আলপথে প্রভাত চৌধুরী 
সৌমিত্র রায়

গ্রামের বাড়ি সিংহপুরে এসেছেন কবি ৷ দীর্ঘ লকডাউনের পর এই জুন মাসের একেবারে শেষের দিকে এই যে গ্রামে আসা, কবির আনন্দের মাত্রাটা অনন্য ৷ কতদিন প্রিয়জনদের সাথে দেখা হয় নি ! দেখা হল ! 

"স্নান সেরে নে ! তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে মোবাইলে কাজ করিস ..." মা বললেন ৷ 
"হ্যাঁ মা, সেরে নিচ্ছি স্নান ৷" কবি যেন এভাবেই তাঁর ছেলেমেয়েকেও বলে থাকেন ৷ মা কিংবা বাবা ঠিক এমনই হন ৷

হঠাৎ ঘেরা বাউণ্ডারির বাইরে বেরোতেই যেন কবির মনে হল বাতাবিলেবুর বাগানের ভেতর দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলেছেন কবি প্রভাত চৌধুরী ! কোথায় চলেছেন ?

নিজেকে প্রশ্ন করতে যেন নিজেই পৌঁছে গেলেন ১৪-১৫ বছর আগের কোন দুপুরে ! প্রভাত চৌধুরী বললেন, ওই দ্যাখো সৌমিত্র হারুবাবু কতটা আগ্রহ নিয়ে খুন্তিটা নাড়ছেন ৷ কবি সহাস্যে সমর্থন করলেন ৷ মনে মনে প্রশ্ন করতে থাকলেন "হারুবাবুর নাম প্রভাতকাকু জানলেন কীভাবে ?" ভাবলেন, কিন্তু বললেন না কিছুই ৷ 


হঠাৎ ডেকে উঠলো অনিন্দিতা ৷ কবিপত্নী ৷ "এবার স্নান করে নাও গো, ১২টা ৫৭ ; গরম গরম রান্না খেয়ে নেবে ৷" 

আসলে কবি মনে মনে পৌঁছে গিয়েছিলেন কন্যা অনন্যার অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানের স্মৃতিতে ৷ প্রভাত চৌধুরী যে কখন মিশে গিয়েছিলেন রান্নাঠাকুরদের মাঝে !!

যাইহোক, অনেক দিন পর কবির গ্রামে ফেরা ৷ মায়ের রান্না খাবার খেতে হবে ৷ গাছপাকা কাঁঠাল খেতে হবে ৷ নিজের হাতে লাগানো লাল পেয়ারা গাছের পেয়ারা ৷ গামছা আর পোশাক নিয়ে আশ্রমকুটীরের দিকে চলে গেলেন কবি ৷ লেবুতলায় নিজেদের টাইমকল ৷ হাতপা ছড়িয়ে বসে গায়ত্রী জপ করতে করতে সাবান মেখে স্নান সারছেন ৷ 

মা বললেন, " জোঁক আছে, খেয়াল রাখিস.."

এই রে ! আচ্ছা ঠিক আছে... বলে চাতালের পাশে তাকাতেই দেখা গেল কবির স্নানের জলে স্নান সেরে নিচ্ছে একটি ব্যাঙ ৷ কবি চোখে চোখ রাখতেই ব্যাঙ একটু ইতস্তত বোধ করলো কিন্তু সরলো না ...

ডাইনিং টেবিল ৷ নিজেদের চাষের আনাজে রান্না নানান পদ ৷ কবি নিরামিষ খান ৷ তবে আজ মা বললেন, একটু মাংস খা,সবাই খাচ্ছে...

কবির এই এক বিষয় ৷ তবে যাইহোক মার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না... মাংস মুখে দিতেই মনে পড়ে গেলো প্রভাত চৌধুরীর কথা..

"মা জানো, অনন্যার অন্নপ্রাশনের সময় প্রভাতকাকু হারুবাবুর মাংসরান্নার খুব প্রশংসা করেছিলেন..."

বাবা বললেন, "হ্যাঁ, উনি কেমন আছেন রে..

মা বললেন, "এখন আমহার্স্টস্ট্রিটেই থাকেন...

আমি কিছু বলার আগেই অনিন্দিতা বললো, হ্যাঁ, উনি প্রায় আগের মতোই আছেন, ইনস্যুলিন নেন, যত্নে থাকতে হয়...

"অনন্যার ন'বছর বয়স হলে গৌরীদান করবেন বলেছিলেন প্রভাতবাবু..." হাসতে হাসতে বাবা বললেন ৷ আরো বললেন, "কলকাতা গেলে অবশ্যই দেখা করিস...

কবি বললেন "হ্যাঁ, উনি এখন প্রতিদিনই লিখছেন আমাদের দৈনিকে ৷ নানান স্মৃতিকথা ৷ "

"তাই ? বাহ্ ! " বাবা খুব খুশী হলেন শুনে ৷

ভাতের থালায় নিজের হাতে লাগানো লেবুগাছের লেবু ৷ মাংসর ঝোল ৷ এক রকম অনন্য ৷ এদিকে গ্রামে আসার নানান ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন কবি ৷ শতাধিক লাইক ৷ শতাধিক কমেন্ট ৷ অনিন্দিতা বললেন, " তুমি দেখেছো নাসেরদা সিংহপুরে কবিতা উৎসবের জন্য আগাম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন গো !"

ফেসবুক অন করতেই কবি দেখলেন কে নেই লাইক কমেন্টে ৷ প্রভাত চৌধুরী লিখেছেন, "তোমার দেশের বাড়িতে কবিতা উৎসবে আমি যাবোই, কথা দিলাম..." 

কবি পুঁইমাচার পাশে বসে দেখতে পাচ্ছেন "প্রভাত চৌধুরী সদলবলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পূণ্য জন্মভূমি বীরসিংহ হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে,আবার ফিরেও আসছেন ...আলপথ... দুধারে ধানগাছ... প্রভাত চৌধুরী আসছেন...

আগামীকাল বীরসিংহ গেলে, কেউ না কেউ জিগ্যেস করবে "প্রভাতদা কলকাতা ফিরে গেছেন ?" সে পানগুমটির মনসা হোক , কিংবা স্কুলশিক্ষক রামকৃষ্ণবাবু ! ততক্ষণে অনন্যার তোলা ছবিগুলি বন্ধুমহলে ভাইরাল ! সাদা দাড়ি ৷ কালো চুল ৷ একগাল হাসি নিয়ে প্রভাত চৌধুরী একগুচ্ছ সেল্ফি তুলেছেন যে অনন্যার সাথে !

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন