প্রভাতদা ৭৬ 

আফজল আলি 

প্রভাতদাকে নিয়ে গদ্য লিখতে হলে ঠিক কীভাবে শুরু করা যাবে, তা নিয়ে বেশ দ্বন্দ্ব জাগে । উত্তর আধুনিকতা নিয়ে শুরু করব , নাকি কবিতা নিয়ে , নাকি গদ্য নিয়ে , নাকি ব্যক্তি প্রভাত চৌধুরীকে নিয়ে । ষাটের দশক ( ছয়ের দশক ) থেকে শুরু করে টানা লিখে চলেছেন , মাঝে কুড়ি বছর বন্ধ ছিল রাজনীতির কারণে । 1993 সালে পুনরায় শুরু নতুন রূপে , লেখার এক্কেবারে জেনেটিক পরিবর্তন হয়ে এবং সঙ্গে কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা নিয়ে । বাংলা সাহিত্যে নতুন এক কবিতা পত্রিকার আত্মপ্রকাশ যা টানা 500 সংখ্যা পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন পাক্ষিক হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে । মাঝে বইমেলা দৈনিক ছিল । 500 সংখ্যার পর কিছুদিন ত্রৈমাসিক রূপে , পরে আবার সাপ্তাহিক। বর্তমানে মাসিক । পত্রিকা প্রকাশ প্রভাতদার নেশার মতো । পৃথিবীর দীর্ঘতম পাক্ষিক কবিতা পত্রিকা চালানো যে প্রচন্ড শক্ত কাজ তা একজন সম্পাদক জানেন । প্রভাতদার মধ্যে প্রচন্ড জেদ কাজ করে । শুনেছি কোনো এক জায়গা থেকে অসম্মানিত হয়ে প্রভাতদা কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা শুরু করে ছিলেন । এবং পরবর্তীতে কবিতা পাক্ষিকের সঙ্গে উত্তর আধুনিকতাকে জুড়ে দেওয়া । উত্তর আধুনিকতাকে জুড়ে দেওয়ার পর কবিতা পাক্ষিক নতুন শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছিল। যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন মুখ ও পরিসর । আমি দীর্ঘদিন কবিতা পাক্ষিক এর সাথে যুক্ত ছিলাম । কাছ থেকে দেখার অনেক অভিজ্ঞতা আছে , তবে সেটা কোনো মতেই নাসেরদার মতো এতটা নয় । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পরবর্তী অবস্থানে বাংলা কবিতাকে সমূলে পাল্টে দিয়েছিলেন প্রভাতদার নেতৃত্বে কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা । এবং এটাই ছিল কবিতা পাক্ষিকের প্রতি অন্যান্য ক্ষমতাশীল কবিদের ঈর্ষা। এই জন্যই কবিতা পাক্ষিক যেন ব্রাত্য ছিল main stream এর কাছে । যদিও সব কবিই লিখতেন , সম্ভবত একজন ছাড়া। সে নামটা আজ উহ্যই থাক । সব কবিই লিখতেন , তবু কবিতা পাক্ষিক এর প্রতি একটা বৈষম্যমূলক আচরণ ছিল । এর জন্য আমাদেরকে , মানে আমরা যারা এক্কেবারে কোর গ্রুপে ছিলাম, বেশ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে । তবে এই ত্যাগ স্বীকারটাও আমাদের কাছে বেশ উপভোগ্য ছিল কারণ আমরা ছিলাম এককাট্টা কবিতা পাক্ষিক নিয়ে । যদিও প্রভাতদা এ সবে কর্ণপাত করতেন না । নিজের জেদ এবং নিজের মতো চলার এক শক্তি আছে প্রভাতদার মধ্যে । এক সময় সংগঠনের মধ্যে থাকার সুবাদে কবিতা পাক্ষিক হয়ে উঠেছিল সংগঠন ভিত্তিক একটা পরিবার। নয়ের দশকে আমরা যখন কবিতা পাক্ষিক এ এলাম তখন ছিল কপার স্বর্ণযুগ । উত্তর আধুনিকতা নিয়ে কী তীব্র কাজ । জানি না এরকম আলোড়ন বাংলা সাহিত্যে আগে হয়েছে কিনা । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তথা কীর্তিবাস নিয়ে যা ছিল সেটা কবিতাকে পাল্টানোর জন্য ছিল না । কিন্তু প্রভাতদার নেতৃত্বে যা ছিল সেটা হল বাংলা কবিতাকে পাল্টানোর । এ ব্যাপারে প্রভাতদা সফল । প্রভাতদার হাত ধরেই আমরা উঠে এসেছি । তবে তখন আমাদের মধ্যে যশ নাম এ সবের দৌড় ছিল না, আমার মধ্যে তো ছিলই না । কারণ আমি বিশ্বাস করতাম কবিতা পাক্ষিক এ লিখলে আর অন্য কোথাও লেখার দরকার নেই । কবিতা পাক্ষিক একাই একজন কবির পরিসর তৈরি করতে পারে । যদিও অনেক পরে ভেবেছি এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা । কারণ কবিতা পাক্ষিক থেকে ছিটকে গিয়ে অনেকেই তো বেশ নাম টাম করল । যে যাই হোক , এগুলো এক একজনের কাছে এক এক রকম। 
প্রভাতদার লেখা দুই প্রকারের । 1993 এর আগে এবং পরের । এখন প্রভাতদাকে যেভাবে চেনা যায় তা হল উত্তর পর্বের কবিতা দিয়ে , সেখানে নানান ডাইমেনশন নানান অনুষঙ্গ এবং পরিবর্তিত discourse . কবিতা পাক্ষিক সংযুক্ত প্রভাতদার লেখা আসলে এতটাই সাবলীল এবং চমৎকার দৃশ্য তথা চিত্রকল্প রূপী , অনেকটা automatic writing এর মতো , যেকোনো পাঠক বা কবি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়ে , ফাঁদে পড়ে যায় অজান্তেই । আমিও পড়েছিলাম। অবশ্য নতুন কবিরা এই ফাঁদটা গ্রহণ করে কারণ কবিতা পাক্ষিক এ লেখা ছাপার মোহ । প্রভাতদা যদিও নিষেধ করেন তাঁর মতো লিখতে । কিন্তু automatic writing কবিতার একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে , পাঠক বা কবিকে চিন্তার প্রকোষ্ঠে তাপ দিতে হয় না , সহজেই গ্রহণীয় হয়ে ওঠে ।
প্রভাতদা হল rolling stone , তাই শ্যাওলা জমে না । সব সময়ই নতুনদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেন। বাংলা কবিতায় প্রকৃত উত্তর আধুনিকের ছোঁয়া তো প্রভাতদাই করেছেন । অনেক কাজ হয়েছে উত্তর আধুনিক নিয়ে । পোস্ট মডার্ন বাংলা কবিতা সংকলন হল সবচেয়ে বড়ো কাজ যা দুই বাংলা জুড়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আমরা এসবের সাক্ষী । প্রভাতদার কথা বললে যূথিকা বৌদির নাম না আনলে খুব ই অন্যায় এবং অসম্পূর্ণ হবে , কারণ প্রভাত চৌধুরী হয়ে ওঠার পিছনে বৌদির অবদান ভীষণ ভীষণ ভীষণ। 

প্রভাতদার গদ্য খুব ঝরঝরে , এক্কেবারে ভিন্ন স্বাদের । সতী সাবিত্রী কথা এবং অনুপম কাহিনি এই দুটো উপন্যাসকে আসলে post modern text বলাই সমীচীন । এছাড়া post modern কাব্য নাটক ট্রাম বেশ উল্লেখযোগ্য। 
প্রভাতদার একটা দারুণ প্রতিভা তা হল কলম ধরলেই লেখা হয় । আমি আগেই বলেছি প্রভাতদা automatic writing style এ লেখেন এবং তাঁর কবিতার মধ্যে থাকে Surrealism এবং magic reality র ছোঁয়া । একটা ফুলদানি যখন সিংহের মতো গর্জন করতে থাকে তখন তা তো magic reality অবশ্যই । পরাবাস্তব , জাদু-বাস্তব এবং স্বয়ংক্রিয়তা তথা নানান তথ্য নির্ভরতা - এই হল প্রভাতদার কবিতার বৈশিষ্ট্য । Notes on insects , notes on maths বা নোটবুক বা সাক্ষাৎকার - এ সবের মধ্যেই পাওয়া যাবে প্রভাতদাকে। প্রভাতদার যেকোনো একটি লেখা দেখলেই ধরা যাবে প্রভাত চৌধুরীকে। প্রভাতদা signature তৈরি করে খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে ধরা দেন বা দিয়েছেন । এটা যেমন একদিকে খুব ভালো , অন্য দিকে পাঠকের কাছে খুব দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। 
সাহিত্যের সংগঠক হিসেবে প্রভাতদা অদ্বিতীয় । এরকম কেউ করতে পেরেছেন কিনা জানি না । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঠিক সংগঠক ছিলেন না বোধ হয়। কবিতা পাক্ষিককে কেন্দ্র করে প্রভাতদা সারা পশ্চিমবঙ্গে গড়ে তুলেছেন একটি প্রতিষ্ঠান , এটা কবিতাকে তীব্র না ভালোবাসলে হয় না , যা প্রভাতদার মনে প্রবল ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন