জানিলাম এ জগৎ প্রভাত চৌধুরী ময়
গৌরাঙ্গ মিত্র

অনেকে ভেবে কুলকিনারা পান না যে প্রভাত চৌধুরী নামক তিরিক্ষে  মেজাজের মানুষের সাথে দু-দশকের ও বেশি সময় ধরে কী করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছি। যাঁরা ভাবেন প্রভাত চৌধুরী মানুষটি তিরিক্ষে মেজাজের, তাঁরা তাঁকে চেনেনই না শামুকের খোলটি শক্ত, কিন্তু তার ভেতরে যে শরীর, সেটি অত্যন্ত নরম।
কতজন কে যে নানা পরিস্থিতিতে টাকা -পয়সা ধার দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তা গুণতে যাবেন না।
কেউ  বই বাঁধাইয়ের জন্য ফর্মা সেলাইয়ের মেশিন কিনবেন- প্রভাতদা টাকা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। কেউ ডি টি পি -র কাজের জন্য কম্পিউটার কিনবেন- প্রভাতদা পাশে দাঁড়িয়েছেন।
কাউকে বাড়ি তৈরির সময় টাকা পয়সা ধার দিয়ে উপকার করেছেন।
আশংকা করছি, এসব কথা বললাম বলে ধমক না খেয়ে যাই।
এসব ব্যাপারে তিনি তো মুখ খোলার পাত্র নন।

পর্যটনের নেশা আমার রক্তের ভিতরে। প্রভাতদা নিজেও ভ্রমণরসিক। আমার ভ্রমণ বাসনাকে তিনি উসকে দেন।ভ্রমণ নিয়ে ছ-খানি  বই লিখেছি। সবই তাঁর প্রেরণায়। পর্যটনে বেরুলে আমার বা আমাদের গতিবিধির ওপর তাঁর নজর থাকে।
তাঁকে বলতে গেলে, ধারাভাষ্য দিতে হয়।
২০১৮ সালে নানা রকম অসুখে ভুগেছিলাম। শরীরটা যেন মাল্টি -ডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল হয়ে গিয়েছিল।
সেই সময় প্রতি রবিবার  বউদি শ্রীমতী যুথিকা চৌধুরীকে নিয়ে দমদমে আমাদের ফ্ল্যাটে  আসতেন।
টিফিনে রুটি- তরকারি নিয়ে আসতেন। আমাদের সঙ্গে শেয়র করতেন। এই কঠিন সময়ে লাদাখ নিয়ে ভ্রমণ কাহিনি লেখা চলছিল। প্রভাতদা রিতাকে বলেছেন, 'রাইটিং প্যাড দাও। গৌরাঙ্গ ডিক্টেশন দেবে, লাদাখ নিয়ে লেখাটা লিখে ফেলব'। প্রভাতদার নির্দেশ মানতে পারিনি আমরা। আমি ডিক্টশন দেবো আর প্রভাতদা লিখবেন, সেটা প্রাণ থাকতে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
প্রভাতদার সঙ্গে কত জায়গায় গিয়েছি। তাঁর সঙ্গ লাভ করেছি, তাঁকে সঙ্গে দিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। ্
বহুবার এমন হয়েছে, তাঁর সঙ্গে কোথাও যাওয়ার প্রোগ্রাম হয়েছে,
নির্দিষ্ট দিনে, সময় মতো , নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করছি, চলতে চলতে  জানতে পেরেছি কোথায় যাচ্ছি আমরা। ঈশ্বরকে বা ঈশ্বর তুল্য ব্যাক্তি কে প্রশ্ন করা অশোভন।
ছায়ার মতো প্রভাতদাকে অনুসরণ করে তৃপ্তি পাই খুব।
তাঁর সঙ্গে পথ চলে বুঝেছি, তাঁর অনেক ছায়া আছে, সৌরভ জড়ানো ফুল আছে, ষষ্ঠী তৎপুরুষ - মার্কা পাখির ডাক আছে।
প্রভাতদার বকুনি কি খুব কম শুনেছি? নিমেষে জ্বলে ওঠেন, ঝলসে ওঠেন। তীব্র বকুনি দিয়ে বলেন, নাসের সব চেয়ে বেশি বকুনি খায়। বকুনি খেয়ে একটু শীতল দূরত্ব রচনা করেছি কখনো কখনো। প্রভাতদা 'গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গ', বলে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে থাকেন।
আসলে সবাইকে তিনি খুব স্নেহ করেন। তাঁর বিস্তীর্ণ ডানার ওমে আমাদের নিরাপদে রাখতে চান।
যাঁরা তাঁর স্নেহপ্রবণ সত্তাটিকে দেখতে পান না, তাঁরা শুধু দু:খ পান, তাঁরা দূরে সরে যেতে থাকেন।
কোনোদিন ৪৯ পটল ডাঙা স্ট্রিট থেকে সকাল সকাল চলে আসতে চাইলে প্রভাতদা অবশ্যই জিনতে চাইবেন, 'কেন যাচ্ছ, মাত্র তো আটটা বেজেছে।
তাঁকে জানাতে হয় আগামীকাল ফাস্টিং ব্লাড সুগার টেস্ট করাবো। আজ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেতে হবে।
ব্যস, পরদিন প্রভাতদার কাছ থেকে উপর্যুপরি ফোন আসবে, রক্ত দিয়েছো? 'কখন রিপোর্ট দেবে?, রিপোর্ট পেয়েছো?, রিপোর্টে কী এলো? আমার চোখদুটি দেখতে না পেলেও হৃদয় -মন অন্ধ নয়। সেই জন্যই---।
তাছাড়া আমার সবকটি পথ প্রথমে রোম পরে রোম থেকে কবিতায় এসে মিলিত হয়েছে।
আমার কোনো দু:খ নেই, হতাশা নেই ফুল্লরা বারোমাস্যা নেই। আমাদের প্রভাত চৌধুরী নামক এক স্বপ্ন-পুরুষ আছেন। তাঁর কাঁধের ঝোলাব্যাগের ভিতরে স্বপ্নের শিশুবৃক্ষ উদ্ভিদ জীবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমরা জেনে গেছি  আমাদের কোনো বিষবৃক্ষ নেই, আমাদের কোনো বিষাদবৃক্ষও নেই।
জানিলাম, ' এ জগৎ স্বপ্ন নয়,
জানিলাম এ জগৎ স্বপ্নময়।

1 মন্তব্যসমূহ

  1. তাঁকে যারা বুঝতে পারেননি তারা হতভাগ্য। তাঁকে যারা এড়িয়ে গেছে তারা পিছিয়ে পড়েছে। কম করে দুইযুগ পিছিয়ে পড়েছে। অবশ্য সেটা বুঝতে তাদের আরো দুইযুগ লাগবে। হাতে অতিরিক্ত আরো ±১০ রাখা থাকলে। গৌরাঙ্ত্রেগ মিত্রের এই গদ্যে মানুষপ্রভাত চৌধুরীর একটি অনন্য চরিত্রফু উঠেছে। লেখাটির জন্য তাঁকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম । এই লেখা প্রকাশের জন্য সম্পাদকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন