বেরিয়ে যুক্তির এবং পার্থিব জগতের নিয়মকে অস্বীকার করেন এবং আজগুবি  অতিপ্রাকৃত ঘটনাবলীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন, পক্ষান্তরে ম্যাজিক রিয়্যালিজম কাহিনির বর্ণনাকারী, বাস্তববাদী ফিকশনের  বেশিরভাগ লেখনরীতি মেনে নেন বটে,  কিন্তু টেক্সটের ভেতরে “আরো কিছু”র অনুপ্রবেশ ঘটান, যা বাস্তববাদী নয় । সেই উপাদানগুলো পাঠককে শক দেবার জন্য ঢোকানো হয় না, তাকে আলেখ্যে এমনভাবে বুনে দেওয়া হয় যে তা অবাস্তব মনে হয় না । ম্যাজিক রিয়্যালিজম, অতএব, যেমন সম্পূর্ণরূপে খেয়ালি কল্পনার ব্যাপার নয়, তেমনই তা অভিজ্ঞতা দ্বারা অর্জিত বাস্তবের উপলব্ধি নয় । খেয়ালি কল্পনাপ্রসূত ঘটনার উপস্হিতি সত্ত্বেও সব সময়েই তার যোগাযোগ থাকে বাস্তব জগতের সঙ্গে ; তার শেকড় থাকে পরিচিত সামাজিক ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক প্রসঙ্গে ।


          ম্যাজিক রিয়্যালিজমের আরেকটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল কাহিনি যতক্ষণ চলে তার বর্ণনাকারী পুরোপুরি ভারসাম্যের কন্ঠস্বর বজায় রাখেন ; তাঁর বর্ণনা অবজেকটিভ থাকে,  নিরাবেগ ও পক্ষপাতশূন্য হয় । পাঠক অসাধারণ ঘটনাগুলোের সম্ভাবনাকে বিশ্বাস করতে না চাইলেও, কাহিনির চরিত্রগুলো এবং বর্ননাকারী  অবশ্যই প্রতিটি ঘটনাকে সত্যি বলে মনে করবেন । বর্ণনাকারী অসম্ভাব্যতার কোনো প্রশ্ন উথ্থাপন করবেন না এবং কোনো ঘটনাকে হতবুদ্ধিকর মনে করবেন না । বাংলা ভাষায় বাস্তববাদ এসেছিল সেইসময়ে যখন ইউরোপের ঔপনিবেশিক মানদণ্ড  কল্লোলের এবং উত্তর-কল্লোলের লেখকদের মাধ্যমে সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা পেল, এবং ছোটোগল্প ও উপন্যাসের ইউরোপীয় পরিভাষা বিদ্যায়তনিক স্তরে গ্রহণ করে নেয়া হলো । পরবর্তীকালে বাণিজ্যিক সাহিত্যের প্রসারের সঙ্গে বাস্তববাদ হয়ে উঠল বানানো, পাঠক-মুখাপেক্ষী এবং বিনোদনমুখী । এই সাহিত্যিক কেন্দ্রটিকে পরিধি থেকে আক্রমণের জন্যও প্রয়োজন ছিল জাদুবাস্তবতার, অন্তর্ঘাতী সাহিত্যের, প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক সমালোচনার । 


          বাংলাভাষায় এই কাজটি প্রথম করেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘ডমরুচরিত’ আলেখ্যে । ডমরুধরকে ঔপনিবেশিক কর্তাদের সঙ্গে তুলনা করা যায় । ত্রৈলোক্যনাথ চরিত্রটিকে কদাকার, বৃদ্ধ, কালো, স্বার্থের প্রয়োজনে সর্ববিধ নীতিবোধ বিবর্জিত হিসাবে চিত্রিত করেছেন । ডমরুধর সর্বশক্তিমান, ক্ষমতা তাঁর সার্বভৌম । ডমরুধর সর্বত্র বিরাজমান এবং সমান তৎপর । বাঘ কুমির ভুত মশা চড়ুই সকলেই তাঁর প্রজা। খোক্কোশের বাচ্চাকে মেঘের সঙ্গে বেঁধে নভোমণ্ডল দখল করতে বেরোন ডমরুধর ।  ত্রৈলোক্যনাথের সময়ে যাদুবাস্তব অভিধাটি প্রণয়ন হয়নি, নয়তো আলেখ্যার অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলোকে বলা হতো জাদুবাস্তব, বিশেষ করে ডমরুর কার্যকলাপকে যখন প্রচ্ছন্নভাবে সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতাপ্রতাপ আর ক্ষমতাকেন্দ্রের উদ্ভট আচরণের সঙ্গে তুলনা করা যায় ।


          অধুনান্তিক গল্পের আদরায় জাদুবাস্তব প্রয়োগ করেছেন হাংরি আন্দোলনের প্রবীণ সদস্য সমীর রায়চৌধুরী তাঁর “বহুজাতিক ভুতের গল্পের খসড়া’ আলেখ্যে ; প্রয়োগ করেছেন জাদুবাস্তবতা, অন্তর্ঘাতী বয়ান হিসাবে, খেলিয়েছেন গদ্যবিন্যাস, এবং দেখিয়েছেন কেমনকরে মালটিন্যাশনাল ওষুধ কোম্পানিরা দখল করে নিচ্ছে এদেশের বাজার, উত্তরঔপনিবেশিকতার কেন্দ্রে নবরূপে হাজির হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ। লেখক বলছেন, “অনির্বাণের কথাই হয়তো ঠিক । লাইফ সেভিং ড্রাগ এদেশে ওই গন্ধমাদন । আস্ত পর্বত । পর্বে পর্বে গল্পের ভাঁজ । বহুজাতিকে হনুমানের ঝামেলা নেই, সবাই সমান হন্যমান।” আলেখ্যটি শেষ হচ্ছে একটি অতিবাস্তব আবহে, আয়রনির মাধ্যমে, “চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে হাড়গিলে নিশুতির হামা । বাড়ছে ভুতুড়ে পুঁজির রমরমা । পরস্পরের জায়গা বদল করছে খুঁটিনাটি আর খুঁতখুঁতে । কার্তিক ভেবে দেখছে এবার কি সে ভীতির মধ্যে যাবে না ভয়ের অন্তরায় হয়ে উঠবে । প্যাকেট থেকে বেরোনো ক্রমউপদ্রবী আবছায়ায় সে একা । এই মুহূর্তে ছায়া-প্রচ্ছায়ায় দিশেহারা । জানলায় ঝুলছে কাঁচুমাচু । হতভম্ব ঠেকছে সিলিঙে । ছড়িয়ে পড়ছে অনুপস্হিতির অনুপ্রবেশ । এলোমেলো হয়ে পড়ছে চিন্তাজনিত । মাটিতে গড়াচ্ছে খটকা । বুজকুড়ি কাটছে তাজ্জব।”


          হাংরি আন্দোলনের গদ্যকার বাসুদেব দাশগুপ্ত তাঁর ‘রন্ধনশালা’ বইটির গল্পগুলোর মাধ্যমে জাদুবাস্তবতার আলেখ্য গড়েছিলেন । সোহরাব হোসেন তাঁর ‘গল্পকার বাসুদেব দাশগুপ্ত : যাঁর হাতে সাবালক হয়েছে বাংলা ছোটগল্প’ ( বাঘের বাচ্চা পত্রিকা, জানুয়ারি ২০১৬ ) প্রবন্ধে বলেছেন যে বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘দূরবীন’ গল্পটিতে জাদুবাস্তবতার শর্তগুলোকে মান্যতা দেয়া হয়েছে । তিনি বলেছেন, “তপতী কর্তৃক আয়নার মধ্যে দানবের নিষ্ঠুর রূপদর্শন কিংবা প্রথমে দূরবীন মাধ্যমে ও পরে খালি চোখে অমল কর্তৃক স্বাভাবিক সাধারণ মানুষের কদর্য বীভৎস রূপ প্রত্যক্ষকরণের ঘটনাটি জাদুতুল্য । এইসব অসম্ভব উদ্ভট ব্যাপার সংযোজিত হয়ে যে সময়সত্য তথা জীবনসত্যকে প্রকাশ করছে সেটি হলো -- রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মানুষকে মানবত্ব থেকে স্খলিত করে দানবে রূপান্তরিত করে ।” ওই পত্রিকায় একই কথা বলেছেন অরূপ দত্ত তাঁর ‘বিপত্তিকালের গল্প,দূরবীন’ প্রবন্ধে ।


          আমি প্রথম জাদুবাস্তব আখ্যান লেখার চেষ্টা করি ১৯৮৯ সালে, ‘কৌরব’ পত্রিকায় প্রকাশিত, পরে আমার ‘গল্পসংগ্রহ’তে অন্তর্ভূক্ত,  ‘ঘোগ’ নামে একটি দীর্ঘ ফিকশনে,  যাতে আমি স্বাধীনতা আন্দোলন ও দেশভাগের একটি চরিত্রকে ঘিরে নানা ঐন্দ্রজালিক ঘটনার বিস্তার ঘটিয়েছিলুম । আমার জাদুবাস্তব আখ্যানগুলো সবই প্রচ্ছন্নভাবে রাজনৈতিক ইশারা সম্বলিত, যেমন ২০০৬ সালে লেখা ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’, ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ও ‘গল্পসংগ্রহ’তে অন্তর্ভুক্ত । সুলতানি আমলে বঙ্গদেশকে বলা হতো জিন্নত-উল-বিলাদ, অর্থাৎ মর্ত্যের স্বর্গ । এই আখ্যানটি নীলাকাশের রাজকুমার একটি মানুষ-শকুন যুবকের কাহিনি, যে জীবনের পর্বে-পর্বে অন্যের ইচ্ছায় রূপ পরিবর্তন করে শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার হয় এবং পোচারদের দ্বারা খুন হয় ; ভাসতে ভাসতে যখন বঙ্গোপসাগরের দিকে তার ছাল-ছাড়ানো শব স্রোতের সাথে চলে যাচ্ছে, তখন তার বৃদ্ধ দাদু এসে তার পেটের ওপরে বসে, কিন্তু নাতির পরিবর্তিত চেহারাকে চিনতে পারে না । ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’য় আমি মিশরের ফ্যারাও আমেনহোতেপের মিথ, মেমননের মিথ, ধর্মঠাকুরের মিথ, বিপ্লবের মিথ ব্যবহার করেছি ।


          ওই বছরেই লিখেছিলুম ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ যা ‘হরিণাহরিণীর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং আমার গল্পসংগ্রহ’র অন্তর্ভুক্ত । এর প্রধান চরিত্রটি, কুশাশ্ব দেবনাথ, চাণ্ডিলা রাজত্বের সময়ে পাথর হয়ে খাজুরাহোর মন্দিরে যৌনআঙ্গিকে বহু শতক আটক থাকার পর,  পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ক্ষমতাধর এক রাজনৈতিক দলের দপতরে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, এই হুমকি পচাঞ্জন সরদার নামে এক দলদাসের ফিসফিসানিতে শুনে, নানা বাধা-বিপত্তির মাধ্যমে, নানা রূপে আর মাপে ক্ষমতাকেন্দ্রটির দিকে যাত্রা আরম্ভ করে, এবং শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দ্যাখে সেখানে যিনি বসে আছেন তাঁর সামনে-পেছনে দুই দিকেই দু-রকমের মুখ ; এই কাহিনিতে চিনা ফাংশুই-এর লাফিং বুদ্ধের সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনফিউজানকে ব্যবহার করেছি ; বাঙালির বাড়িতে ‘গোপালের সেবা’ নামের ধার্মিক-সাংস্কৃতিক আচরণকে ব্যবহার করেছি, যে গোপাল শ্রীকৃষ্ণের চেহারা নিয়ে মানুষে রূপান্তরিত হয় ; পঞ্চতন্ত্রের কাহিনিকে সাম্প্রতিকতার আড়ালে অন্তর্ভুক্ত করেছি, প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ার মহাকাব্য থেকে গিলগামেশের মিথকে অন্তর্ভুক্ত করেছি, হোমারের গ্রিক মহাকাব্যের ইউলিসিসকে অন্তর্ভুক্ত করেছি । ভ্রষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং শ্রেণিক্ষমতা আমার জাদুবাস্তব আখ্যানে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ঘাতী প্রসঙ্গ । রাজনৈতিক সেল্ফকনট্যামিনেশান পশ্চিমবাংলায় এমন স্তরে পৌছেচে যে নিজেদের আদর্শের দ্বারা নিজেরাই নিজেদের কলুষিত করে চলেছেন রাজনীতি করিয়েরা ।


          নানা সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের, বিশেষ করে যাঁরা হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল প্রভাবিত বুদ্ধিজীবি, তাঁদের উদ্ভট আবিষ্কার নিয়ে লিখেছিলুম ‘শূর্পনখা : হেরিটেজ’ নামের আখ্যান,  যার বিষয়বস্তু হল একটি ফড়িঙের পিঠে শূর্পনখার নাকের কাটা টুকরোর জীবাশ্ম আবিষ্কার । ‘গল্পসংগ্রহ’র জাদুবাস্তব আখ্যানগুলোয় আমি চরিত্রগুলোর এক জীব থেকে আরেক জীবে রূপান্তরণকালে সময়কে স্হিতিস্হাপকতা দেবার চেষ্টা করেছি, এঁকেবেঁকে পরিসর থেকে পরিসরে যেতে দিয়েছি,  স্বাভাবিকের সঙ্গে মিশিয়েছি অস্বাভাবিক, কল্পিত জগতের সঙ্গে মিশিয়েছি বাস্তব জগত, সাধারণের সঙ্গে অসাধারণ ঘটনাবলী, জাগরণের সঙ্গে স্বপ্ন, প্রাচীন মিথের সঙ্গে ধার্মিক মিথ আর সমসাময়িক মিথ, কেননা রাজনৈতিক কাঠামোগুলো সাময়িক হলেও মিথগুলো বহু শতাব্দী যাবত সাধারণ মানুষের চেতনায় রয়ে গেছে, যার দরুণ গড়ে তুলতে পেরেছে সামুহিক এবং কৌম আত্মপরিচয় । রাজনৈতিক আনুগত্য ও পর্বান্তরের তুলনায় কৌম আত্মপরিচয়ের বাঁধন বেশ শক্ত । পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সাংস্কৃতিক চেতনায় বাস্তববোধের ভেতরেই বাস করে ঐন্দ্রজালিক উপাদানসমূহ, তা প্রতিফলিত হয় তাদের আচরণে, বিশ্বাসে, ধার্মিক আচারে, ধারণায়, এবং রাজনৈতিক প্রচার, আধুনিকতা ও শহুরে জীবনের চাপ সত্ত্বেও তা থেকে তাদের বৃহত্তর অংশকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি । পশ্চিমবাংলার শহর ও গঞ্জের প্রতিটি মোড়ের শনিমন্দির তার নিদর্শন, যার আয়োজন করেন মোড়ের রিকশঅলারা, এবং বড়োবাবার পুজো নামে শনির যে বাৎসরিক পুজো হয় তাতে সেই পাড়ার নারী-পুরুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো ।


          ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে আমি গ্রাম বাংলার দিনানুদৈনিককে তুলে এনেছি চাকুরিজীবনে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে, গ্রামে-গ্রামে ট্যুরের উপলব্ধি থেকে, যেখানে আজও অতিপ্রাকৃত ভুতঝাড়া, বাটিচালা, ঐন্দ্রজালিক ভেষজ প্রয়োগ এখনও রয়ে গেছে । ছত্রভঙ্গ বাঙালি সমাজে উত্তরঔপনিবেশিক ব্যক্তিএকক ঢুকে গেছে গ্রামজীবনে, ঔপনিবেশিকতার বিষ নিয়ে । এই আখ্যানে পরিধিতে অবস্হিত দেশভাগের সময়ে চুরি করে আনা মুসলমান শিশু খুশবু খান-এর হিন্দু যুবতী খুশিরানি মণ্ডল  হয়ে ওঠা, এবং সেই ধর্মের আচার-আচরণে দৃঢ় বিশ্বাস, আর পরিধিতে অবস্হিত আরেকজন খ্রিস্টান যুবকের আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রস্হিত গ্রামসমাজকে আক্রমণ, আর তার ফলশ্রুতি, বর্ণনা করেছি আলুচাষের ও কোল্ড স্টোরেজে রাখার ভয়াবহ প্যাঁচপয়জার মাথায় রেখে । কসমোপলিস থেকে দূরে, ইংরেজের বসানো ঔপনিবেশিক কেন্দ্রের কেবল হাতবদল হয়েছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডে, আর খুশিরানি মণ্ডল মেনে নিয়েছে বাটিচালা, ঝাড়ফুঁক, ঐন্দ্রজালিক ভেষজ ইত্যাদির বুজরুকি ।


          আমার জাদুবাস্তব উপন্যাস ‘লাবিয়ার মাকড়ি’তে ( গাঙচিল থেকে প্রকাশিত ‘রচনাসংগ্রহর দ্বিতীয় খণ্ড) ভা-লো-বা-সা নামের চারটি শকুন পিট সিগারের গানখানা গায় কিন্তু তা তাদের মুখে ’আমরা করব জয়’-এর বদলে ‘আমরা করব ভয়’ হয়ে গেছে, বস্তুত পুরো গানটাই পালটে গেছে, সেই শকুনদের জন্য মাদকের ব্যবসায় লিপ্ত এক যুবতী ফাঁসিয়ে আনে যুবকদের এবং দুরমুশ পিটিয়ে খাওয়ায় ; যুবতীটির দুজন বুড়ো অন্ধ পিতা আছে যারা দুটি পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের সমর্থক ও সারাদিন মতবাদকেন্দ্রিক তর্ক করে, তাদের জন্যে নিকটের শ্মশান থেকে পোড়া নাক আর চোখের সুপ রেঁধে দ্যায় যুবতী । স্হানীয় আদালতে যাবার সময়ে রবীন্দ্রনাথের ‘আমায় ছেড়ে দে রে’ গানটা পালটে বিচারাধীনরা গায় ‘আমায় জেলে পুরে দে রে’ । বুড়ো দুজন মারামারি করে একে অন্যের মাথা কেটে ফেললে তাদের মুণ্ড দুহাতে নিয়ে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচে যুবতী আর গায়, ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ । শেষে বাসায় রাখা মাদকে আগুন ধরিয়ে দিলে বিস্ফোরণের সময়ে শকুনরা উড়ে আকাশে গিয়ে গান গাইতে থাকে, আর তাদের পেছন-পেছন বুড়ো দুজনের সংগ্রহের রাজনৈতিক বইগুলোর মলাট ডানা মেলে আকাশে উড়ে যায় । 


          আমি দুটি জাদুবাস্তব নভেলা লিখেছি একটি মাত্র বাক্যে, কোথাও ছেদ, কমা, কোলন,সেমিকোলন কিছু প্রয়োগ করিনি, সময়ের প্রবাহকে বিনা বাধায় এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টায়, “নরমাংসখোরদের হালনাগাদ” এবং “ভিড়পুরুষ” । ভারতের পচনকে, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার পচনকে,  ধরার চেষ্টা করেছি যা উত্তরঔপনিবেশিক কালখন্ডে ননস্টপ ঘটে চলেছে এবং যারা তা ঘটিয়ে চলেছে তারা পচনকেই মানব কল্যাণের জন্য বলে যুক্তিতর্ক গড়ে চলেছে ।

2 মন্তব্যসমূহ

  1. "আধিপত্যবাদীদের সত্য পরাজিতদের থেকে ভিন্ন..."
    অপূর্ব ! এই অমূল্য প্রবন্ধটি এই সংকলন কে অমরত্ব দিক।
    ধন্যবাদ আপনাদের।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন