প্রেমানন্দ
বিপ্লব দত্ত

সকলে আনন্দ বলেই ডাকে। হলে কি হবে মুখ সবসময় ব্যাজার। অনেকে বলে ওর নাম আর কামে অনেক পার্থক্য। সকালে মানুষ হাসিখুশি চেহারার মানুষের মুখ দেখলে খুশিতে দিনমান কাটায় অনেকটা এন্টাসিডের মতো। ঘেও। টুক করে প্যান-৪০ গলধকরণ। সারাদিন তেল ইলিশ। ভাপা ইলিশ। দই ইলিশ। অবশ্য এগুলো এখন শ্রেণীগত। করোনাকাল। বাপরে। এখন ? টাকাপয়সা এমনকি বাহুবলেও কামকাজ নেই। এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে পগার পার। সারা শরীরে আবৃত সাদা মার্কিন কাপড়। প্রেম, তুমি আমার, আমি তোমার - লোপাট। চার মাস আগের সানাইধ্বনি - ওগো, তুমি চলে গেলে আমার কি হবে গো, আমি চলে গেলে আমাকে এক জোড়া গোলাপ ফুল বুকের উপর দিও। কিন্তু এখন ? বাজারে গোলাপ অমিল। আর মিললেও পৌঁছনোর উপায় নেই। কেমন যেন দূরত্ব। স্বামী- স্ত্রী, সন্তান ,বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন এমনকি প্রেমিক প্রেমিকা। নিস্বাসে রব - নিজে বাঁচো। ঘিনঘিন করছে মাথার ঘিলু। শিহরে অলিখিত মৃত্যু শিবির। তবুও এই নধর শরীর নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটানো। কাটছেও। কিন্তু কতদিন ?

মহান আধুনিকতা আর নতুনের আবির্ভাব। আতঙ্ক,ঘেন্না আর শিউরে ওঠা এই কাহিনী একদিন ইতিহাসের সংযোজিত পাতা। এখানে যোদ্ধা নেই। শুধু অদেখা মৃত্যু। পুরোনো মানুষরা এর আগেও দেখেছে শকুন ছেঁড়া মানুষের মৃত্যু। তারা বিচলিত নয়। জানে রোগ আসে আবার যায়। এ মারণরোগ যাবে কিন্তু রেখে যাবে আধুনিকতার ঘৃণা দিনলিপি। প্রেমানন্দও এক সময় দেখেছে মহামারী। গল্প করেছে নাতি নাতনিদের। চারিদিকে হাহাকার। ফ্যান দাও, ফ্যান দাও এর কাহিনী তার জানা। এই দেখা থেকেই সে মৃত্যুকে ভয় পায় না। সব সময় আনন্দের মধ্যেই থাকে। জানে জীবে প্রেম করে যে জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। এই মন্ত্রে চিরকাল। আজও। খালি গায়ে তিন হাত কাপড় লেংটি মেরে হাতে হুকো। গুরুক গুরুক টান আর মাটির দাওয়ায় দিনযাপন। 


এলাকায় এখন পুলিশলোক। তারা আসে আর তাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দেয়। বলে - এখন বুড়ো মানুষের বিপদ। ঘরে যান। আপনার জন্য বাড়ির সবাই মরবে। মোটা কাঁচের চশমা আর হাতলাঠিটা নিয়ে টুকটুক করে ঘরে। ফোঁকলা দাঁতে হাসতে হাসতে বলে - হুজুর মুই কিছু লিয়ে আসিনি। বুড়া মানুষির মূল্য লাই গো। ওদের লাকি গপাগপ খেছে। খা খা যত পারিস খেয়ে লে। তবে পুকাগুলান মুনে রাখিস - তু যা দেখালি তাতে মানুষ বুঝছে মনীষীদের লিখা বাণীগুলান - এসেছি, কাম করো আর চলে যাও। 


বাড়িতে এখন সকলে। ভরপুর সংসার। প্রেমানন্দের বকবকানি তাদের আর ভালো লাগছে না। ওদিক থেকে বড় বউমা স্বামীকে বলছে - তুমার বাপকে বুলো কেনে থামতে। একে চারিদিকে হাহাকার আর বুড়ার বকবকানি। 

বয়স হলে মানুষ বকতে ভালোবাসে। অভিজ্ঞতার কথা বলে। শোনার লোক থাকলে ভালো আর না শুনলে যন্ত্রনা। কেও কেও বলে - ফদফদে বুড়ো। বলুকগে। তাও বকে। এই বকবকানি একদিন শেষ হয়। আবার প্রজন্ম আসে। তারাও বকে। আজ যেন একটু বেশি বকছে প্রেমানন্দ। বউটা সেই কবে মারা গেছে। বেশ ভালো ছিল। কিন্তু প্রেমানন্দ ? তার বদনাম ওই কমলার বাড়ি যাতায়াতের সুবাদে। নামের মিল ওখানেই। 


হা গো, তুমার বাপ আজ ঝিম মেরে, জ্বরটর হয়নি তো ? দেখে এস কেনে।

যেছি গো যেছি বলে ছোট ছেলে বলাই বাবার ঘরে ঢুকে দেখলো বাবা এই গরমে আপাদমস্তক চাদরে। ঘুমোচ্ছে ভেবে আর ডাকলো না। রাত যত গভীর প্রেমের শরীরে  পোকামাকড়ের উন্মাদনা। উঠে বসে। জ্বর। ভাবে - তার জন্য এই পরিবার শেষ হয়ে যাবে। হাতলাঠি আর চশমা গলিয়ে আস্তে আস্তে বাইরের দরজাটা খোলে। আলো আঁধারিতে পা চালাতে থাকে। বয়সের পা আর পোকার আক্রমণ এগোতে দেয় না। কোনোক্রমে কমলার বাড়ির কাছে আসে। সে তো কবেই মারা গেছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাড়ি। হাতলাঠি ছিটকে দূরে। হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ির বাইরের চাতালে শুয়ে পড়ে। 

অন্যদিনের মতো আজও কাকের আওয়াজে সকাল। কেও আর ইদানিং প্রাত্যহিক ভ্রমণে বেরোয়  না। সরকারের বিধিনিষেধ। প্রেমের শরীরে এই ক'ঘন্টায়  পিঁপড়ে আর অন্যান্য পোকামাকড়ের আড্ডা কিন্তু তারা মৃত। এলাকা মানুষহীন। পুলিশলোকের দেখা নেই। সূর্যের আলো আর ধারালো এক ঝাঁক শকুনের ঝটপটানি এলাকার মানুষকে ঘুম ভাঙায়। শকুন শরীর স্পর্শ করে না। তারা ঘুরন্ত লাট্টুর মতো চক্কর দেয়। বুঝিয়ে দেয় এই খাদ্যে বিষ আছে। 


রেখা ও লেখা 
বিপ্লব দত্ত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন